You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বানিয়াচঙ্গ উপজেলা (হবিগঞ্জ)

বানিয়াচঙ্গ উপজেলা (হবিগঞ্জ) মহকুমা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরবর্তী প্রত্যন্ত ও যোগাযোগবিচ্ছিন্ন একটি এলাকা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এখান থেকে আওয়ামী লীগ-এর কর্নেল (অব.) আব্দুর রব জাতীয় পরিষদ এবং শ্রী গোপাল কৃষ্ণ মহারত্ন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ হঠাৎ তা স্থগিত ঘোষণা করেন। এতে সারা দেশের ন্যায় বানিয়াচঙ্গের মানুষও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। -ছাত্রলীগ-এর নেতৃত্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল চলতে থাকে। যোগাযোগবিচ্ছিন্ন এলাকা হিসেবে বহিরাঞ্চলের সঙ্গে সংবাদ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে পোস্ট অফিস একমাত্র অবলম্বন হওয়ায় মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে বানিয়াচঙ্গ পোস্ট অফিসের সামনে জড়ো হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ দিকনির্দেশনা প্রদান করতেন। ২৬শে মার্চ তেমনি এক সভা শেষে সবাই যখন ঘরে ফিরছিলেন, ঠিক সে- সময় একটি টেলিগ্রামের মাধ্যমে তারা ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সংবাদ পান।
বস্তুত বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এর পরপরই এখানকার ছাত্র-জনতা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে এল আর হাইস্কুল ও বড়বাজার মডেল প্রাইমারী স্কুলের সামনে দুটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। প্রায় পঞ্চাশ জন ছাত্র-যুবক এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক আহসান উল্লাহ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত নায়েক শামসুল হক ও পিএনজি সদস্য হরমুজ উল্লাহ।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে বানিয়াচঙ্গে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন মুক্তিযুদ্ধকালে সশস্ত্র বাহিনীর চীফ অব স্টাফ কর্নেল (অব.) আব্দুর রব, গোপাল কৃষ্ণ মহারত্ন এমপিএ, আব্দুছ সালাম খান, হাফিজ সিদ্দিক আহমদ, প্রবোধ বিশ্বাস, মাজুম উল্লাহ, আমীর হোসেন, আব্দুল খালেক, ইমান উদ্দিন, আব্দুর কাদির, রমেশচন্দ্র পাণ্ডে প্রমুখ।
ভাটি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত আজমিরীগঞ্জের বীর সন্তান জগৎজ্যোতি দাস, বীর বিক্রম – স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন, যা দাস পার্টি নামে পরিচিত। এ বাহিনী বানিয়াচঙ্গে কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে।
কোনোরকম যানবাহন চলাচলের উপযোগী রাস্তা না থাকায় পাকবাহিনী শুরুর দিকে বানিয়াচঙ্গে যেতে অনাগ্রহী ছিল। কিন্তু কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা শাহাবুদ্দিন মোক্তার, ১নং উত্তর-পূর্ব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ ফয়জুল হক মোতওয়াল্লী, দেওয়ান আলী রজা প্রমুখের বিশেষ আগ্রহে তারা বানিয়াচঙ্গে আসতে রাজী হয়। দেওয়ান আলী রজার অর্থানুকূল্যে হবিগঞ্জ থেকে বানিয়াচঙ্গ পর্যন্ত কাঁচা রাস্তার ভাঙ্গা অংশসমূহ কোনোক্রমে সামরিক জিপ চলাচলের উপযোগী করা হলে, ৫ই মে কয়েকটি জিপে করে পাকসেনারা বানিয়াচঙ্গে প্রবেশ করে থানায় অবস্থান নেয়। ঐদিনই থানা থেকে তাদের কয়েকজন একটি জিপে করে সাগরদিঘির পূর্বপাড়ের রাস্তায় গিয়ে লাড়িয়াঘাটির দিকে অগ্রসর হয়। সেখানকার পলায়নপর লোকজনের মধ্য থেকে কয়েকজন নারীকে ধরে এনে প্রকাশ্যে ধর্ষণে লিপ্ত হয়। অতঃপর তারা হবিগঞ্জের উদ্দেশ্যে বানিয়াচঙ্গ ত্যাগ করে। পরবর্তীতে পাকবাহিনী মাঝে-মধ্যে বানিয়াচঙ্গ এসে নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে চলে যেত। রাজাকার বাহিনী থানাকে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করত।
জুন মাসে বানিয়াচঙ্গে শাহাবুদ্দিন মোক্তারকে চেয়ারম্যান এবং মৌলভী আব্দুল্লাহকে সেক্রেটারি করে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- সৈয়দ ফয়জুল হক মোতওয়াল্লী, মোগল উল্লা, হাসমত আলী খান, সানাওর মিয়া, খলিল মেম্বর, আব্দুল মোছাব্বির চৌধুরী, হানিফ ভূঁইয়া (পৈলারকান্দি), আ. আলিম চেয়ারম্যান (কাগাপাশা), আইয়ুব আলী চেয়ারম্যান (দৌলতপুর), মুছা মিয়া চেয়ারম্যান (সাগরদিঘির পূর্বপাড়) প্রমুখ।
জুলাই মাসে আব্দুল খালিক (আমীর খানি)-কে কমান্ডার করে এখানে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এখানকার অন্য রাজাকাররা হলো- গরীবহুসেন মহল্লার আজমান, শেখের মহল্লার ইব্রাহিম, আতাউর, আদমখানির রেজ্জাক উল্লা, কুতুবখানির শাবান, আর্যান উল্লা, পাইকপাড়ার হাফেজ মঈনউদ্দিন, দুদু মিয়া, সৈদরটুলার মোতি, নূর মোহাম্মদ, তোপখানার ফারুক, আবদুস সালাম, নাবু, খুর্শেদ, খনকারি বাগের তৈয়ব উল্লা, দেওয়ান বাগের নাজিম উল্লা, রিফাত উল্লা, মজলিশপুরের আজব আলী, মো. ইলিয়াস, নূর মোহাম্মদ, আলী হুসেন, আবুল, চনু, কাজী মহল্লার মোমিন, খলিল, আবুল, নূরুল ইসলাম (ভাওয়ালীটুলা), চেরাগ আলী (কামাল খানি), আবদুর রউফ (নাগর মহল্লা), ছালেক মিয়া (চানপাড়া), গোলাম হোসেন (দেওয়ানদিঘির পূর্বপাড়), মাখন উল্লা (দেওয়ানদিঘির উত্তরপাড়), মন্নর (দেওয়ানদিঘির দক্ষিণপাড়), আবদুর রেজাক (যাত্রাপাশা), আলাউদ্দিন (জাতুকর্ণ) প্রমুখ। ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে তাদেরকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অধীনে ন্যস্ত করা হয়। শান্তি কমিটির কেউ-কেউ নিজেদের নিরাপত্তার জন্য রাজাকার সদস্যদের নিজেদের বাড়িতে পাহারায় রাখত।
মুক্তিযুদ্ধকালে বানিয়াচঙ্গে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর তৎপরতা লক্ষণীয় ছিল। শান্তি কমিটির সদস্যরা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য হবিগঞ্জ থেকে পাকসেনাদের নিয়ে এসে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন প্রভৃতি অপকর্ম করত। রাজাকাররা শান্তি-শৃঙ্খলার নামে গ্রামের নিরীহ মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করত, বিভিন্ন বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে লুণ্ঠনসহ নানা রকম দুষ্কর্মে লিপ্ত হতো।
২৫শে এপ্রিল পাকবাহিনীর বিমান থেকে মেশিনগানের গুলিবর্ষণে হলদারপুর, কালাইনজুরা ও উমরপুর গ্রামের ১৩ জন সাধারণ মানুষ গণহত্যার শিকার হন, যা হলদারপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। বোমা হামলায় হলদারপুর গ্রামের হাজী আব্দুছ ছমেদ লন্ডনীর বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। পাকবাহিনী প্রথমে ৫ই মে বানিয়াচঙ্গের লাড়িয়াহাটিতে গণধর্ষণ চালায়। হিন্দু-মুসলমান মিলে ৬-৭ জন নারী সেদিন ধর্ষণের শিকার হন। শান্তি কমিটি ও দালালদের দেয়া তালিকা ধরে ১৫ই জুন মুক্তিযোদ্ধা মহিবুর রহমান এবং হাবিলদার আহসান উল্লাহকে তারা গ্রেফতারের পর অকথ্য নির্যাতন করে। ১৬ই আগস্ট মহকুমা শান্তি কমিটির নেতা আব্দুল বারি মোক্তার এবং থানা শান্তি কমিটির নেতা সৈয়দ ফয়জুল হক মোতওয়াল্লীর সহযোগিতায় পাকবাহিনীর মেজর দুররানির নেতৃত্বে নজিপুরে এক নারকীয় গণহত্যা পরিচালিত হয়। নজিপুর গণহত্যায় ২৪ জন নারী-পুরুষ নিহত হন। গণহত্যার পাশাপাশি তারা ন্যাপ নেতা ডা. নিখিল রঞ্জন সরকারের বাড়িসহ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর তারা কাগাপাশা গ্রামে গিয়ে কালীচরণ নমঃশূদ্র, কৃপারাম নমঃশূদ্র ও অজ্ঞাত পরিচয় এক কিশোরীকে হত্যা করে। অতঃপর সেকান্দরপুর, রাজেন্দ্রপুর, গোগ্রাপুর, হালিমপুর ও মকা গ্রামে হামলা চালায়। তারা সেকান্দারপুর গ্রামের নির্ধন দাশ (পিতা তরকনাথ দাশ), সূর্যকান্ত নমঃশূদ্র (পিতা বৈদ্যনাথ নমঃশূদ্র) ও নবীগঞ্জের একজন ব্রাহ্মণকে হত্যা করে। এসময় হালিমপুরের বিনু রানী দাস নামের এক বিধবা নারী উপর্যুপরি ধর্ষণের শিকার হন।
