মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা
বামপন্থী বলতে সেসব রাজনৈতিক দলকে বোঝানো হয়েছে, যারা বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের অনুসারী ছিল। তাদের সকলের আদি উৎস ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। ভারত বিভক্ত হয়ে যখন পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল, তখন ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি- মার্চ মাসে ভারতে অনুষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলন (Congress)-এর মাধ্যমে ঐ দল থেকে পৃথক হয়ে সৃষ্টি হয় পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি, যার প্রথম নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী কমরেড সাজ্জাদ জহির। তবে এ পার্টি ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বেআইনি ঘোষিত হয়। তখন থেকে পাকিস্তানের কমিউনিস্টরা আত্মগোপনে চলে যান এবং বিভিন্ন প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলের ও কমিউনিস্ট প্রভাবিত গণসংগঠনের ছত্রছায়ায় থেকে স্বীয় আদর্শ বাস্তবায়নের সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে পাঁচ- ছয় বছর বাদ দিলে বাকি সমস্ত সময় জুড়েই বামপন্থীদের মূল দলটির সদস্যদের তথা কমিউনিস্টদের সংগ্রাম করতে হয়েছে আত্মগোপন অথবা জেলে বন্দি থাকা অবস্থায়। সুতরাং বাধ্য হয়ে তারা এ-সময় যেসব অন্যান্য প্রকাশ্য সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করেছেন, সেগুলে হচ্ছো— আওয়ামী মুসলিম লীগ, যুবলীগ, গণতন্ত্রী দল, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফফর), নানা ধরনের পেশাভিত্তিক গণসংগঠন, যেমন ছাত্র ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি, শ্রমিক সমিতি বা ইউনিয়নসমূহ ইত্যাদি। তাদের এ আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান উভয় প্রদেশেই বিস্তৃত ছিল।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বামপন্থীরা বাঙালিদের ধারাবাহিক স্বাধিকার আন্দোলনে কখনো নেপথ্যে কখনো প্রকাশ্যে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিলেন। ৫২-র ভাষা- আন্দোলন-, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-র স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান- এবং সর্বশেষে ৭১- এর মুক্তিযুদ্ধ সর্বক্ষেত্রে বামপন্থী কমিউনিস্টদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার প্রমাণ বই-পুস্তকে পাওয়া যায়। স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২) এবং কারাগারের রোজনামচা (২০১৭) উভয় গ্রন্থে বামপন্থীদের ভূমিকার কথা কিছু ছোট-খাট সমালোচনাসহ স্বীকৃত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকাকে প্রধাণত তিনটি রাজনৈতিক প্রবণতায় বিভক্ত করে দেখা যেতে পারে-
ক) ইতিবাচক
খ) নেতিবাচক
গ) আংশিক ইতিবাচক ও আংশিক নেতিবাচক।
ইতিবাচক ভূমিকাসম্পন্ন বামপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর সর্বদা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে পার্থক্য বজায় রেখেই তার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন এবং প্রধানত ঐক্যবদ্ধভাবেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি পর্বে শেষ পর্যন্ত সাধারণ শত্রু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। মস্কোপন্থী বাম বলে পরিচিতি এ বামদের মধ্যে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের বিভিন্ন পর্বে কৌশল কী হওয়া উচিত তা নিয়ে জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে মতভিন্নতা থাকলেও কখনো ঐ মতভিন্নতা বৈরিতামূলক দ্বন্দ্বে পরিণত হয়নি। তাদের সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক পার্থক্য স্বীকার করে নিয়েই ইতিবাচক এবং তার ফলে ঐক্যবদ্ধ বা মূলধারার মুক্তিসংগ্রামে তাদের অবদানও ছিল তদ্রূপ। সেভাবেই তাদের ভূমিকা স্বীকৃত ও চিত্রিত হয়ে আছে।
এ কথা সকলেরই জানা যে, মুক্তিযুদ্ধে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল সাধারণভাবে পাকিস্তান সমর্থকগোষ্ঠী যারা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিল এবং ভারতকে শুধু ভিন্ন একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেবেই দেখত না, বরং “শত্রু কবলিত’ পৃথক ও বিপরীত আদর্শের একটি দেশ হিসেবেই ঐতিহাসিকভাবে দেখে এসেছে। এক কথায়, এরা হচ্ছে কট্টর মুসলিম সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-শক্তি। বামপন্থীদের প্রকৃতিগতভাবেই সে ধরনের মানসিকতাসম্পন্ন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তবুও তাদের কারো কারো মধ্যে ভারত ও ভারত সমর্থক বৃহৎ দেশসমূহ (যেমন মুক্তিযুদ্ধকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন) সম্পর্কে ভিন্ন কারণে নেতিবাচক ও বিপরীত মনোভাব গড়ে ওঠে। তারা মনে করতেন, বিশেষ করে চীন বনাম ভারত-সোভিয়েত অক্ষ শক্তির তদানীন্তন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে চীনের অবস্থানই হচ্ছে সঠিক এবং ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই হচ্ছে আধিপত্যবাদী সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। অবশ্য দুনিয়ার আরেক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও তারা সাম্রাজ্যবাদী বলে অভিহিত করেছিলেন, যদিও মুক্তিযুদ্ধের সেই ঐতিহাসিক কালপর্বে তখন পিং-পং কূটনীতির সূত্রে চীন-আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্রতা গড়ে উঠেছিল। বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্যান্য নিজস্ব কারণে বামপন্থীদের চীনভক্ত অংশগুলো তখন ভারত- সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় পরিচালিত মূল ধারার মুক্তিযুদ্ধকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। তাদের মধ্যে অবশ্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাও ছিল। তবে তারা বিশ্বাস করতেন যে, তদানীন্তন জাতীয়তাবাদী শক্তি আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক আর সেজন্য তারা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে কখনোই বিশ্বাস করতেন না। মূলত এ দুকারণে তাদের মধ্যে একটি অদ্ভুত তত্ত্বের অবতারণা হয়- মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে ‘দুই কুকুরে লড়াই’। তারা তখন একই সঙ্গে ‘পাকিস্তানি বাহিনী’ এবং ‘মুক্তিবাহিনী’ উভয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এ দ্বৈত ভূমিকার কারণে তারা মুক্তিযুদ্ধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হন। যতই দিন যেতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধের মূলধারাটি যত শক্তিশালী হতে থাকে, ততই তাদের জনবিচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকে এবং দেশ স্বাধীন হলে তারা অনেকেই তা মেনে নিতে ব্যর্থ হন। ফলে তাদের ভূমিকা জনগণের কাছে সাধারণভাবে নেতিবাচক হিসেবেই রয়ে যায়। এ ঐতিহাসিক ভুলের মাসুল অজো তাদের বহন করতে হচ্ছে।
তবে সূক্ষ্ম বিচারে দেখতে পাওয়া যায়, চীনপন্থী বামদের মধ্যেও কেউ-কেউ প্রথম থেকেই মাও বা চীনের তদানীন্তন অবস্থানের প্রতি অন্ধত্ব পরিত্যাগ করে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সঠিক মর্মবস্তুকে কিছুটা অনুধাবনের চেষ্টা করেছিলেন। এ অংশের সঙ্গে চীনের তদানীন্তন নেতৃত্ব ও পলিসির দূরত্ব অন্তত মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার কারণে ধীরে-ধীরে বাড়তে থাকে এবং তারা তখন মূল ধারারসংগ্রামের কিছুটা কাছাকাছি আসতে থাকেন। তবে তাঁরা ভারত সম্পর্কে কখনোই সন্দেহমুক্ত হতে পারেননি এবং ভারতের সরকারও তাদের সন্দেহের চোখেই দেখে এসেছে। বিশেষ করে ভারতের ইন্দিরা সরকারের সঙ্গে ভারতের যে সব বামপন্থীর তখন তীব্র দ্বন্দ্ব চলছিল, যেমন সিপিআই (মার্কসবাদী) ও সিপিআই-এমএল তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের চীনপন্থীদের একটি অংশের সখ্য দ্রুত গড়ে ওঠে। ঐসব চীনপন্থী সিদ্ধান্ত নেন যে, দেশের ভেতরে থেকেই তারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ অব্যাহত রাখবেন। সেখানে ঘাঁটি এলাকা গড়ে তুলবেন। তারা ভাবতেন যে, চীন বিপ্লবের কায়দায় মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলে সেখানে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়িত করবেন। তাদের ধারণা ছিল মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে এবং তারা একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে সক্ষম হবেন। এ ধারণা অবশ্য পরবর্তীতে বাস্তবায়িত হয়নি। সামগ্রিক বিবেচনায় তাই এদের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে সম্পূর্ণ নেতিবাচক ছিল বলা যাবে না। কোথাও-কোথাও মূল ধারার মুক্তিফৌজ ও মুজিব বাহিনী-র সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সংঘাত হলেও এদের কেউ-কেউ ঐসব বাহিনীতে গোপনে যোগ দিয়ে যেমন মুক্তিযুদ্ধ চালিয়েছেন, তেমনি দেশের ভেতরে কোনো-কোনো এলাকায় অবস্থান নিয়ে বাকিরা পৃথকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। সম্মুখ সমরে ও গেরিলা সংগ্রামে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে তাদের অনেকে শহীদও হয়েছেন। তাই চীনপন্থীদের এ অংশটির ভূমিকাকে কিছুটা আলাদাভাবে চিহ্নিত করা উচিত হবে। এদের ভূমিকাকে আংশিক ইতিবাচক-আংশিক নেতিবাচক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
মূল ধারার মুক্তিসংগ্রামে ইতিবাচক ভূমিকা: সিপিবি (মণি সিংহ), ন্যাপ (মোজাফফর) এবং ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) – এ বামপন্থী শক্তিগুলো ভারতের ভেতরেই গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। তাদের পৃথক ট্রেনিং ক্যাম্প, পৃথক বাহিনী, পৃথক কমান্ডও ছিল। তবে তারা মুজিবনগর সরকার- ও ভারত সরকারের অনুমোদন নিয়েই তা পরিচালনা করার সুযোগ লাভ করে। সম্ভবত ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী এবং ঐতিহাসিকভাবে জাতীয়তাবাদী শক্তি আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের পুরাতন ইতিবাচক সম্পর্কের কারণে মূল ধারায় থেকেই তাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়েছিল। এ শিবিরের প্রধান নেতা কমরেড মণি সিংহ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত জাতীয় ঐক্যের প্রতীক মুক্তিযুদ্ধ উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় তাদের ভূমিকাকে নিম্নোক্ত ভাষায় বর্ণনা করেছেন—
ক) কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ ক্যাম্প স্থাপন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের সহায়তায় সীমান্তবর্তী ভারতের তিনটি রাজ্যে তাদের আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা।
খ) দু ধরনের ক্যাম্প ছিল পার্টির বয়স্ক সদস্যদের পরিবারবর্গসহ আশ্রয়ের জন্য এবং তরুণদের জন্য, যাদের লড়াইয়ের উপযুক্ত মনে করা হবে ও ট্রেনিং দিয়ে পাঠানো হবে।
গ) ক্রমশ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সহায়তা গ্রহণ এবং কমিউনিস্ট পার্টি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনয়ন পরিচালিত ক্যাম্পে সংগঠিত তরুণদের বাংলাদেশ সরকার-এর মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিংয়ে প্রেরণ।
ঘ) কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের মিলিত একটি নিজস্ব গেরিলা বাহিনী গঠন। এতে প্রথমে ট্রেনিংদানে প্রভূত ‘টেকনিক্যাল’ অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। কিন্তু পরে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে তা গঠন করা সম্ভব হয়।
ঙ) আগরতলায় এবং মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে কলকাতায়ও কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যালয় গঠন করে কাজ করা হয়।
চ) কমিউনিস্ট পার্টি ও এর সহযোগীদের নিজস্ব গেরিলা বাহিনীকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই দেশের ভেতরে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়।
ছ) দেশের ভেতরের কমরেডদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং অনুপ্রবিষ্ট গেরিলাদের সহায়তা প্রদান করা হয়।
জ) ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা তরুণদের রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
ঝ) কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করে তা সকল ক্যাম্প, শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এবং দেশের ভেতরেও প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়।
কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর ৫ হাজার তরুণকে ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পাঠানো হয়। এছাড়াও নেতৃত্বের প্রচেষ্টায় আরো ১২ হাজার তরুণকে সংগ্রহ ও সমবেত করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিবাহিনীতে পাঠানো হয়। অর্থাৎ মোট ১৭ হাজার তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে ট্রেনিং ও যুদ্ধের জন্য সংগঠিত করা হয়। মূল ধারার মুক্তিসংগ্রামে আংশিক ইতিবাচক ও আংশিক নেতিবাচক ভূমিকা: চীনপন্থীদের যে অংশটি দেশের ভেতরে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাদের মূল নেতা ছিলেন রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো এবং কাজী জাফর আহমেদ। মেননের বর্ণনায়- “পশ্চিম বাংলার নকশালবাড়ী আন্দোলনের নেতা চারু মজুমদারের তত্ত্ব অনুসরণ করে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ বাদে বাম কমিউনিস্ট অন্যান্য গ্রুপ গণসংগঠন গণআন্দোলন বর্জন ও শ্রেণী শত্রু খতমের রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঐ মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ি’ বলে নিজেদের তার থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এসে এদের কোনো কোনো অংশ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পক্ষালম্বনও করে। বাম কমিউনিস্টদের এই বিভিন্ন গ্রুপ উপগ্রুপের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এ ধরনের ভ্রান্ত অবস্থান (যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসী যুদ্ধ করেছেন ও জীবনদান করেছেন) মুক্তিযুদ্ধে বাম-কমিউনিস্টদের ভূমিকাকে চরমভাবে কলঙ্কিত করেছে এবং দায় সকল বামপন্থীদের নিতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আগেই বলা হয়ে [ছে] বাম-কমিউনিস্টদের এ সকল অংশের ঐ ভ্রান্ত অবস্থানের বিপরীতে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ তার ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কর্মসূচী বাস্তবায়নে গেরিলা গ্রুপ গঠন, ঘাঁটি অঞ্চল গঠন ও অস্ত্র সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করে। এই ধারাবাহিকতায় ‘৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাত্রির গণহত্যার পরপরই ঐ সমন্বয় কমিটির মূল নেতৃত্ব তৎকালীন ঢাকা জেলার নরসিংদীর শিবপুর থানা (বর্তমানে উপজেলা)-কে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজ শুরু করে। সমন্বয় কমিটির নেতৃত্ব এপ্রিল-মে মাসে সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা শুরু করে।’
মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ সম্পর্কে মেননের এ বিবরণ অনেকখানি আত্মসমালোচনামূলক। তবে তাঁর লেখার শেষদিকে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সকল বামপন্থীদের ভূমিকা বিষয়ে একটি সামগ্রিক দ্বান্দ্বিক মূল্যায়নও তুলে ধরেছেন-
‘ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভক্তি ডান ও বাম বিচ্যুতি ও সর্বশেষে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঐ বাম কমিউনিস্টদের একাংশের সর্বনাশা বিভ্রান্তি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বামপন্থী ধারাকে হীনবল কেবল নয়, বিশাল প্রশ্নের সম্মুখীন করেছিল। কিন্তু ইতিহাসের একটি বা দুটি ঘটনা ইতিহাসের সব সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করে না। সেক্ষেত্রে মধ্য পঞ্চাশে সংখ্যাসাম্যনীতি মেনে নেয়া, পূর্ব পাকিস্তানের আটানব্বই ভাগ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়েছে বলে দাবি করা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা বলে উল্লেখ করা যায়। কিন্তু সেটিও ইতিহাসের সব কথা বা শেষ কথা ছিল না। বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের উঠতি পড়তির মধ্য দিয়ে পরিণামের দিকে অগ্রসর হয়েছে। সেক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থার ধারা সমানতালেই অগ্রসর হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা এই সমগ্র ইতিহাসের আলোকেই বিচার করতে হবে।’
মূল ধারার মুক্তিসংগ্রামে নেতিবাচক ভূমিকা: ১৯৬৭ সালে আদি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি থেকে চীনা লাইনের সমর্থকরা বের হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) গঠন করেন। এ পার্টিরই একাংশ ছিল এ নেতিবাচক ধারার প্রতিনিধিত্বকারী। এ নেতিবাচক ধারার নেতৃত্বে ছিলেন সুখেন্দু দস্তিদার, আব্দুল হক এবং তোয়াহা। এরা ৬-দফা, ১১-দফাসহ সকল প্রকার নির্বাচনবিরোধী লাইন গ্রহণ করেন এবং এক ধাক্কায় (at one stroke) জনগনতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমে বিশ্বাসী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে এদের বাহিনীগুলো প্রধানত যশোরসহ দেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল এবং নোয়াখালীর বিভিন্ন চরাঞ্চলে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। তোয়াহা ও আব্দুল হকের লাইন অনুসারী নুর মোহাম্মদ ও বিমল বিশ্বাসের মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন স্মৃতিকথা থেকে তাদের অবস্থান সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। বিমল বিশ্বাসের বর্ণনায়—
‘১ নভেম্বর রাতে আকরপুরের এক পরিত্যক্ত বাড়ীতে রাত যাপন করি। ২ নভেম্বর রাতে বন খলিশাখালী গ্রামে অবস্থান করি। ৩ নভেম্বর বিকাল বেলা বাহিনীর সদস্যদের বুঝাবার চেষ্টা করি— এখন বাহিনীরূপে থাকার কোন যুক্তি নেই। সেই সময় ইব্রাহিম ও শাহজাহান বলেন, আপনারা যারা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, তারা আপনাদের আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে আশ্রয় পাবেন, কিন্তু আমাদের মতো ভূমিহীন ও কৃষক কর্মীদের বুকে ইপিসিপি (এম-এল)’র পোস্টার লাগিয়ে নওয়াপাড়া রাজাকার ঘাঁটিতে যেয়ে হাজির হওয়া ছাড়া পথ নেই। যদিও ইব্রাহিম পাকা বাড়ী করে এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন, শ্রমিক নেতাও হয়েছেন, কিন্তু মার্কসবাদী রাজনীতিতে নেই। উল্লেখ্য, আহত কমরেড নাজিমকে কিছু টাকা দিয়ে কোলার ডাক্তার বৈদ্যনাথ বিশ্বাস-এর উপর ছেড়ে দিয়ে বলেছিলাম বেঁচে থাকলে দেখা হবে। ৩ নভেম্বরেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাহিনী ভেঙ্গে দিয়ে এবং সকলকে কিছু কিছু টাকা দিয়ে আত্মরক্ষা করতে বলি। বেঁচে থাকলে দেখা হবে এটাই ছিল শেষ কথা৷’
মূল ধারার চীনপন্থী বামরা ছাড়াও আরো কয়েকটি শাখা- প্রশাখা বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের নাম উল্লেখ করা আবশ্যক। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, চীনপন্থী ধারার অনেক সদস্যই গোপনে মূল ধারার মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। রনো তাঁর লেখায় এরকম একটি মিশ্র বাহিনী হিসেবে ঢাকার বিখ্যাত ক্র্যাক প্লাটুন এর কথা উল্লেখ করেছেন। এ প্লাটুনের অন্যতম সদস্য ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা। তাঁর মতো আরো বেশকিছু চীনপন্থী মুক্তিযুদ্ধের মূল ধারার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
একই সময় সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে আরেকটি স্বতন্ত্র বামপন্থী বাহিনী পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি বরিশালের পেয়ারাবাগান অঞ্চলে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। শুরুর দিকে তাঁরাও মূল ধারার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থেকেই লড়াই চালিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ঐ ঐক্য ভেঙ্গে যায়।
অপর এক বামপন্থী নেতা ওহিদুর রহমান রাজশাহীর আত্রাই অঞ্চলে মূল ধারার মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কখনো ঐক্য কখনো সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। তবে সাধারণভাবে ঐক্যবদ্ধভাবেই তাঁর বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করে। তাঁর স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন-
“আমরা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করার পর প্রথমে ‘আত্রাই কমিউনিস্ট পার্টি’ পরবর্তীতে রাজশাহী জেলার ‘আঞ্চলিক কমিউনিস্ট পার্টি’ গঠন করি, যার নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক কমিশন তৈরি করা হয়, যা আমাদের ফৌজকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। এছাড়া চারজনের হাইকমান্ড (ওহিদুর রহমানকে কমান্ডার-ইন-চিফ নির্বাচিত করে আলমগীর কবির, আবদুল মজিদ ও এমদাদুর রহমানকে সদস্য করা হয়) ট্রেনিং ইন্সট্রাকশন, রেকি পার্টি, কোথ খাদ্যভাণ্ডার সিস্টেম চালু করা হয়েছেল। যদিও স্থায়ীভাবে আমাদের কোনো হেড কোয়ার্টার ছিল না। তবে মনছুর বিলের মতো বড় বিলের মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপের মতো গ্রামগুলোই প্রায় হেড কোয়ার্টারের মতো ভূমিকা পালন করত। ভ্রাম্যমাণ অস্ত্রাগার ও খাদ্য ভাণ্ডার নৌকাতেই ছিল।
আত্রাইয়ের ন্যাপ নেতা আফতাব মোল্লার নেতৃত্বে একটি টিমকে কিছু অর্থ দিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করার জন্য ভারতে পাঠাই। তিনি ৭নং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব.) কাজী নুরুজ্জামানের নিকট থেকে এক ট্রাক অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বালুরঘাট হয়ে বর্ডারের দিকে রওয়ানা দেওয়ার সময় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল [পরবর্তী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক; বর্তমানে প্রয়াত] খবর পেয়ে ওই ট্রাকটি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বলে আটকিয়ে দেন। আমরা অস্ত্রগুলো পেলে মুক্তিবাহিনীকে আরো ভালোভাবে গড়ে তুলতে পারতাম।
জলিল সাহেব যদি জানতে পারতেন আমরা প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত তাহলে হয়তো তিনি আটকাতেন না। উনি পরে জেনেছেন আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি এবং সাফল্য অর্জন করেছি।’
সামগ্রিকভাবে বিচার করলে মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা বিশেষত মস্কোপন্থী বামদের ভূমিকা ছিল জাতীয়ভাবে ইতিবাচক ও আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ গুরুত্ববহ। তবে চীনের লাইন অনুসারী বামপন্থীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে নানা বিভ্রান্তির শিকার হয়েছিল। [এম এম আকাশ] তথ্যনির্দেশ: মণি সিংহ, জীবন সংগ্রাম, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী ১৯৯২; হায়দার আকবর খান রনো (সম্পাদিত), মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীরা, ঢাকা তরফদার প্রকাশনী ২০১৮; এ টি এম আতিকুর রহমান, ‘মুক্তিযুদ্ধের রূপকল্প : পূর্ব বাংলার চীনপন্থী বাম রাজনীতি, ১৯৬৮-১৯৭১’, গবেষণা সন্দর্ভ (অপ্রকাশিত), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৩; নূর মোহাম্মদ, একাত্তরের যুদ্ধ : যশোরে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল)-এর বীরত্বপূর্ণ লড়াই এ জীবনদান, ঢাকা, সংহতি প্রকাশন ২০১৬; Talukder Maniruzzaman, Radical Politics and The Emergence of Bangladesh, Dhaka, Mowla Brothers 2003
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড