You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাবুরপুকুর গণহত্যা (বগুড়া সদর)

বাবুরপুকুর গণহত্যা (বগুড়া সদর) সংঘটিত হয় ১১ই নভেম্বর। এতে ১৪ জন নিরীহ গ্রামবাসী প্রাণ হারায়।
বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে বগুড়া-নাটোর মহাসড়ক সংলগ্ন স্থানে বাবুরপুকুর অবস্থিত। পাকিস্তানি বাহিনী ১১ই নভেম্বর এখানে লোমহর্ষক গণহত্যা সংঘটিত করে। এ গণহত্যার সঙ্গে বীরাঙ্গনা নূরজাহানের নাম জড়িয়ে রয়েছে। তিনি বগুড়া টেলিফোন অফিসে অপারেটর পদে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন শহরের ঠনঠনিয়া তেঁতুলতলা এলাকার আজিজার রহমান তোতার দ্বিতীয় স্ত্রী। টেলিফোন অপারেটর হওয়ার কারণে যুদ্ধের দিনগুলাতে টেলিফোনে পাকবাহিনীর আদান-প্রদান করা অনেক তথ্য তিনি জানতেন এবং তা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। তিনি এজন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং রাজাকার দের টার্গেটে পরিণত হন। একই সঙ্গে তাঁর স্বামী আজিজার রহমান তোতার ওপরও নজর রাখছিল। খান্দারের আনিছার রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শান্তি কমিটির সদস্য তার দুই ভাই ছফের ও বুলু এবং দুই ছেলে সাজ্জাদ ও শাজাহান প্রমুখ তাঁদের নজরে রাখছিল।
নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তুমুল লড়াই শুরু হলে ঠনঠনিয়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা নিজ এলাকার রাজাকারদের নির্মূলের পরিকল্পনা করেন। এজন্য তারা রণাঙ্গন থেকে গোপনে বাড়িতে আসতে শুরু করেন। ঠনঠনিয়ার পশারীপাড়ার পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য মাহফুজুর রহমান ওরফে আব্দুল মান্নান, তার ভাই ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আব্দুল হান্নান ও ন্যাপ- কর্মী ওয়াজেদুর রহমান টুকুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ভেতরে-ভেতরে সংগঠিত হতে শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত হওয়ার খবর এলাকার
শান্তি কমিটির লোকজন ও রাজাকারদের কাছে পৌঁছে যায়। নিজেদের রক্ষায় তারা মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সহায়তাকারীদের নির্মূলের পাল্টা ছক কষে। এরই অংশ হিসেবে ১১ই নভেম্বর গভীর রাতে রাজাকারদের দেখিয়ে দেখা পথ অনুসরণ করে পাকবাহিনীর শতাধিক সদস্য চারদিক থেকে ঠনঠনিয়ার শহীদ নগর, পশারীপাড়া, শাহ্পাড়া ও তেঁতুলতলা এলাকা ঘিরে ফেলে। তারা দরজা ভেঙ্গে আজিজার রহমান তোতার ঘরের ভেতর প্রবেশ করে নূরজাহানের হাত ধরে তাঁকে ঘর থেকে বের করে পরনের শাড়ি দিয়ে চোখ এবং দড়ি দিয়ে দুহাত বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে জিপে তুলে নেয়। এরপর তারা শহীদনগর এলাকায় গিয়ে একে-একে মোফাজ্জল হোসেন আবুল, তার ছোটভাই কিশোর আশরাফ আলী, পিতা গিয়াস উদ্দিন ওরফে গেদু শেখ, সাইফুল ইসলাম, ফজলুর রহমান খান, আব্দুস সবুর ম ল, আলী খন্দকার ও তার ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন খন্দকারকে হাত-পা বেঁধে ট্রাকে তোলে। একই কায়দায় পশারীপাড়া থেকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাহফুজুর রহমান ওরফে আব্দুল মান্নান, তাঁর ভাই ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আব্দুল হান্নান, ন্যাপ কর্মী ওয়াজেদুর রহমান টুকু, মোশাররফ হোসেন, বাচ্চু শাহ্ ও সাবের হোসেন এবং শাহ্পাড়া থেকে আলতাফ হোসেন, বাদশা শেখ, বাচ্চু শেখ, মন্টু ও তার ভাই জালাল মণ্ডল এবং অজ্ঞাতনামা আরো একজনসহ ২১ জনকে ট্রাকে তোলে। ফজরের আজানের পর প্রায় আধা ঘণ্টা পর রাস্তার পাশে ট্রাক থামিয়ে তাদের নামিয়ে লাইনে দাঁড় করানো হয়। যাচাই-বাছাই শেষে দুই কিশোর ও তিন বৃদ্ধসহ ৭ জনকে বাদ দিয়ে নূরজাহানসহ ১৪ জনকে বাবুরপুকুর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে একে-একে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। বাবুরপুকুর গণহত্যার শিকার ১৪ জন হলেন- নূরজাহান বেগম (স্বামী আজিজার রহমান, ঠনঠনিয়া), মাহফুজুর রহমান পশারী ওরফে আব্দুল মান্নান (কমিউনিস্ট পার্টির নেতা), আব্দুল হান্নান পশারী (ছাত্র ইউনিয়ন নেতা), মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম, ওয়াজেদুর রহমান টুকু (ন্যাপ কর্মী), জালাল ম ল, মন্টু ম ল, আব্দুস সবুর ম ল, আশরাফ আলী (পিতা গিয়াস উদ্দিন ওরফে গেদু শেখ), বাদশা শেখ, বাচ্চু শেখ, ফজলুর রহমান খান, মোফাজ্জল হোসেন আবুল এবং অজ্ঞাত একজন। ২০০৫ সালে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এর পাশেই শহীদদের নামফলক বসানো আছে। [মিলন রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!