You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বানারীপাড়া উপজেলা (বরিশাল)

বানারীপাড়া উপজেলা (বরিশাল) ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে সারা দেশের মানুষের মতো বানারীপাড়ার মানুষও এই ভেবে আশান্বিত হয় যে, বাঙালিরা এবার শাসন ক্ষমতা হাতে পাবে। বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের দীর্ঘদিনের শাসন- শোষণ আর বঞ্চনার অবসান ঘটবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো মিলে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিতে চায়নি। তাই নানাভাবে কালক্ষেপণ করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ করে ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এর প্রতিবাদে ২রা মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের পরিচালনায় বানারীপাড়ায়ও আন্দোলন চরমে ওঠে। আন্দোলনকে সুসংহত করার জন্য একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এমন একটি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চের ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণ থেকে জনগণ ভবিষ্যৎ মুক্তিযুদ্ধের ইঙ্গিত পায় এবং তাতে অংশগ্রহণেনসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকসেনাদের নৃশংস অপারেশন সার্চলাইট-এর পর ২৭শে মার্চ সকালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাংবাদিক গোলাম সারোয়ার নিজগ্রাম বানারীপাড়ায় ফিরে আসেন। তাঁর কাছ থেকে ঢাকার ভয়াবহ পরিস্থিতির খবর শুনে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ২২°৫২′ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন বেণীলাল দাশগুপ্ত (গাভা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং ভাসানী ন্যাপের সদস্য)। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিমল কৃষ্ণ দাস, মোসলেম (রাজ্জাকপুর), কেশব চন্দ্ৰ দাস, হায়দার আলী খাঁ, এনায়েত হোসেন, মজিবুর রহমান, গোলাম সালেহ, মজিবুল হক, আব্দুল কাদের প্রমুখ। এঁদের পরামর্শে স্থানীয় যুবকরা সংঘবদ্ধ হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। প্রশিক্ষণ চলে চৌধুরী বাড়ি মাঠ, গাভা হাইস্কুল মাঠ প্রভৃতি স্থানে। প্রশিক্ষণ দেন বানারীপাড়া থানার ওসি নজরুল (পরে সে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দলে যোগ দেয়)। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বেণীলালের নেতৃত্বে মোসলেম মল্লিকের বাড়িতে বসে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। আলতা, গাভা, রামচরণপুর, রাণীবাড়ি, বাইশারি, সৈয়দকাঠি প্রভৃতি এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করা হয় এবং আলতা-রাণীবাড়িতে স্থাপিত ক্যাম্পে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ল্যান্স নায়েক লোকমান ও পুলিশ সদস্য আব্দুর রশীদ বেপারী (রাজ্জাকপুর, পরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন) প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এদিকে বেণীলাল তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন অনুসারীকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পৃথক দল গঠন করেন এবং তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তাঁর দলের হয়ে শোভা রাণী মণ্ডল – এবং বীথিকা বিশ্বাস নামে দুজন নারী মুক্তিযোদ্ধাও প্রশিক্ষণ নেন। পরে তাঁরা সিরাজ সিকদারের দলের সদস্য হিসেবে বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। পার্শ্ববর্তী জম্বুদ্বীপে পাকবাহিনীর গানবোট আক্রমণে শোভা রাণী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গ এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর, বীর উত্তম এবং বেণীলাল দাশগুপ্ত।
২৫শে এপ্রিল বরিশাল দখলের পর মে মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী বানারীপাড়ায় প্রবেশ করে এবং বানারীপাড়া থানা, বানারীপাড়া ভূমি অফিস, বানারীপাড়া হাইস্কুল, বানারীপাড়া গার্লস স্কুলের সামনের একটি বাড়ি এবং বানারীপাড়া বাজারের সাহাবাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। এর মধ্যে স্থায়ী-অস্থায়ী দু-ধরনের ক্যাম্পই ছিল।
বানারীপাড়ায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী সক্রিয় ছিল। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল রজ্জব আলী মিয়া এবং রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিল কমান্ডার আবদুল আজিজ। এদের সহযোগী ছিল রব হাফেজ, আনোয়ার তালুকদার, আব্দুল খালেক, গেরদে আলী, শহীদুল হক তালুকদার প্রমুখ। বানারীপাড়া থানার ওসি নজরুলও এদের সঙ্গে যোগ দেয়। বানারীপাড়া থানা এবং থানাসংলগ্ন সাহাবাড়ি ও বণিক বাড়িতে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা স্থানীয় আওয়ামী লীগপন্থী ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। বহু বাড়িঘরে তারা লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। বানারীপাড়া বাজারের দোকানগুলোও তারা লুটপাট করে পুড়িয়ে দেয়। বানারীপাড়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে আলতা, গাভা, নরেরকাঠি, রায়েরহাট ও বীরমহল গ্রাম। এসব জায়গায় পুনরায় হিন্দুরাই সর্বাধিক ক্ষতির শিকার হয়। পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে বানারীপাড়ার প্রায় পাঁচশত নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। তাদের মধ্যে অনেকে গণহত্যার শিকার হয়। উল্লেখযোগ্য পাঁচটি গণহত্যা হলো- গাভা-নরেরকাঠি গণহত্যা, রায়েরহাট গণহত্যা ও গাভা বাজার গণহত্যা, বিল্ববাড়ি গণহত্যা, শিয়ালকাঠী গণহত্যা ও তালাপ্রাসাদ গণহত্যা। ২রা মে গাভা- নরেরকাঠি গণহত্যা সংঘটিত হয়। এতে হানাদার বাহিনীর হাতে শতাধিক মানুষ নৃশংসভাবে নিহত হন। মে মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী হিন্দু অধ্যুষিত রায়েরহাট গ্রামে হানা দিয়ে ৭০-৮০ জন লোককে হত্যা করে। গাভা বাজার গণহত্যা সংঘটিত হয় ১০ই মে। এতে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী শহীদ হন। এছাড়াও পাকবাহিনী গাভা গ্রামে একাধিকবার গণহত্যা চালিয়ে বহু লোককে হত্যা করে। ১০ই মে অনুষ্ঠিত বিল্ববাড়ি গণহত্যায় ১০-১২ জন সাধারণ গ্রামবাসী শহীদ হন। শিয়ালকাঠী গণহত্যা সংঘটিত হয় ১০ই নভেম্বর। এতে ১২ জন মানুষ শহীদ হন। তালাপ্রাসাদ গণহত্যা (১০ই নভেম্বর) ১৪ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। বানারীপাড়ার শহীদদের মধ্যে অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এবং অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার – এ দুজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক এবং জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ। ২৫শে মার্চ রাতে পাকসেনাদের গুলিতে আহত হয়ে ৩০শে মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। দ্বিতীয়জন ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক। ১৪ই এপ্রিল পাকসেনারা তাঁকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে গুলি করে হত্যা করে। অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যার পাশাপাশি পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা অনেক নারীর ওপরও পাশবিক নির্যাতন চালায়। তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে। নির্যাতিত এসব নারীদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের কেউ-কেউ এখনো বেঁচে আছেন, কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন, আবার কেউ লোকলজ্জার ভয়ে ভারতে চলে গেছেন।
প্রথম পর্যায়ে পাকবাহিনী বানারীপাড়া থানাকে নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করে। ওসি নজরুলের নেতৃত্বে আওয়ামীপন্থী ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এখানে ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। বানারীপাড়া ভূমি অফিস ক্যাম্পও নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বানারীপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন বেণীলাল দাশগুপ্ত (পিতা বীরেন মোহন দাশগুপ্ত)। তাঁর একটি নিজস্ব বাহিনী ছিল বেণু বাহিনী। ২৫শে মার্চ গণহত্যার পরপরই ঘনিষ্ঠ কয়েকজন যোদ্ধা নিয়ে স্থানীয়ভাবে তিনি এ বাহিনী গঠন করেন। বানারীপাড়া থানা অপারেশনসহ এ বাহিনী অনেক সফল অপারেশন পরিচালনা করে। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় এ বাহিনী ঐ এলাকায় খুবই পরিচিতি লাভ করে।
বানারীপাড়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বানারীপাড়া থানাযুদ্ধ। বেণীলাল দাশগুপ্ত, হাবিবুর রহমান ও আব্দুল মজিদের নেতৃত্বে তিনবার এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অন্যান্য স্থানে যে-যুদ্ধগুলো হয় সেগুলো হলো বানারীপাড়া বাজার গানবোট যুদ্ধ, জম্বুদ্বীপ যুদ্ধ, আলতা যুদ্ধ প্রভৃতি। নভেম্বরের ২৮ তারিখে বানারীপাড়া থানার শেষ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা সফল হন। এদিন ২০ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। এর মধ্য দিয়ে বানারীপাড়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
বানারীপাড়া উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— শামসুল হক (পিতা আব্দুর রশীদ বেপারী, রাজ্জাকপুর; সেনাসদস্য, ২৬শে মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ এবং সেখানেই সমাহিত), ফজলুল হক খান (রাজ্জাকপুর; ঢাকার পিলখানায় ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে ১৩ উইং বি-কোম্পানির হাবিলদার ছিলেন; ২৬শে মার্চ পাকবাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে মোহাম্মদপুর নিয়ে যায় এবং যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তাঁকে হত্যা করে), এনায়েত হোসেন (পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন; যুদ্ধ শুরু হলে তিনি গ্রামে চলে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন; আলতায় পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হন), পূর্ণেন্দু সরকার (পিরোজপুর কলেজের ছাত্র; নবম সেক্টরের অধীন লেফটেন্যান্ট জিয়াউদ্দিনের সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন; ৬ই মে বলেশ্বর নদীর তীরে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল কাদের (শিয়ালকাঠী; চাখার কলেজ থেকে বিএ পাস করেন; বানারীপাড়া থানা সংগ্রাম কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা; ৮ই জুন রায়েরহাট থেকে ওসি নজরুল তাঁকে গ্রেপ্তার করে পিরোজপুর মিলিটারি ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয় এবং ঐদিনই পাকবাহিনী তাঁকে হত্যা করে), বিমল কৃষ্ণ দাস (চাখার কলেজের ডিগ্রির ছাত্র, ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং বেণু বাহিনীর সাহসী যোদ্ধা; বাবুগঞ্জ থানা আক্রমণের উদ্দেশ্যে থানার কাছের একটি বাড়িতে অবস্থানকালে ৬ই জুলাই পাকবাহিনী বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় এবং ৮ই জুলাই কীর্তনখোলা নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়), কাজী মতিউর রহমান (চাখার কলেজের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী; নভেম্বরের শেষদিকে শর্ষিনা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনে শহীদ), দেলোয়ার হোসেন (সলিয়াবাকপুর; বানারীপাড়ায় গানবোট যুদ্ধে পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ), জাফর আলী খান (রাজ্জাকপুর; বরিশালের কাছে এক যুদ্ধে শহীদ) এবং আবদুস (বানারীপাড়া থানাযুদ্ধে শহীদ)।
বানারীপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। শুধু শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদেরের স্মরণে তাঁর নিজগ্রাম শিয়ালকাঠীতে কাদের স্মৃতি সংসদ নামে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া অপর একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হকের নামে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। [অনিমেশ সাহা]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!