মুক্তিযুদ্ধে বাবুগঞ্জ উপজেলা (বরিশাল)
বাবুগঞ্জ উপজেলা (বরিশাল) বরিশাল শহরের সন্নিকটে (উত্তরদিকে) ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। বাবুগঞ্জ থানা গঠিত হয় ১৯০৬ সালে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৩ সালের ১লা ডিসেম্বর। এ উপজেলার উত্তরে গৌরনদী, দক্ষিণে বরিশাল সদর, পূর্বে মুলাদী ও বরিশাল সদর উপজেলা এবং পশ্চিমে উজিরপুর উপজেলা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এ উপজেলায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক সালাউদ্দিন কায়ছার জাতীয় পরিষদে এবং ফজলুল হক তালুকদার (ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক) প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও পাকিস্তানি সরকার আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিলে সারা দেশের ন্যায় বাবুগঞ্জের মানুষও ভীষণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পর তারা স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক এমপিএ-র সভাপতিত্বে স্থানীয় নোমরহাট বাজারে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পরবর্তী করণীয় বিষয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় উপস্থিত ছিলেন- আবদুল করিম হাওলাদার, আলতাফ হোসেন শরীফ দুলাল, আবদুর রহিম মুন্সী, সৈয়দ হারুন-অর-রশীদ ওরফে হারুন মীয়া, আবদুল কাদের খান, শাহজাহান হাওলাদার, দেলোয়ার হোসেন কবিরাজ, আবুল হোসেন সিকদার, দেলোয়ার হোসেন সিকদার, মোতাহার কবিরাজ, রমজান আলী প্রমুখ। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতাউর রহমান সিকদার (ক্ষুদ্রকাঠী)-কে সভাপতি এবং আবদুস সালাম আকন (ইদেলকাঠী)-কে সম্পাদক করে উপজেলা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— আব্দুল ওহাব খান (চাঁদপাশা), সাবেক সেনাসদস্য এবং বাবুগঞ্জ হাইস্কুলের শিক্ষক এডভোকেট আবুল কাশেম (রাজগুরু), আবদুর রহমান (চাঁদপাশা), শাহজাহান সিকদার (ক্ষুদ্রকাঠী), সুলতান মাস্টার (মাধবপাশা), আবদুল হালিম খান (আগরপুর), মো. আমির হোসেন (ক্ষুদ্রকাঠী), মিজানুর রহমান সিকদার রাজা (ক্ষুদ্রকাঠী) প্রমুখ। ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উপজেলার ছাত্রনেতারাও সংগ্রাম পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রনেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন— মিজানুর রহমান সিকদার রাজা (ক্ষুদ্রকাঠী), গোলাম মাহবুব (লোহালিয়া), নূরুল ইসলাম নূরু (কেদারপুর), এডভোকেট এমদাদুল হক খান (রহমতপুর), ফরিদ সিকদার (ক্ষুদ্রকাঠী), মোশাররফ আকন (মাধবপাশা) প্রমুখ। ২৩শে মার্চ আব্দুল ওহাব খানের নেতৃত্বে ছাত্রনেতা গোলাম মাহবুব, নূরুল ইসলাম নূরু, ফরিদ সিকদার, মিজানুর রহমান সিকদার রাজা প্রমুখ বাবুগঞ্জ থানায় পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। বাবুগঞ্জ থানা এবং পার্শ্ববর্তী বাবুগঞ্জ পাইলট হাইস্কুল ক্যাম্পে ২৭শে মার্চ থেকে ১৮ই এপ্রিল পর্যন্ত ২৩ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ চলে। থানার দারোগা ফজলুল হক, এডভোকেট আবুল কাসেম মিয়া, ইপিআর সদস্য শাহজাহান হাওলাদার (রাজকর), নূরুজ্জামান খান, আনসার কমান্ডার মান্নান খান (রাজগুরু), আনসার কমান্ডার জেয়ারউদ্দিন খলিফা (লোহালিয়া), আনসার কমান্ডার ইসমাইল (চাঁদপাশা), পুলিশ সদস্য হাবিবুর রহমান (রাজকর) প্রমুখ প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের শেরে বাংলা, তিতুমীর, সূর্যসেন প্রভৃতি ভাগে বিভক্ত করে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এছাড়া দেহেরগতি ঈশ্বর নারায়ণ হাইস্কুল, জাহাপুর হাইস্কুল (আগরপুর), চণ্ডিপুর বোর্ড স্কুল (চাঁদপাশা) এবং বায়লাখালী স্কুল মাঠেও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। বায়লাখালী স্কুল মাঠ ক্যাম্পে ইয়াকুব মাস্টার, শাহজাহান সিদ্দিকী এবং আবদুর রব মাস্টারের নেতৃত্বে আনসার কমান্ডার ইসমাইল এবং নাজেম প্রশিক্ষণ প্ৰদান করেন। ১৫ দিন পরে বায়লাখালী স্কুল ক্যাম্প চণ্ডিপুর বোর্ড স্কুলে স্থানান্তার করা হয়। আব্দুল ওহাব খানের নেতৃত্বে এখানে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মুজিবুর রহমান সরদার (ইসলামপুর), অধ্যক্ষ এ এফ এম জালাল আহমেদ, সাবেক সেনাসদস্য আব্দুল খালেক (ঠাকুরমল্লিক) এবং এডভোকেট খলিফা সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে জাহাপুর স্কুলে (আগরপুর) প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ২৬শে মার্চের পর শুরু হওয়া এ ক্যাম্পে কয়েকদিন প্রশিক্ষণ চলার পর তা ঠাকুরমল্লিক স্কুলে (আগরপুর) স্থানান্তর করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে কামন্ডার আবদুল খালেক শহীদ হলে ক্যাম্প গুটিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অন্যত্র চলে যান। জুলাই-আগস্ট মাসে আগরপুর মিয়া বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এ সকল ক্যাম্পে শুরুতে বাঁশ এবং কাঠের ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হলেও পরবর্তীতে থানা থেকে সংগৃহীত রাইফেল দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি ক্যাম্পে বাবুগঞ্জের অনেকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির বরিশাল বিভাগের সমন্বয়ক ন্যাপ নেতা ইকবাল হোসেন ফোরকান(বরিশাল জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক) ২৫শে মার্চ রাতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ-র সঙ্গে পরামর্শ করে কিছু অস্ত্র এবং ২৩ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি গ্রুপ নিয়ে ২৬শে মার্চ বিকেলে রহমতপুরস্থ বরিশাল এয়ার পোর্টের পরিত্যক্ত ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ দলে ছিলেন সাবেক সেনাসদস্য মোহাম্মদ আলী, সুলতান আলম মজনু (নতুন বাজার, বরিশাল), কে এস এ মহিউদ্দিন মানিক, বীর প্রতীক, শাহজাহান হাওলাদার (নতুন বাজার, বরিশাল), রফিকুল ইসলাম নান্নু, আলতাফ হোসেন আলতু, ঘাট শ্রমিক মো. ইসমাইল, শাহাজাহান মোস্তান, সিরাজুল ইসলাম, বরিশাল মেডিকেলের ছাত্র রতন সরকার, ক্যাপ্টেন শচীন কর্মকার, শুক্কুর বেপারী প্রমুখ। এ ক্যাম্পে ইকবাল হোসেন ফোরকান কমান্ডার এবং এডভোকেট আবুল কাশেম মিয়া ও আবদুল ওহাব খান সহকারী কমান্ডার ছিলেন। এ ক্যাম্প থেকে তাঁরা বরিশাল এয়ারপোর্ট, দোয়ারিকা, শিকারপুর ফেরিঘাট পাহারা, ঢাকা- বরিশাল মহাসড়কের ভুরঘাটা পর্যন্ত টহল এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এ কাজে বাবুগঞ্জ উপজেলা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আতাউর রহমান সিকদার, আ. সালাম আকন, আব্দুল ওহাব খান, জিয়াদুল করিম বাদশা সহায়তা করেন। ১৮ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বরিশালে বোমা হামলার পর আবদুল মজিদ সরদার (রাজগুরু)-কে এ ক্যাম্পের কমান্ডারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বরিশাল শহর দখল করা পর্যন্ত এ ক্যাম্পের কার্যক্রম চলে। পরবর্তী সময়ে এ ক্যাম্পের নেতৃবৃন্দ বানারীপাড়া উপজেলার বলহারে ক্যাম্প স্থাপন করেন। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ খান (ক্ষুদ্রকাঠী)- এর নেতৃত্বে মাধবপাশা জমিদার বাড়িতে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে স্থানীয়দের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এ-সময় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের অনুরোধে এডভোকেট আবুল কাশেমের নেতৃেত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা গৌরনদী কলেজ মাঠে ক্যাম্প স্থাপন করেন। তাঁরা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়াসহ হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে টহল দিতে থাকেন। এ বাহিনী গৌরনদীর কটকস্থলে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেয়। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত রত্তন আলী শরীফ ও সেনাবাহিনীর সদস্য নূর হোসেন হাওলাদার চাকরি ছেড়ে এলাকায় এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কমান্ডার রত্তন আলী শরীফ সশস্ত্র অবস্থায় বরিশাল বিমান বন্দরে অবস্থান নেন।
এ সময়ে ৬ ইউনিয়নের প্রতিটিতে সংগ্রাম কমিটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এসব কার্যক্রমে রহমতপুর ইউনিয়নে এডভোকেট এমদাদুল হক খান, শাহআলম সিকদার (ক্ষুদ্রকাঠী), আ. মজিদ খান, মো. আমির হোসেন (ক্ষুদ্রকাঠী), আবদুল মজিদ সরদার (রাজগুরু), আ. মালেক আকন (লোহালিয়া), ডা. সিরাজুল ইসলাম (মিরগঞ্জ); চাঁদপাশা ইউনিয়নে ফজলুল করিম হাওলাদার, আ. কাদের খান, আজিজুর রহমান সিকদার, আবদুল করিম হাওলাদার; দেহেরগতি ইউনিয়নে আমির হোসেন মাস্টার, শাহজাহান হাওলাদার; কেদারপুর ইউনিয়নে আ. মান্নান হাওলাদার, মকবুল হোসেন মৃধা, আ. জব্বার খান, শাহজাহান মানিক; আগরপুর ইউনিয়নে আবদুল হালিম খান, এডভোকেট খলিফা সাইদুর রহমান (আগরপুর), তোফেল সিকদার (আগরপুর), মজিবুর রহমান সরদার (আগরপুর), এ এফ এম জালাল আহমেদ, মুজাফফর হাওলাদার; মাধবপাশা ইউনিয়নে কেরামত মল্লিক, মোসলেম সরদার (গজালিয়া), আ. গনি আকন (লাফাদী), আফসার জমাদ্দার (পূর্ব পাংশা), কাঞ্চন সিকদার প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য আবদুল হালিম খান (আগরপুর), মুজিবুর রহমান সরদার (আগরপুর), এ এফ এম জালাল আহমেদ, মুজাফফর হাওলাদার, আবদুল বারেক সরদার, মোসলেম আলী হাওলাদার, সেকেন্দার হাওলাদার, আবুল প্যাদা, আফসার উদ্দিন মোল্লা ওরফে নাগর মোল্লা (কোলচর, চাঁদপাশা), আইয়ুব আলী হাওলাদার (কোলচর, চাঁদপাশা), আবদুল হাকিম ভূঁইয়া (গাজীপুর), শাহজাহান ফকির (গাজীপুর), আবদুল ওহাব হাওলাদার (অর্জুনমাঝি), আবদুল বারেক (অর্জুনমাঝি), আবদুস সাত্তার (বায়লাখালী), আবদুর রাজ্জাক (বায়লাখালী), মোতালেব হোসেন মন্টু (ধুমচর) প্রমুখ ভারতে যান। এ-সময় মুজিবুর রহমান সরদার (ইসলামপুর, আগরপুর) ৯ম সেক্টরের স্টোর কিপারের দায়িত্ব পালন করেন।
বাবুগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আব্দুল ওহাব খান (পিতা মো. আছমত আলী খান, দরিয়াবাদ, চাঁদপাশা) কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে আবদুল মজিদ খান (পিতা মো. ইসমাইল খান, ক্ষুদ্রকাঠী) বেইজ কমান্ডার এবং ৬ ইউনিয়নে কয়েকজন ফিল্ড কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা হলেন- সেনাসদস্য এডভোকেট মো. আবুল কাশেম (পিতা সুনাম উদ্দিন, রাজগুরু, রহমতপুর), শাহাজাহান সিকদার (রহমতপুর), আ. হালিম খান (আগরপুর), আ. কাদের খান (চাঁদপাশা), মো. রতন আলী শরীফ, বীর প্রতীক (পিতা নূর মোহাম্মদ শরীফ, রাকুদিয়া, দেহেরগতি), মো. নূর হোসেন হাওলাদার (পিতা মো. ওয়াজেদ আলী হাওলাদার, ভুতেরদিয়া, কেদারপুর) এবং সুলতান মাস্টার (পিতা ছলেমদ্দিন তালুকদার, লাফাদি, মাধবপাশা ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক এমপিএ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতাউর রহমান সিকদার, সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম আকন, আবদুল হালিম খান (আগরপুর), আবদুর রহমান, আবদুল মজিদ খান (ক্ষুদ্রকাঠী), এডভোকেট খলিফা সাইদুর রহমান, আতাহার আলী মৃধা প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বাবুগঞ্জে স্থানীয়ভাবে কোনো বিশেষ বাহিনী গড়ে ওঠেনি। তবে ৬ ইউনিয়নের কমান্ডাররা তাঁদের বাহিনীর মাধ্যমে বাবুগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন।
২৫শে এপ্রিল পাকবাহিনী স্থল ও নৌ পথে বরিশালে অনুপ্রবেশ করে। অনুপ্রবেশকালে বাবুগঞ্জ উপজেলার কমান্ডার এডভোকেট আবুল কাশেমসহ মুক্তিযোদ্ধারা গৌরনদীর কটকস্থলে তাদের প্রতিরোধ করেন। এ প্রতিরোধযুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এ-সময় বাবুগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্র-জনতা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের রাহুতকাঠী, দোয়ারিকা ফেরী ঘাট, নৌপথে ডাকাতিয়ার চর, মীরগঞ্জ বাজার এবং কমিশনার চরে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে রত্তন আলী শরীফের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে স্থানীয়দের সহযোগিতায় দোয়ারিকা ও শিকারপুর ঘাটের ফেরি ডুবিয়ে দেন। মে ও জুন মাসে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বাবুগঞ্জে . অনুপ্রবেশরোধে লাকুটিয়া ব্রিজ, রহমতপুর ব্রিজ, ছয় মাইল ব্রিজ ও হিজলার পুলে প্রতিরোধ করেন। তাঁরা ছয় মাইল ব্রিজ ধ্বংস করলে হানাদার বাহিনীর গাড়ি খাদে পড়ে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়৷
২৫শে এপ্রিল পাকবাহিনী বরিশাল শহরে অনুপ্রবেশ করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের কারণে বাবুগঞ্জে অনুপ্রবেশ করতে জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগে। তবে ঢাকা- বরিশাল মহাসড়ক বাবুগঞ্জের মধ্য দিয়ে যাওয়ায় প্রায়ই পাকবাহিনী এ মহাসড়কে যাতায়াত করত এবং মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে হানা দিত। বাবুগঞ্জে অনুপ্রবেশ করে মেজর দীন মোহাম্মদের নেতৃতে তারা বাবুগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে পাকবাহিনী বরিশাল রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল (বরিশাল ক্যাডেট কলেজ) ক্যাম্পাস ও দোয়ারিকা ফেরিঘাটে রাজাকার ক্যাম্প এবং ক্যাপ্টেন কাহারের নেতৃত্বে দোয়ারিকা ফেরী ঘাটে ক্যাম্প স্থাপন করে। তাছাড়া রাজাকর কমান্ডার খোকন বিহারীর নেতৃত্বে রহমতপুর নারকেল বাগানে ক্যাম্প স্থাপিত হয়। পাকবাহিনীকে সহায়তাদানের জন্য বাবুগঞ্জে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। মুসলিম লীগ নেতা আবদুল মতিন মাওলানা (পিতা আবদুল সিকদার, ভুতেরদিয়া, কেদারপুর) বরিশাল জেলা শান্তি কমিটির সহ- সভাপতি ছিল। সে উপজেলায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠনে ভূমিকা রাখে এবং তার নেতৃত্বে উভয় বাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধকালীন সময়ে তৎপর ছিল। আবদুল মতিন মাওলানা বরিশাল বিভাগে মুক্তিযোদ্ধা নিধনের বেসামরিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। উপজেলায় শান্তি কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- ইসরাইল ডাক্তার, জাহাঙ্গীর ডাক্তার, রশিদ সিকদার (রাজকর), কাশেম ডাক্তার (ক্ষুদ্রকাঠী) প্রমুখ।
রাজাকার কমান্ডার আবদুস সালাম (কাশীপুর)-এর নেতৃত্বে বাবুগঞ্জে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনীর সক্রিয় সদস্যরা হলো- আলী হোসেন (রাজগুরু), রহমান পেদা (রাজগুরু), তাহের আলী হাওলাদার (ক্ষুদ্রকাঠী), আবদুল আয়নাল (জাহাপুর), আ. সালাম (জাহাপুর), সরদার গোলাম কুদ্দুস (ইসলামপুর), আ. মালেক বিশ্বাস (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), আ. জব্বার বিশ্বাস (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), শাহআলম (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), মওলানা আ. বারী (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), আ. মন্নান বয়াতী (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), আ. হাকিম খান (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), মজিবুর রহমান সরদার (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), আ. ছত্তার ঘরামী (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), আ. বসার