১৮ই আগস্ট বিষহরি পূজা চলাকালে শান্তি কমিটির নেতা সৈয়দ ফয়জুল হক মোতাওয়ালীর সহযোগিতায় পাকবাহিনী হিন্দু অধ্যুষিত মাকালকান্দি গ্রামে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে গণহত্যা চালায়। মাকালকান্দি গণহত্যায় শতাধিক মানুষ নিহত হন। গণহত্যার পাশাপাশি পাকবাহিনী ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। পাকবাহিনীর এ হামলায় ডিসেম্বর পর্যন্ত মাকালকান্দি একটি পরিত্যক্ত গ্রামে পরিণত হয়। ফলে ডিসেম্বর মাসেও সেখানে অনেক লাশ সৎকারবিহীন অবস্থায় পড়ে ছিল। মাকালকান্দি গ্রামে হত্যাযজ্ঞ শেষে পাকবাহিনী ফেরার পথে হিন্দু অধ্যুষিত হারুনী গ্রামে গণহত্যা চালায়। হারুনী গণহত্যায় বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। হারুনী গ্রামেও গণহত্যার পাশাপাশি তারা ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে।
১৮ই আগস্ট মাকালকান্দি গ্রামে শনি মন্দিরের সামনে সংঘটিত ৭৫ জনের গণহত্যার স্থানটি স্থানীয়ভাবে বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। পরিবেশগত কারণেই বানিয়াচঙ্গে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হওয়ার তেমন সুযোগ ছিল না। ২০শে অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা বানিয়াচঙ্গ থানা দখল- করেন। এ অভিযানে নেতৃত্ব দেয় জগৎজ্যোতি দাসের নেতৃত্বাধীন দাস পার্টি। এতে শত্রুপক্ষের ৩৫ জন সদস্য নিহত হয়, ৪ জন পুলিশ, ৭ জন রাজাকার ধরা পড়ে এবং ৫৩টি রাইফেল ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
৬ই ডিসেম্বর ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সঙ্গে-সঙ্গে পাকসেনারা সারা দেশ থেকে ঢাকার দিকে এসে জড়ো হতে থাকলে এখানকার রাজাকাররা বেশ বিচলিত হয়ে পড়ে। ৮ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বানিয়াচঙ্গ উপস্থিত হলে থানায় অবস্থানরত রাজাকাররা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা সকাল দশটার দিকে থানা চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এভাবে ৮ই ডিসেম্বর বানিয়াচঙ্গ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন— এম এ রব, বীর উত্তম- (পিতা মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন, খাগাউড়া)। বানিয়াচঙ্গে শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. রেজোয়ান (পিতা চান্দ আলী, দমারগাঁও, দৌলতপুর; ২৬শে সেপ্টম্বর দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ), হাবিবুর রহমান নুনু (পিতা আব্দুল গণি, কালাইনজোড়া, বড়িউরী; ১১ই ডিসেম্বর ছাতকের যুদ্ধে শহীদ), আকল আলী (খাগাউড়া) এবং রজব আলী (খাগাউড়া)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বানিয়াচঙ্গ সদরে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। মাকালকান্দি গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে মাকালকান্দি গ্রামে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। কাদিরগঞ্জ বাজারে মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজোয়ানের নামে একটি মিনার স্থাপন করা হয়েছে। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!