You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাদামতলা গণহত্যা (বটিয়াঘাটা, খুলনা)

বাদামতলা গণহত্যা (বটিয়াঘাটা, খুলনা) সংঘটিত হয় ১৯শে মে। এতে ৫০ জনের মতো সাধারণ মানুষ শহীদ হন। বটিয়াঘাটা উপজেলা নদীবেষ্টিত একটি জনপদ। ১৯৭১ সালে খুলনা জেলা শহরের সঙ্গে বটিয়াঘাটা থানার কোনো সড়ক যোগাযোগ ছিল না। নদীপথই ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথমদিকে এখানকার মানুষ, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এ অঞ্চলটিকে খানিকটা নিরাপদ আশ্রয় মনে করত। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে মাস দেড়েকের মতো এ উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের মানুষ সংগঠিত হয়ে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা বজায় রেখে বসবাস করতে থাকে। আশপাশের কিছু এলাকা পাকবাহিনী ও রাজাকারদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় ঐসব অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বটিয়াঘাটাকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ভেবে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তাছাড়া বটিয়াঘাটা উপজেলার পূর্বদিক দিয়ে প্রবাহিত কাজীবাছা নদী দিয়ে খড়িয়া হয়ে পশ্চিমে শালতা নদীতে পৌঁছানোর জন্য সময় কম ও সহজে যাওয়া যেত বিধায় এ অঞ্চলটি ভারতে যাওয়ার নির্ভরযোগ্য নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। খুলনা, বাগেরহাট ও বরিশালের কিছু অংশের মানুষ এই নৌপথ নিরাপদ ভেবে এই পথে ভারতে পাড়ি জমাত। ১৭ই মে পাকবাহিনীর দোসর –মুসলিম লীগ-এর সদস্য ও রাজাকার বাহিনী হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করে। তখন এ সকল অঞ্চল আর নিরাপদ নয় ভেবে সেখানকার মানুষ ১৮ই মে একযোগে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯শে মে ফুলতলা, দেবীতলা ও বাদামতলা গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়। তার আগে থেকেই বাদামতলা বাজারে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী অবস্থান করছিল। সেদিন পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা গুলি করতে-করতে কাজীবাছা নদীর তীরে ফুলতলা গ্রামে প্রবেশ করে। সেখান থেকে তারা দেবীতলা গ্রাম হয়ে বাদামতলা বাজারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। শরণার্থী এবং স্থানীয় লোকজন যে যেদিকে পারছিল ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌড়াচ্ছিল। বাদামতলা বাজারের কাছে কোরাবুনিয়া খাল পার হওয়ার জন্য একটি বাঁশের সাঁকো ছিল। অনেক লোক একসঙ্গে তাড়াহুড়ো করে পার হতে গিয়ে সাঁকো ভেঙ্গে পড়ে। তখন খাল সাঁতরে তীরে ওঠা মানুষগুলোর ভেতর থেকে পুরুষদের পাকিস্তানি সেনারা ধরে এনে এক জায়গায় জড়ো করে। এছাড়া আশপাশের আরো অনেক মানুষকে ধরে এনে বাদামতলা বাজার সংলগ্ন বসুরাবাদ বিলের নলিয়ার ভিটায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি চালায়। গুলি খেয়ে অনেকেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কেউ দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। সেদিন এখানে ৫০ জনের মতো মানুষকে হত্যা করা হয়। বটিয়াঘাটার স্থানীয় লোকজনের পরিচয় জানা গেলেও অন্যান্য স্থান থেকে আসা মানুষজনের পরিচয় জানা যায়নি। বাদামতলা গণহত্যায় যারা নিহত হন, তাদের মধ্যে যাদের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন— নীলকমল রায় (পিতা কিনুরাম রায়, ফুলতলা, বটিয়াঘাটা), গীতাঞ্জলি বিশ্বাস (পিতা সুশীল বিশ্বাস, ফুলতলা, বটিয়াঘাটা), দিনেশ চন্দ্র বিশ্বাস (পিতা সুশীল বিশ্বাস, ফুলতলা, বটিয়াঘাটা), অমূল্য কৃষ্ণ রায় (পিতা নীলকণ্ঠ রায়, ফুলতলা, বটিয়াঘাটা), মনোরমা রায় (স্বামী অমূল্য কৃষ্ণ রায়, ফুলতলা, বটিয়াঘাটা), দেবদাস গোলদার ঘ (পিতা সুরেশ গোলদার, ফুলতলা, বটিয়াঘাটা), রাজেন্দ্রনাথ মণ্ডল (ফুলতলা, বটিয়াঘাটা), নিতাই চন্দ্ৰ মণ্ডল (পিতা অর্জুন মণ্ডল, দেবীতলা, গঙ্গারামপুর), উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস (পিতা কান্তরাম বিশ্বাস, দেবীতলা, গঙ্গারামপুর), মাধব বৈরাগী (পিতা জলধর বৈরাগী, বানরগাতী, খুলনা), সৌরভী গোলদার (পিতা নকুল গোলদার, বানরগাতী, খুলনা), মনোহর মণ্ডল (দেবীতলা, গঙ্গারামপুর), মান্দার চন্দ্র ঢালী (পিতা দ্বারিক ঢালী, দেবীতলা, গঙ্গারামপুর), বলরাম মণ্ডল (পিতা অক্ষয় মণ্ডল, ওয়ারভাঙ্গা, গঙ্গারামপুর), কুঞ্জবিহারী মণ্ডল (পিতা কালিবর মণ্ডল, দেবীতলা, গঙ্গারামপুর), নির্মল মণ্ডল (পিতা কালিবর মণ্ডল, দেবীতলা, গঙ্গারামপুর), হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল (পিতা যজ্ঞেশ্বর মণ্ডল, দেবীতলা, গঙ্গারামপুর), পার্বতী মণ্ডল (পিতা নটবর মণ্ডল, দেবীতলা, গঙ্গারামপুর), সাহেব ঠাকুর (ফুলতলা), বীরেন্দ্রনাথ তরফদার (পিতা মহারাজ তরফদার, বসুরাবাদ, বটিয়াঘাটা), সত্যরাম মজুমদার (পিতা প্রসন্ন মজুমদার, দক্ষিণ রাঙ্গেমারী, জলমা), দেবেন্দ্রনাথ বিশ্বাস (পিতা কেদার চন্দ্র বিশ্বাস, দক্ষিণ রাঙ্গেমারী, জলমা), ইন্দুভূষণ রায়চৌধুরী (পিতা নটবর রায়চৌধুরী, জলমা) এবং সামসুর রহমান (গাওঘরা, সুরখালী)। গণহত্যার স্থানে ১৯৭১ : “ গণহত্যানির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেছে। [শংকর কুমার মল্লিক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!