বালাবাড়ি রেলস্টেশন অপারেশন (চিলমারী, কুড়িগ্রাম)
বালাবাড়ি রেলস্টেশন অপারেশন (চিলমারী, কুড়িগ্রাম) পরিচালিত হয় ১৭ই অক্টোবর। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অপারেশনে অর্ধশতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। অপরপক্ষে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের সরাসরি এ যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় ও পাকসেনাদের পরাজয়ের ঘটনা স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের মধ্যে প্রবল আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়।
উলিপুর-চিলমারীর মধ্যবর্তী রেলস্টেশন বালাবাড়ি। চিলমারী নদী বন্দর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পাকবাহিনী এ স্টেশনকে তাদের দ্বিতীয় ডিফেন্স হিসেবে ব্যবহার করত। রেল ও সড়ক পথ এখানে পাশাপাশি থাকায় ও চিলমারীর থানা সদর কাছাকাছি হওয়ায় পাকিস্তানিদের কাছে এ স্টেশনের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। বালাবাড়ি রেলস্টেশনের প্রায় ২ কিলোমিটার পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ। বালাবাড়ি রেলস্টেশনের পূর্বদিকে মূল সড়কের ওপর একটি ব্রিজ ছিল। ব্রিজের পাশে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের বড় ক্যাম্প ছিল। ১৭ই অক্টোবর পাকিস্তানি এ ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ ক্যাম্পে বালুচ রেজিমেন্ট ও ইপিক্যাপ-এর সৈন্যদের অবস্থান ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নেতৃত্ব দেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। চাঁদ কোম্পানি আফতাব বাহিনী, খায়রুল আলম কোম্পানি, রঞ্জু কোম্পানি ও দুলু কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে এতে অংশ নেন। আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে আক্রমণের সূচনা হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র আক্রমণ রচনা করলেও কাঙ্ক্ষিত জয় পাচ্ছিলেন না। শত্রুরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রাত পার হয়ে দিন গড়ালেও থেমে-থেমে গুলি চলতে থাকে। এ অবস্থায় সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহের ব্রিজের কাছে গিয়ে পাকিস্তানিদের অবস্থান লক্ষ করে লাইট মেশিনগান দিয়ে নিজে আক্রমণ শুরু করেন। তাঁর ব্রাশফায়ারে রেললাইনের দক্ষিণ দিক থেকে ব্রিজের কাছে অগ্রসর হতে থাকা বেশকিছু পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য আত্মক্ষার জন্য পাশের ডোবায় লাফিয়ে পড়ে। একদল পাকসেনা দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে যায়। মেজর তাহেরের সরাসরি অংশগ্রহণ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ জাগায়। আবু তাহেরের নির্দেশে বীর যোদ্ধা আবু বকর ১ জন পাকিস্তানি সৈন্যের পরিহিত ব্যাজ খুলে এনে তাঁকে দেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমুখী আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যরা টিকতে না পেরে এক পর্যায়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেদিন দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ-যুদ্ধে অর্ধশতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়। পাকসেনা ও রাজাকারদের লাশ রেললাইনের পার্শ্ববর্তী ডোবায় পড়ে থাকে। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা রবিউস সামাদ, আবু বকর সিদ্দিক, সুবেদার আব্দুল মান্নান, আবুল কাশেম চাঁদ, শওকত আলি সরকার, খায়রুল আলম (নজরুল ইসলাম) প্রমুখ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বালাবাড়ি রেলস্টেশন অপারেশন পাকিস্তানিদের মনে ভয়ঙ্কর ভীতির জন্ম দেয়। অন্যদিকে এ-যুদ্ধের সফলতা মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের মধ্যে প্রবল আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। [এস এম আব্রাহাম লিংকন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড