বান্দরকাটা যুদ্ধ (হালুয়াঘাট, ময়মনসিংহ)
বান্দরকাটা যুদ্ধ (হালুয়াঘাট, ময়মনসিংহ) সংঘটিত হয় ৬ই আগস্ট। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি বান্দরকাটা বিওপি-র পতন ঘটান। এখানকার যুদ্ধে ১৫-২০ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত এবং ৩০-৩৫ জন আহত হয়। অপরদিকে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৯ জন আহত হন।
ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে বান্দরকাটা বিওপি-র অবস্থান। ভারতের সীমান্ত সড়ক থেকে এর দূরত্ব দেড় কিলোমিটার বিওপি-র উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ডালুর কয়নাধুবি ও দুমনিকুড়া। পশ্চিমে আইলাতলী, কড়ইতলী ও তেলিখালী সীমান্ত ফাঁড়ি, পূর্বে ঘোষগাঁও ও চারুয়াপাড়া সীমান্ত ফাঁড়ি। বান্দরকাটা সীমান্ত ফাঁড়ির পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা দালদাম (গুমরিয়া) নদী। বান্দরকাটার আশপাশের গ্রামগুলোর মধ্যে ঘোষগাঁও, ভূঁইয়াপাড়া, মেকিরকান্দি, বালিগাঁও, রাজিরপুর, গাজিরভিটা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পাকবাহিনী ভারত সীমান্তবর্তী এ এলাকাটিকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য জুলাই মাসের প্রথম দিকে বান্দরকাটা বিওপিতে একটি ঘাঁটি স্থাপন করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক প্লাটুন সৈন্য তাদের এ দেশীয় দোসর এক প্লাটুন রাজাকার নিয়ে এ ঘাঁটিতে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। তাছাড়া হালুয়াঘাট ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অপারেশনাল এরিয়ার আওতায় থাকায় তারা পুরো সীমান্ত এলাকায় নিয়মিত সশস্ত্র টহল অব্যাহত রাখত। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। বান্দরকাটা ঘাঁটির পতন ঘটাতে পারলে ভারত থেকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মুন্সিরহাট, গোয়াতলা, হালুয়াঘাট, তারাকান্দা, ধারা, ধুরাইল প্রভৃতি এলাকায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন চালানো সহজ হবে। কাজেই কৌশলগত কারণে বান্দরকাটা বিওপি দখল করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় এবং এ বিওপি দখলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বান্দরকাটা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য জিয়াউদ্দিন কোম্পানি, আলী হোসেন কোম্পানি, আবুল হাশিম কোম্পানি, উইলিয়াম ম্রং কোম্পানি, আবদুল গণি কোম্পানি ও নাজমুল হক তারা কোম্পানির এফএফ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে বাছাইকৃত দুশতাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে নির্দেশ দেয়া হয়। যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন ডা. মাহমুদ ও লেফটেন্যান্ট কামাল। বিএসএফ-এর ক্যাপ্টেন বালজিৎ সিং, মেজর তেজ সিং, লেফটেন্যান্ট রাও, জ্ঞান সিং চৌহান, কৃপাল সিং প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের আর্টিলারি সাপোর্ট দেবেন। বান্দরকাটা বিওপি আক্রমণের তিনদিন পূর্বে রেকি সম্পন্ন করা হয়। আগস্ট মাসের ৩-৪ তারিখে বান্দরকাটার অদূরে ভারতের ডালুর কয়নাধুবি ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করা হয়। সেখান থেকে ৫ই আগস্ট সন্ধ্যায় দুমনিকুড়া ক্যাম্পে সমবেত করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ শেষে বান্দরকাটা বিওপি আক্রমণের চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়া হয়। আক্রমণের সময় নির্ধারিত হয় ৬ই আগস্ট ভোরে।
৫ই আগস্ট রাতেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বান্দরকাটা বিওপির আশপাশে যাঁর-যাঁর অবস্থান গ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান গ্রহণের পর থেকেই প্রবল ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টি শুরু হয়। একেতো বর্ষাকাল, তার মধ্যে আবার বিরামহীন বৃষ্টি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাহাড়ি স্রোতধারাগুলো স্ফীত হয়ে কিনার ছাপিয়ে মাঠের ওপর দিয়ে বয়ে চলা শুরু করে। বান্দরকাটা বিওপির চর্তুদিকসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষেতের উঁচু আল দেখে-দেখে সেখানে তাঁদের অবস্থানে অনড় থাকেন। রাতের শেষ প্রহরে বৃষ্টি কিছুটা কমে এলেও বাতাসের ঝাপটা অব্যাহত থাকে। এমন দুর্যোগময় অবস্থার মধ্যেই ৬ই আগস্ট ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে বান্দরকাটা বিওপি ঘেরাও করে অনবরত গুলি ছুড়তে থাকেন। এদিকে একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে আর্টিলারি সাপোর্ট অব্যাহত থাকে। দিশেহারা হয়ে পাকবাহিনীও প্রচুর গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষিপ্র গতিতে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে একেবারে বাংকারের কাছে চলে যান। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা বিওপির পেছন (দক্ষিণ) দিক দিয়ে মুন্সিরহাটের দিকে পালিয়ে যায় এবং বান্দরকাটা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। এ ভয়াবহ যুদ্ধে ১৫-২০ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত এবং ৩০-৩৫ জন আহত হয়। অপরদিকে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও ৯ জন আহত হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— আবদুল আজিজ (গোবরাকুড়া, হালুয়াঘাট), পরিমল দে (ধানশাইল, ঝিনাইগাতী), আবদুস সালাম (লামুক্তা, হালুয়াঘাট), আবুল হোসেন (মহিষলেটি, হালুয়াঘাট), রিয়াজউদ্দিন (বাহির শিমুল, হালুয়াঘাট) ও আবদুল হাকিম (ঢাকা)। আহতরা হলেন- অখিল বাতিক (সূর্যপুর, হালুয়াঘাট), লব সাংমা (সন্ধ্যাকুড়া), রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া (ঘোষগাঁও, ধোবাউড়া), আবদুস সালাম (শম্ভুগঞ্জ) প্রমুখ। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড