You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বামনা উপজেলা (বরগুনা)

বামনা উপজেলা (বরগুনা) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পরপরই বামনা উপজেলার মুক্তিকামী মানুষ দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য সংগঠিত হতে থাকে। তাদের একত্রিত হওয়ার জন্য বুকাবুনিয়া বাজারে একটি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। বুকাবুনিয়ার চালিতাবুনিয়া গ্রামের ইয়াদ আলী পাহলানের বাড়িতেও তারা মিলিত হতো। পরে বুকাবুনিয়া স্কুলের একটি কক্ষে বসে আন্দোলনের পরিকল্পনা চলত। ধীরে-ধীরে এখানে স্থানীয় ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিসংগ্রামীরা এসে সংগঠিত হতে থাকেন।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর হামলার পর তাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা দলে-দলে বুকাবুনিয়ায় এসে জড়ো হন এবং যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রথমদিকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কোনো লোক ছিল না। তখন বামনা থানার এক বাঙালি পুলিশ সদস্য আবুল কাশেম (পাথরঘাটা উপজেলা) গভীর রাতে ছদ্মবেশে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আবার থানায় চলে যেতেন। পরে বামনা উপজেলার সন্তান ক্যাডেট কলেজের ছাত্র সেলিম সরদার এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁর কিছুটা সামরিক প্রশিক্ষণ থাকায় তাঁকে দিয়ে প্রশিক্ষণের কাজ চলতে থাকে। অতঃপর ছাত্রলীগ নেতা হুমায়ুর কবীর হিরু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন মজনু খান এবং বরগুনার ছাত্রলীগ নেতা সিদ্দিকুর রহমানকে ভারতে পাঠানো হয়। তাঁরা সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বুকাবুনিয়ায় এসে নবীন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু অস্ত্রের অভাবে তাঁরা প্রশিক্ষণ দিতে পারছিলেন না। এমন সময় ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমামের নির্দেশে ঐ অঞ্চলের সাবসেক্টরগুলোর কমান্ডাররা চালিতাবুনিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে মিলিত হন। সেখানে তাঁদের কিছু এসএলআর, গ্রেনেড ও রাইফেল দেয়া হয়। এসব অস্ত্র দিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং তাঁরা পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এ-সময় কমান্ডার আলমগীর হোসেন ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৫০-৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও বেশকিছু অস্ত্র নিয়ে বুকাবুনিয়ায় আসেন। এই অতিরিক্ত জনবল ও অস্ত্র পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের শুধু প্রতিহতই নয়, তাদের ওপর হামলা করারও সাহস অর্জন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ মনে করে বুকাবুনিয়ায় নবম সেক্টরের একটি সাবসেক্টর স্থাপন করা হয়। এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম ও আলমগীর হোসেন। কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্বে ছিলেন আব্দুল মজিদ মাস্টার ও মোবারক আলী মল্লিক।
বামনা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন আসমত আলী সিকদার এমএনএ, ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম, আলমগীর হোসেন, আনোয়ার হোসেন মজনু খান, মোবারক মল্লিক, মজিদ মাস্টার, ধলু মোল্লা, আমীর হোসেন, আবদুল মালেক, আলমগীর আহম্মেদ মধু তালুকদার প্রমুখ। ২৩শে নভেম্বর পাকবাহিনী বেতাগীর বদনীখালী বাজার পুড়িয়ে দিয়ে এম ভি আল-আকরাম নামক একটি লঞ্চে করে বামনা বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ খবর পেয়ে তাদের প্রতিরোধ করার জন্য আমুয়া নদীর পাড়ে আমজাদ খানের বাড়ির পেছনের রাস্তায় অবস্থান নেন। তীরের কাছাকাছি আসতেই লঞ্চের গতি কমিয়ে দেয়া হয়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা লঞ্চের ছাদে চারটি হালকা মেশিনগান ও ৮ জন সৈন্য এবং লঞ্চের ভেতরে আরো সৈন্যদের দেখতে পান। লঞ্চটি অরেকটু কাছে আসতেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা সেলিম সরদার ফায়ার শুরু পাকবাহিনীও পাল্টা ফায়ার করে।
দুপক্ষে তুমুল গোলাগুলি চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের হালকা একটি মেশিনগান দুটি ম্যাগাজিন ফায়ার করার পর বিকল হয়ে যায়। এমন সময় এম এ আজিজ ঝুঁকি নিয়ে ছোট রকেটগান দিয়ে ফায়ার শুরু করেন। এক পর্যায়ে সেটিও নষ্ট হয়ে যায়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি এসএলআর দিয়ে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে থাকেন। এভাবে ঘণ্টাখানেক গোলাগুলির পর পাকবাহিনী পিছু হটে বেতাগীর দিকে চলে যায়।
বামনা উপজেলায় পাকবাহিনীর কোনো স্থায়ী ক্যাম্প ছিল না। তারা মাঝে-মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ ও থানায় এসে আবার চলে যেত। তবে বামনা থানায় পাকবাহিনীর অনুগত পুলিশ ও রাজাকার বাহিনী থাকত।
বামনা উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে গোলাম মাওলা জমাদ্দার (ডৌয়াতলার চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির সভাপতি), মালেক জমাদ্দার, সৈয়দ ইরতিজা আহসান, মহব্বত আলী হাওলাদার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এরা সকলে শান্তি কমিটির সদস্য ছিল।
বুকাবুনিয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটি গড়ার পর স্বাধীনতাবিরোধী চক্র তৎপর হয়ে ওঠে। কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যানের সমন্বয়ে গঠিত হয় শান্তি কমিটি। শান্তি কমিটির তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী। এ দু-বাহিনীর সদস্যরা বামনা উপজেলার পুরাতন বামনা, ডৌয়াতলা ও রামনায় সবচেয়ে বেশি তৎপরতা চালায়। তবে বুকাবুনিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি থাকায় সেখানে তাদের তৎপরতা অপেক্ষাকৃত কম ছিল।
বামনা উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটায়। তারা বামনা বাজারের সুধাংশু দাসের বাড়িতে হামলা চালিয়ে একজন নারীকে গণধর্ষণ করে। তারা লঞ্চযোগে পুরাতন বামনা বাজারে এসে সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের ১০-১২টি ঘরে আগুন দেয় এবং লুটপাট চালায়। ভাইজোড়া গ্রামের হাসেম প্রেসিডেন্ট, নেছার মৃধা ও বেলায়েত প্রেসিডেন্টের বাড়িতেও তারা অগ্নিসংযোগ করে।
২৩শে নভেম্বর পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার পর মুক্তিযোদ্ধারা পরের দিন ২৪শে নভেম্বর ভোররাতে বামনা থানা আক্রমণ করেন। থানার অভ্যন্তরে থাকা পুলিশ ও রাজাকাররা তার পাল্টা জবাব দেয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা থানার উত্তর দিকে আকনবাড়ির বাগান, দক্ষিণ দিকে সারওয়ারজান হাইস্কুল ও পশ্চিমে সদর মসজিদের পাশ থেকে একযোগে থানা লক্ষ করে গুলি চালান। সেনাবাহিনীর নায়েক আমীর হোসেন থানা ভবনের দিকে কয়েকটি গ্রেনেড ছুড়ে মারলে পুলিশ ও রাজাকারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণ পরেই তারা আত্মসমর্পণ করে। ফলে এদিনই বামনা উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
বামনা উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দুজনের নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন- সিপাহি খন্দকার রফিকুল ইসলাম (পিতা খন্দকার আবদুল লতিফ, কলাগাছিয়া কুমিল্লার গোপনঘাট এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ) এবং মো. আলাউদ্দিন আলম (উত্তর কাকচিড়া; বাগেরহাটের শরণখোলায় পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ)। মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মো. জিয়া উদ্দিন তারেক আলীর প্রচেষ্টায় ২০১৩ সালে বুকাবুনিয়ায় একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, বামনা উপজেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র গোলচত্বরে একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ এবং ডৌয়াতলা বাজারে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মো. আনোয়ার হোসেন মজনু খান পরিচালিত ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন-এর অর্থায়নে ‘শিখা উন্নত শির’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [মনোতোষ হাওলাদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!