সিকদার (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), আ. বাসার সিকদার (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), আ. ছত্তার হাং (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), হোসেন চৌধুরী (সানি কেদারপুর), শহিদুল ইসলাম সিকদার (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), মাওলানা বজলুর রশীদ (পশ্চিম ভূতেরদিয়া), মাওলানা মোফাজ্জেল (পশ্চিম ভূতেরদিয়া), মাওলানা সিদ্দিকুর রহমান (পশ্চিম ভূতেরদিয়া), সিরাজুল ইসলাম (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), ইব্রাহিম (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), মুন্সী আ. হামেদ শরীফ (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), মোস্তফা বিশ্বাস (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), মোস্তফা বিশ্বাস (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), আ. করিম খান (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), আ. জব্বার খান (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), আ. আজিজ খান (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), মাওলানা শামসুল হক (পশ্চিম ভূতেরদিয়া), আ. সালাম (পশ্চিম ভূতেরদিয়া), সামসুল হক রাজ (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), মাওলানা আ. আউয়াল (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), জাহাঙ্গীর ডাক্তার (কেদারপুর), জয়নাল বিশ্বাস (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), আ. হক বিশ্বাস (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), ফরিদ বিশ্বাস (দক্ষিণ ভূতেরদিয়া), মাওলানা মাজাহার (ভূতেরদিয়া), মাওলানা ইসহাক (ভূতেরদিয়া), ইসমাইল খাঁ (পূর্ব ভূতেরদিয়া), আ. মতলেব (পূর্ব ভূতেরদিয়া), মানিক মৃধা (পূর্ব কেদারপুর), মো. হোসেন (সানী কেদারপুর), নূরু হাওলাদার (ব্রাহ্মণদিয়া), মো. হাসান কাজী (গাজীপুর), ভাসাই মোল্লা (অর্জুনমাঝি), কেরামত আলী খাঁ (মধ্য বকশিরচর), বারেক মুন্সী (বায়লাখালী), আ. মালেক মুন্সী (চণ্ডিপুর), রফিক তালুকদার (বীরপাশা, মাধবপাশা), আ. ওহাব হাওলাদার (পাংশা), মালেক তালুকদার (বীরপাশা, মাধবপাশা), নাজেম কর্মকার (ছাতিয়া), (ছাতিয়া), জয়নাল আবেদীন হাওলাদার (গোয়ালবাথান, মাধবপাশা), মকবুল বেপারী, শাহজাহান বেপারী (গোয়ালবাথান), সালাম মাঝি (গোয়ালদী), মনসুর মাঝি (গোয়লদী, মুসুরিয়া), মোশারফ হোসেন হাওলাদার (পূর্ব পাংশা), নুরুল হক মোল্লা (গজালিয়া), মো. জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার (বাদলা, মাধবপাশা), আবদুল মালেক মওদুদী (রফিয়াদী), গফ্ফার মোল্লা (কোলচর), রহমতপুরের হবিবুল্লাহ বিহারী ও তার ছেলে খোকন বিহারী প্রমুখ। এছাড়া আবদুল কুদ্দুস সিকদার (রাজকর), আ. রব সিকদার (রাজকর) প্রমুখ স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করে।
হানাদার বাহিনী বাবুগঞ্জের বিভিন স্থানে নির্যাতন, গণহত্যা, লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ চালায়। এর মধ্যে রামপট্টি গণহত্যা-রফিয়াদি গণহত্যা-বরিশাল ক্যাডেট কলেজ গণহত্যা উল্লেখযোগ্য।
বরিশালে ক্যাম্প স্থাপনের পর ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহর থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে বাবুগঞ্জ উপজেলার দেহেরগতি ইউনিয়নে প্রবেশ করে নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং গণহত্যা চালায়। এ গণহত্যায় বেচু পাল (পশ্চিম দেহেরগতি), নির্মল (পিতা রুহমিনী, দেহেরগতি) এবং শংকর কর্মকার (পিতা শরৎ কর্মকার, দেহেরগতি) শহীদ হন।
২রা জুন বরিশাল থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা গাড়িতে করে ২০ কিমি উত্তর দিকের বাবুগঞ্জ বাজারে প্রবেশ করে। আগের দিন মুক্তিযোদ্ধারা রহমতপুর নারকেল বাগানে বিহারিদের ক্যাম্প আক্রমণ করেন। প্রতিশোধ নিতে পরের দিন বিহারিদের নেতা নিজাম এবং সফিউল্লাহ পাকিস্তানিদের পথ দেখিয়ে বাজারে নিয়ে আসে। বাজারে প্রবেশ করেই হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। একই সঙ্গে তারা বাজারে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। দিনটি হাটবার হওয়ায় দূর-দূরান্তের অনেক মানুষ তাদের নির্যাতনের শিকার হয়। এ-সময় কাদের মৌলবির বাড়ির পুকুরের ঘাটলার নিচে পালিয়ে থাকা সন্তোষ পাল (৪২) (পিতা উমাচরণ পাল, বাবুগঞ্জ বন্দর) এবং বাজারের পশ্চিম মাথায় রামজয় পাল (৪০) (পিতা হরকুমার পাল, বাবুগঞ্জ বন্দর) পাকবাহিনীর হাতে নিহত হন। শহীদ সন্তোষ পালের ভাই পরিতোষ পালকে ধরে থানায় নিয়ে পাকসেনারা নির্যাতন করে। কলেমা পাঠ করে তিনি আহত অবস্থায় বেঁচে যান।
ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বাবুগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত রহমতপুর বিমানবন্দর থেকে পশ্চিম দিকে নিভৃত এক হিন্দু প্রধান গ্রাম রামপট্টি। ২৯শে এপ্রিল দুপুরে পাকিস্তানি সৈন্যরা দেহেরগতির রাজাকার কাঞ্চন হাওলাদার ও তার সঙ্গীদের সহায়তায় রামপট্টি গ্রামে প্রবেশ করে গণহত্যা, লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ চালায়। এ গণহত্যায় মজুমদার বাড়ির ৩ ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার, বীরেন মজুমদার, অনন্ত মজুমদারসহ বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী শহীদ হন। গণহত্যার পর স্থানীয়রা শহীদদের লাশ একটি গণকবরে সমাহিত করে।
বাবুগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলার সীমানায় আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরবর্তী চাঁদপাশা ইউনিয়নের রফিয়াদি গ্রামে ২১শে জুন সকাল ১০টার দিকে বাবুগঞ্জ হাইস্কুল ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সিংহেরকাঠী গ্রামে প্রবেশ করে। তারা সিংহেরকাঠী গ্রামের হিন্দুপাড়ার রাখাল হালদার, আশুতোষ রায়, হীরালাল রায়, মতিলাল করাতি ও ললিত করাতির বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। দেবু বেপারী নামে এক যুবককে ধরে মারধর করলে তিনি হানাদার বাহিনীকে কলেমা শুনিয়ে বেঁচে যান। হানাদাররা এ-সময় ধানক্ষেতে কর্মরত কয়েকজন দিনমজুর এবং একজন নৌকার মাঝিকে আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। গণহত্যার স্থান নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। জুলাই মাসের প্রথম দিকে বরিশাল থেকে ছাত্রনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ থানা আক্রমণের জন্য বাবুগঞ্জ আসেন। রাজাকাররা এ খবর জানতে পেরে থানা-পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ রাজাকারদের সহায়তায় রাজকর গ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান রাজা, সৈদয় নজরুল ইসলাম, সৈয়দ আলমগীর ও কৃষ্ণকে আটক করেন। আটকের পর তাদেরকে বরিশালে হানাদারবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স ওয়াপদা কলোনিতে নিয়ে যায়। দুদিন পর মিজানুর রহমান রাজা মুক্তি পান। পরবর্তী সময় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সৈয়দ আলমগীর ও কৃষ্ণ হানাদারবাহিনীর হাতে শহীদ হন। বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নের প্রতাপপুর গ্রামে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পূর্ব পাশে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল (বরিশাল ক্যাডেট কলেজ) অবস্থিত। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্বল্প সময়ের জন্য এখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। ৫ই সেপ্টেম্বর স্থানীয় রাজাকার ওহাব হাওলাদার, নাজেম কর্মকার, হাসেম বেপারী, নুরু প্রমুখের দেয়া তথ্য অনুযায়ী তারা এখানে মোহনগঞ্জের হাটের দিন চাঁদপাশা, দেহেরগতি, রহমতপুর, প্রতাপপুর, পাংশাসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন ধরে এনে গণহত্যা চালায়। এ গণহত্যায় শতাধিক মানুষ শহীদ হন।
২১শে সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদর বাহিনী বাবুগঞ্জ পাইলট হাই স্কুল ক্যাম্প থেকে ৪ কিমি দক্ষিণে চাঁদপাশায় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব খানের ঘাঁটি আক্রমণ করতে যায়। পথিমধ্যে তারা রাঢ়ী বাড়ি এলাকায় গণহত্যা, লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ করে। এ গণহত্যায় মোবারক আলী রাঢ়ী (পিতা কালু রাঢ়ী, চাঁদপাশা), করিম কারিকর (পিতা কফিলউদ্দীন কারিকর, চাঁদপাশা) ও কাশেম ঘরামী (চাঁদপাশা) শহীদ হন।
বাবুগঞ্জ বাজার লুটপাটের জিনিসপত্র রাজাকার কমান্ডার জাহাঙ্গীর ডাক্তারের কেদারপুরের বাড়িতে নিয়ে মজুদ করলে স্থানীয় লোকজন তা জানতে পারে। কেউ-কেউ জাহাঙ্গীর ডাক্তারের এ লুটপাট নিয়ে প্রশ্ন করে। এর প্রতিশোধ নিতে ২৮শে সেপ্টেম্বর রাজাকার কমান্ডার জাহাঙ্গীর ডাক্তার পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তায় বাবুগঞ্জ বাজার থেকে ২ কিমি দূরে নয়ারচর গ্রাম আক্রমণ করে লুণ্ঠন এবং গণহত্যা চালায়। এ-সময় নয়ারচর গ্রামে কর্মরত দুজন কাঠমিস্ত্রি বীরেন্দ্রনাথ মণ্ডল (পিতা রাজেন্দ্র মণ্ডল, বোয়ালিয়া) এবং সুরেন্দ্রনাথ মিস্ত্রি (পিতা সর্বানন্দ মিস্ত্রি, দক্ষিণ ভূতেরদিয়া) তাদের হাতে শহীদ হন। এদিন তারা বোয়ালিয়ার সরজু এবং লক্ষ্মী মণ্ডল নামে দুজন নারীকে বাবুগঞ্জ ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উদ্ধার করেন। জুন মাসে স্থানীয় রাজাকার রাজুর নেতৃেত্বে পাকবাহিনী রহমতপুর ব্রিজের ওপর মোকসেদ (পিতা কাদের সোবাহান, গুদিঘাটা, ডিক্রিরচর, চাঁদপাশা)-কে হত্যা করে। আগস্ট মাসে তারা মোজাহার হাওলাদার (পিতা ছুটু হাওলাদার, পশ্চিম ভূতেরদিয়া), আ. ছত্তার ঘরামী (পিতা মিলন ঘরামী, দক্ষিণ ভূতেরদিয়া)-কে হত্যা করা হয়।
পাকিস্তানি বাহিনী জুন মাসে ন্যাপ নেতা মুক্তিযোদ্ধা আ. গফুর মোল্লার বাড়ি (কোলচর), নোমরহাট বাজার, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব খানের বাড়ি, বায়লাখালী গ্রামের অনেকগুলো বাড়ি, চাঁদপাশা চৌধুরী বাড়ি, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আতাউর রহমান সিকদারের বাড়ি (ক্ষুদ্রকাঠী), লোহালিয়ার আমজাদ খানের বাড়ি, রাজকর গ্রামের ইপিআর সদস্য আ. ছত্তার সিকদারের বাড়ি, মাধবপাশা ইউনিয়নের শোলনা ও আন্দিরপাড় গ্রামের অনেকগুলো বাড়ি, আফসার জমাদ্দারের বাড়িতে লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ করে। তারা লাশঘাটা গ্রামের কার্তিক কর্মকারের বাড়ি, রফিয়াদি গ্রামের আবদুল মজিদ হাওলাদারের বাড়ি ও মিরগঞ্জ বাজার লুণ্ঠন করে।
এছাড়া বাবুগঞ্জ উপজেলার অনেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাদের মধ্যে রয়েছেন— মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ- (পিতা আবদুল মোতালেব হাওলাদার, রহিমগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, বরিশাল; সাব- সেক্টর কমান্ডার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী; ১৪ই ডিসেম্বর সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী (পিতা রাইচরণ অধিকারী, বাবুগঞ্জ বন্দর; ৩০শে এপ্রিল কারমাইকেল কলেজ, রংপুরে শহীদ), মুহাম্মদ সিরাজুল হক (ভুতেরদিয়া; জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা; যশোরে কর্মরত অবস্থায় ২৫শে মার্চ শহীদ), পুলিশ সদস্য হাসান হাওলাদার (পিতা রজ্জব আলী হাওলাদার, রফিয়াদি, চাঁদপাশা; যশোর পুলিশ লাইন্সে শহীদ), ইপিআর সদস্য রাজ্জাক হাওলাদার (দেহেরগতি; কুমিল্লা সীমান্ত যুদ্ধে শহীদ), নায়েক মোসলেমউদ্দিন (বাহেরচর ক্ষুদ্রকাঠী; যশোর সীমান্ত যুদ্ধে শহীদ), ইপিআর সদস্য আবদুল (দেহেরগতি), নায়েক কাজী মকবুল হোসেন (পাংশা, মাধবপাশা; কুমিল্লা সেনানীবাসে শহীদ), ইপিআর সদস্য আশ্রাব আলী মিয়া (রংপুর সেনানীবাসে শহীদ), হাবিবুর রহমান (রামপট্টি, রহমতপুর), শশী কুমার শীল, (রামপট্টি, রহমতপুর), হাতেম আলী, (রামপট্টি, রহমতপুর), মনসুর (মুসুরিয়া, মাধবপাশা), বিহারী লাল দাস (রহমতপুর), সৈয়দ আবদুর রব (রাকুদিয়া, দেহেরগতি), মানিক লাল দত্ত (চাচৈরপাশা, দেহেরগতি), মাজেদ হাওলাদার (রাহুতকাঠী, দেহেরগতি), নুরুল ইসলাম (পূর্ব রহমতপুর), সেলিম (ছাতিয়া, মাধবপাশা), মৃণাল কুমার দাস (পিতা মাখনলাল দাস, রহমতপুর; কলসকাঠী গণহত্যায় শহীদ), রাজ্জাক চৌধুরী (পিতা আসমত আলী, চণ্ডিপুর, চাঁদপাশা), মাজেদ ফকির, বকশিরচর, চাঁদপাশা), মজিদ চৌধুরী (পিতা রহিম চৌধুরী, বকশিরচর, চাঁদপাশা), মোহাম্মদ রাঢ়ী (ছমেরউদ্দিন রাঢ়ী, কালিকাপুর, চাঁদপাশা), শচীন্দ্রলাল পাল, দোয়ারিকা, দেহেরগতি), মোসলেম বেপারী (ছাতিয়া, মাধবপাশা), হাবিলদার আবুল হোসেন (মহিষাদি, মাধবপাশা; ৩রা ডিসেম্বর, দোয়ারিকা যুদ্ধে শহীদ), আ. রশিদ, রাকুদিয়া; ৩রা ডিসেম্বর দোয়ারিকা যুদ্ধে শহীদ), মোকলেসুর সিকদার রতন (পিতা মতিউর রহমান সিকদার, ক্ষুদ্রকাঠী, রহমতপুর; গুঠিয়া গণহত্যায় শহীদ), আবদুল করিম হাওলাদার (পিতা কদম আলী হাওলাদার, লোহালিয়া, রহমতপুর), আবদুল ওহাব আলী হাওলাদার (পিতা রজ্জব আলী হাওলাদার, চণ্ডিপুর, চাঁদপাশা), আবদুল করিম কারিকর (পিতা কফিলউদ্দিন মুন্সী, চাঁদপাশা), সিরাজউদ্দিন হাওলাদার (পিতা তমিজউদ্দিন হাওলাদার, কালিকাপুর, চাঁদপাশা), ফজলে আলী নলী (পিতা সফরউদ্দিন নলী, রাজগুরু, রহমতপুর), মাজেদ মোল্লা (পিতা ফটিক মোল্লা, ভবানীপুর, চাঁদপাশা), মফেজউদ্দিন ঢালী (পিতা আদু ঢালী, আরজীকালিকাপুর, চাঁদপাশা), মিনহাজউদ্দিন হাওলাদার, পিতা মইজুদ্দিন হাওলাদার, আরজীকালিকাপুর), হাশেম হাওলাদার (পিতা মোয়াজ্জেম হাওলাদার, কালিকাপুর, চাঁদপাশা), শাহজাহান (পিতা রাজে আলী চৌকিদার, চরআলগী, আগরপুর), পুলিশ সদস্য রহমান আলী হাওলাদার (পিতা শাহাদত আলী হাওলাদার, দক্ষিণ রাকুদিয়া, দেহেরগতি), পুলিশ সদস্য হারুন-অর-রশিদ (পিতা সফিউদ্দিন হাওলাদার, খানপুর, রহমতপুর; ২৬শে মার্চ ঢাকায় শহীদ) প্রমুখ। রাজাকার কাঞ্চন (দেহেরগতি)-এর হত্যা, অত্যাচার ও নির্যাতনের ঘটনায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা দারুণ ক্ষিপ্ত হন। রত্তন শরীফের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সেপ্টেম্বর মাসে তাকে হত্যা করে।
বাবুগঞ্জ পাইলট হাইস্কুল, রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ, দোয়ারিকা ফেরিঘাট ক্যাম্প, রাজাকার খোকন বিহারীর নারকেল বাগান ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এ-সকল নির্যাতনকেন্দ্রে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন ধরে এনে নির্যাতন, হত্যা এবং বন্দিদের নিকট থেকে চাঁদা আদায় করত। স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় তারা বিভিন্ন এলাকার নারীদের ধরে এনে এসব ক্যাম্পে নির্যাতন করত। ৮ই ডিসেম্বর বাবুগঞ্জ পাইলট হাইস্কুল থেকে পাকবাহিনী পালিয়ে গেলে সেখান থেকে বিবস্ত্র অবস্থায় কয়েকজন নারীকে উদ্ধার করা হয়।
বাবুগঞ্জ উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকটি বধ্যভূমি এবং গণকবর রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে বরিশাল ক্যাডেট কলেজ বধ্যভূমি- এবং রহমতপুর বিমান বন্দর থেকে পশ্চিম দিকের হিন্দুপ্রধান রামপট্টি গ্রামে হালদার বাড়ি দিঘিরপাড় বধ্যভূমি উল্লেখযোগ্য। ২৯শে এপ্রিল রামপট্টি গ্রামে হালদার বাড়ি দিঘিরপাড় বধ্যভূমিতে তারা গণহত্যা সংঘটিত করে।
বরিশাল ক্যাডেট কলেজ (রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল) ছিল হানাদার বাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমি। সুরক্ষিত এ স্থানে পাকবাহিনী সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে কয়েকদিন অবস্থান করে আশপাশের গ্রাম থেকে শতাধিক মানুষকে ধরে আনে। ক্যাডেট কলেজের পেছন দিকে একটি পুকুর পাড়ে এসব হতভাগ্যদের গুলি করে ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে, যাদের বেশির ভাগ ছিল পাংশা, মেহেন্দিগঞ্জ, প্রতাপপুরসহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দা। ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর ক্যাডেট কলেজের ডোবায় বহু মানুষের হাড়গোড় ও মাথার খুলি পাওয়া যায়।
রামপট্টি গ্রামে গণহত্যায় শহীদদের একটি গণকবর রয়েছে। এ গণকবরে শহীদ রাখাল হালদার (২৫) (পিতা বসন্ত কুমার হালদার), রাজকুমার হালদার (৫৫) (পিতা প্রসন্ন কুমার হালদার), হরিচরণ বেপারী (৬৫) (পিতা নবীন বেপারী), মনোরঞ্জন বেপারী (পিতা হরিচরণ বেপারী), তারিণী মজুমদার (৫০) (পিতা গঙ্গাচরণ মজুমদার), বীরেন মজুমদার (৪৫) (পিতা গঙ্গাচরণ মজুমদার) ও অনন্ত মজুমদার (৪২) (পিতা গঙ্গাচরণ মজুমদার)-কে সমাহিত করা হয়। এরা সবাই রামপট্টি গ্রামের অধিবাসী। রামপট্টি গণকবরটি পাকা করা হয়েছে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো যুদ্ধ, অপারেশন এবং সংঘর্ষ হয়। সেগুলোর মধ্যে লাকুটিয়া বাজার যুদ্ধ, রাজাকার খোকন বিহারির নারকেল বাগান ক্যাম্প আক্রমণ, রাকুদিয়ার কুমার বাড়ি অপারেশন, দোয়ারিকা ফেরিঘাট যুদ্ধ- এবং বাবুগঞ্জ থানা আক্রমণ- উল্লেখযোগ্য।
৫ই মে লাকুটিয়ায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৭ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কমান্ডার আব্দুল ওহাব খান এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
৩০শে মে পাকবাহিনী ১০ ট্রাক অস্ত্র বোঝাই করে ঢাকা থেকে বরিশাল ও পটুয়াখালী রওনা দেয়। পথিমধ্যে দোয়ারিকা ফেরি ঘাটে এডভোকেট আবুল কাশেম এবং রত্তন আলী শরীফের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর ট্রাকের ওপর আক্রমণ চালান। আক্রমণে হানাদারদের ৩টি সামরিক যান ধ্বংস হয় এবং বাধ্য হয়ে তারা পালিয়ে গৌরনদী চলে যায়।
পাকিস্তানি বাহিনীর বরিশাল দখলের পর স্থানীয় বিহারিদের অত্যাচারের মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এমনিভাবে রাজাকার কমান্ডার খোকন বিহারির অত্যাচারে রহমতপুর এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তার নারকেল বাগান ক্যাম্প একটি নির্যাতনকেন্দ্রে পরিণত হয়। ২রা জুলাই বলহার ক্যাম্প থেকে ইকবাল হোসেন ফোরকান এবং চাঁদপাশা থেকে আব্দুল ওহাব খানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর একটি দল রাজাকার খোকন বিহারির নারকেল বাগান ক্যাম্প আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের এ আক্রমণে রাজাকার খোকন বিহারি, একজন পাকিস্তানি সৈন্য এবং ২ জন মহিলা নিহত হয়। এ-সময় বিহারিদের পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন ফোরকান, মফেজ ঢালী (চাঁদপাশা), আবদুল লতিফ (চাঁদপাশা) এবং সৈয়দ সুলতান আহমেদ (লাকুটিয়া) আহত হন।
কমান্ডার রত্তন আলী শরীফের নেতৃত্বে এডভোকেট আবুল কাশেম, আমির হোসেন মাস্টার প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাকুদিয়ার কুমারবাড়ি অপারেশনে নেতৃত্ব দেন। এ অপারেশনে ১১ জন রাজাকার নিহত হয়। জুলাই মাসের প্রথমদিকে কমান্ডার এডভোকেট আবুল কাশেম, আ. মজিদ খান, রত্তন আলী শরীফ প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দোয়ারিকা ঘাটের পশ্চিম পাড়ের রাজাকারদের ঘাঁটি আক্রমণ করে তাদের বহু অস্ত্র হস্তগত করেন। ২৭শে জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা দোয়ারিকা ঘাটের পূর্ব পাড়ের রাজাকার ঘাঁটি দখল করেন। ৩রা ডিসেম্বর মো. রত্তন আলী শরীফের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দোয়ারিকা ফেরিঘাটে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন। এ-যুদ্ধে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং মো. রত্তন আলী শরীফ, বীর প্রতীক আহত হন।
১৪ই জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা বাবুগঞ্জ থানা আক্রমণ করেন। কমান্ডার আব্দুল ওহাব খান, এডভোকেট আবুল কাশেম এবং কে এস এ মহিউদ্দিন মানিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত বাহিনী তিনদিক থেকে আক্রমণ করে। ৩রা অক্টোবর ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় বাবুগঞ্জ থানা আক্রমণ করেন। এ- যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন, বীর বিক্রম (উজিরপুর) শহীদ হন।
কমান্ডার আবদুল মজিদ খানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল দুর্গাসাগর এলাকায় মাধবপাশা জমিদার বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। বরিশাল শহর থেকে হানাদার বাহিনী অস্ত্র নিয়ে বানারীপাড়ায় আসা-যাওয়া করত। কমান্ডার আবদুল মজিদ খান তাঁর দলটি নিয়ে দুর্গাসাগরের পশ্চিম পাশে গুঠিয়ার পুলে কয়েকবার হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করেন। কমান্ডার নূর হোসেন হাওলাদার (নূরু কমান্ডার) আগরপুর মিয়া বাড়ির নিকট বাড়ুইজ্জা বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এখান থেকে এ দলটি কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করে।
কমান্ডার সুলতান মাস্টার, কমান্ডার নূর হোসেন হাওলাদার (নূরু কমান্ডার), কমান্ডার এডভোকেট আবুল কাশেম, কমান্ডার আব্দুল ওহাব খান প্রমুখ মুলাদী, মেহেন্দিগঞ্জ, বরিশাল সদর, উজিরপুর ও গৌরনদী উপজেলার বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
৮ই ডিসেম্বর বাবুগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। বাবুগঞ্জ উপজেলাসহ বরিশাল জেলা থেকে হানাদার বাহিনী গোপনে রাতের অন্ধকারে ৮ই ডিসেম্বর পালিয়ে গেলেও তাদের একটি দল ক্যাপ্টেন কাহারের নেতৃত্বে দোয়ারিকা ফেরিঘাট ক্যাম্পে আটকা পড়ে। নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ-র নিকট ক্যাম্পের ইনচার্জ ক্যাপ্টেন কাহার আত্মসমর্পণের কথা জানায়। ১৯শে ডিসেম্বর নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ, ক্যাপ্টেন মাহফুজুল আলম বেগ, এডভোকেট আবুল কাশেম প্রমুখের নিকট হানাদারদের এ বাহিনীর ৪২ জন পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর তাদের বরিশালে নিয়ে যাওয়া হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ- (পিতা আব্দুল মোতালেব হাওলাদার, রহিমগঞ্জ), মো. রত্তন আলী শরীফ, বীর প্রতীক (পিতা নূর মোহাম্মদ শরীফ, রাকুদিয়া) ও দফাদার আবদুল মান্নান, বীর প্রতীক – (পিতা আমিনুদ্দিন ফরাজী, ঠাকুর মল্লিক)।
বাবুগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (১৪ই ডিসেম্বর সম্মুখ যুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শহীদ), অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী (পিতা হরেকৃষ্ণ অধিকারী, বাবুগঞ্জ বন্দর; রংপুর কার মাইকেল কলেজের অধ্যাপক; কলেজ হোস্টেল থেকে ধরে নিয়ে পাকবাহিনী হত্যা করে), শাহজাহান (চরআলগী; বাকেরগঞ্জ থানা দখলের সময় পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ), সিপাহি হাসান মাহমুদ (পিতা রজ্জব আলী হাওলাদার, রফিয়াদি; যশোর পুলিশ লাইন্স প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ), মোসলেম উদ্দিন (বাহেরচর ক্ষুদ্রকাঠী; যশোর সীমান্তে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), ইপিআর সদস্য আবদুল আলী (দেহেরগতি), নায়েক কাজী মকবুল হোসেন (পাংশা; কুমিল্লা সেনানিবাসে শহীদ), ইপিআর আশ্রাব আলী মিয়া (রংপুর সেনানিবাসে শহীদ), হাবিবুর রহমান (রাজকার), হাতেম আলী (রামপট্টি), বিহারী লাল দাস (রহমতপুর), সৈয়দ আবদুর রব (রাকুদিয়া), মাজেদ হাওলাদার (রাহুতকাঠী), নূরুল ইসলাম (পূর্ব রহমতপুর), সেলিম আহমেদ (ছাতিয়া), রাজ্জাক চৌধুরী (চণ্ডিপুর), মাজেদ ফকির (বখশির চর), মজিদ চৌধুরী (বখশির চর), মাজেদ মোল্লা (পিতা ফটিক মোল্লা, ভবানীপুর), মো. মোবারক রাঢ়ী (কালিকাপুর), সতীন্দ্র লাল পাল (দেহেরগতি), মোসলেম বেপারী (ছাতিয়া), হাবিলদার আবু হোসেন (মহিষাদি, দোয়ারিকা), আব্দুল ওহাব হাওলাদার (চণ্ডিপুর), সিরাজ উদ্দিন হাওলাদার (কালিকাপুর) এবং মফেজ ঢালী (পিতা আদু ঢালী, আরজীকালিকাপুর)। বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নামানুসারে তাঁর জন্মস্থান আগরপুর ইউনিয়নের নামকরণ করা হয়েছে ‘জাহাঙ্গীরনগর’। তাঁর নিজ গ্রাম রহিমগঞ্জে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’। ঐ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে “শহীদ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর (বীরশ্রেষ্ঠ) স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ এবং ‘বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর মহাবিদ্যালয়’। বাবুগঞ্জ সুগন্ধা নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজের নামকরণ করা হয়েছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু’ এবং সেতু এলাকায় ‘বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের প্রতিকৃতি’ স্থাপন করা হয়েছে। বাবুগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। দেহেরগতি ইউনিয়নের নতুনহাট এলাকায় একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘মুক্তিযোদ্ধা মুচুয়া শাজাহান সড়ক’। রহমতপুর ব্রিজ থেকে বাজার পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘কমান্ডার শাহজাহান সিকদার সড়ক’। আগরপুর কলেজ থেকে জাহাপুর পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম কিবরিয়া টিপু সড়ক’। মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা)-র দেহেরগতির গ্রামের বাড়ির প্রবেশ মুখে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহেল রানা গেট’ নির্মাণ করা হয়েছে। উপজেলা চত্বরে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব খানের কবর পাকা করা হয়েছে। রামপট্টি গ্রাম গণহত্যায় ৯ জন শহীদের গণকবর পাকা করা হয়েছে। [মো. আবুল কাশেম ও মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড