You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.25 | বাজিতপুর থানা আক্রমণ (বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

বাজিতপুর থানা আক্রমণ (বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ)

বাজিতপুর থানা আক্রমণ (বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ) পরিচালিত হয় দুবার- ২৫শে জুন ও ২৭শে অক্টোবর। প্রথম আক্রমণে ৩০-৩৫ জনের একটি গেরিলা দলের নেতৃত্ব দেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হারুন-অর-রশিদ। দ্বিতীয় আক্রমণটি করে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত একটি স্থানীয় বাহিনী। উভয় আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ী হন।
৪ঠা মে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক বাজিতপুরে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর স্থানীয় – রাজাকাররা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা সাধারণ মানুষের ওপর নানাভাবে নির্যাতন ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। বাজিতপুরের মুসা গুন্ডা এবং অপর এক বিহারি রাজাকার হিন্দু মাহজনদের বড়বড় গদিঘর দখল করে। এদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দূরের কথা, চোখ তুলে তাকাবার সাহসও কেউ পাচ্ছিল না। সে-সময় সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক গেরিলা তৎপরতা শুরু হলেও বাজিতপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধের কোনো দল এসে পৌঁছায়নি। এ-সময় হারুন বাহিনী নামে একটি মুক্তিযোদ্ধা দল কুলিয়ারচর, কটিয়াদী, হোসেনপুর ও পাকুন্দিয়া থানা এলাকায় হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করে। এ দল ঘোষেরকান্দি, টোকবাজারের কাছে হানাদার বাহিনীর লঞ্চ বহরে আক্রমণ করে এমন ক্ষতি সাধন করেছিল যে, পরে নিহত ও আহত পাকসেনাদের হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় নিতে হয়েছিল। ২৭শে মার্চ মধ্যরাতে মেজর কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ময়মনসিংহে অবস্থারনত ইপিআর-এর ২নং উইং-এ কর্মরত বাঙালি সৈন্যরা স্বাধীনতার প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেন। তাঁরা ইপিআর-এর অবাঙালি সদস্যদের হত্যা করে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে জয়দেবপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। জয়দেবপুরের কাছাকাছি এলে পাকহানাদাররা তাঁদের গতিরোধ করে। ফলে দুপক্ষে ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়। প্রচণ্ড যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইপিআর দল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে ইপিআর-এর নায়েক হারুন-অর-রশিদ, সিপাহি কাজী সাইদুর রহমান ও সিপাহি আফতাব উদ্দিনসহ ১০-১২ জনের একটি দল পায়ে হেঁটে নরসিংদী, শিবপুর হয়ে মনোহরদী থানার চালাকচর গ্রামে অবস্থান নেয়। দলটি প্রচুর অস্ত্র ও গেলা-বারুদ সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। তাঁরা স্থানীয়ভাবে আরো কিছু যুবককে রিক্রুট করে বেশ বড় একটি গেরিলা দল গঠন করেন। এ-সময় পশ্চিম পাকিস্তানের পেশোয়ারস্থ রেসালপুরের ৬নং ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নের ৪৫ কোম্পানির সৈনিক পাকুন্দিয়ার সানোয়ার আলী ছুটিতে এসে এ বাহিনীতে যোগ দেন। এতে গেরিলা বাহিনীতে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। যেহেতু দলের নেতৃত্বে ছিলেন নায়েক হরুন-অর-রশিদ, তাই এটি হারুন বাহিনী নামে পরিচিতি লাভ করে।
বাজিতপুর নোয়পাড়া গ্রামের কৃষকনেতা আনিসুর রহমান, একই গ্রামের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ মান্নাফীর বড় ভাই হাফিজ উদ্দিন আহাম্মদ ও এমাদ উদ্দিন আহাম্মদ এবং সরিষাপুরের প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক ও মুহাম্মদ বাকের (মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাবেক এডিএম) পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে হারুন বাহিনীকে বাজিতপুর অপরেশনের জন্য অনুরোধ করেন। হারুন বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব নেন আনিসুর রহমান। হারুন বাহিনী তখন ডোমরাকান্দা (কুলিয়ারচর) অঞ্চলে অবস্থান করছিল। আনিসুর রহমানের কাছে বাজিতপুরের সার্বিক পরিস্থিতির কথা শুনে হরুন-অর-রশিদ তাৎক্ষণিকভাবে বাজিতপুর থানা অপারেশনে রাজি হন।
পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৪শে জুন রাতে আনিসুর রহমান হারুন বাহিনীকে এগিয়ে আনতে যান। হাফিজ উদ্দিন, এমাদ উদ্দিন, মোজাম্মেল হক ও মুহাম্মদ বাকের পীরপুর গ্রামে রেললাইনের কাছাকাছি অবস্থান নেন। রাত গভীর হয়ে এলে তাঁরা ৪ জন লোকজনের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য পীরপুর রেলওয়ে ব্রিজের নিচে সংগোপনে অবস্থান নেন। রাত আনুমানিক তিনটার দিকে আনিসুর রহমান হারুন বাহিনীকে নিয়ে পীরপুর রেলওয়ে ব্রিজের কাছে পৌঁছান। ২২ সদস্যবিশিষ্ট হারুন বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও প্রচুর পরিমাণ গেলা-বারুদ সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। আনিসুর রহমানসহ অন্য সঙ্গীরা গেরিলাদের গোলা-বারুদ বহনে সহযোগিতা করেন। অতিসন্তর্পণে দলটি এগিয়ে চলে সরারচরের দিকে। সরারচর থেকে বাজিতপুর যাওয়ার পথে তেঘরিয়া গ্রামের কাছাকাছি গেলে ফজরের আযান পড়ে যায়। বারৈ গ্রামের কাছাকাছি এসে দলটি নেমে যায় রাস্তার উত্তর পাশে। পাটক্ষেতের আইল ধরে দ্রুত হেঁটে সরিষাপুরে মুহাম্মদ বাকেরের বড় বোনের বাড়ির বাংলা ঘরে গিয়ে ওঠেন। তাঁদের ঘরের ভেতর রেখে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়া হয়।
২৫শে জুন সন্ধ্যায় হারুন বাহিনীর সঙ্গে সহযোগী হিসেবে বাজিতপুর অপারেশনে যান সরিষাপুরের ছলিমুল হক, মিছবাহ উদ্দিন, আ. মান্নান, মো. ইছহাক, মীর আক্কাছ এবং মইতপুরের ছাত্রনেতা মো. শাহজাহান। আনিসুর রহমান, হাফিজ উদ্দিন ও এমাদ উদ্দিন বাজিতপুরে এসে দলের সঙ্গে মিলিত হন। বাজিতপুর থানার পুকুরের উত্তর প্রান্তে অর্থাৎ বাজিতপুর ডাক অফিসের সামনের রাস্তায় পৌছে হারুন- অর-রশিদ নিজে এলএমজি স্থাপন করেন। অন্যরা সুবিধামতো স্থানে পজিশন নেন। মুহূর্তের মধ্যে এলএমজি- র ব্রাশ ফায়ার শুরু হয়। গেরিলারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মাধ্যমে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকেন। মাত্র কয়েক মিনিটে বাজিতপুর থানার ওসি-সহ সকল পুলিশ আত্মসমর্পণ করে। হারুন-অর-রশিদের নির্দেশে তারা থানার সমুদয় অস্ত্র গেরিলাদের হাতে তুলে দেয়।
বাজিতপুরে এসে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের লালিত গুণ্ডা বাহিনীর প্রধান মুসা গুণ্ডার বাড়ি ঘেরাও করেন। মুসা তখন ঘরের দরজা বন্ধ করে লুকিয়েছিল। নোয়াপাড়ার আনিসুর রহমান দরজা ভেঙ্গে ফেলার সঙ্গে-সঙ্গে মুসা লাফ দিয়ে এসে আনিসুর রহমানের হাতে ছুরি বসিয়ে দেয়। ক্ষিপ্র গতিতে আনিসুর রহমানও নিজের হাতের খোলা ড্যাগার মুসার বুকে বসিয়ে দেন। সঙ্গে-সঙ্গেই মুসা দরজার কাছাকাছি ঘরের ভেতরে ঢলে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও জনতা ঘরটির দরজা জানালা বন্ধ করে চারদিকে অগ্নিসংযোগ করে। অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে মুসা গুণ্ডার দেহ ছাই হয়ে যায়।
হারুন বাহিনী ও জনতার হাতে বাজিতপুরে আরো কিছু চিহ্নিত দালাল আক্রান্ত হয়। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শুনে এবং আগুনের লেলিহান শিখা দেখে পালাতে গিয়ে পুকুরের পানিতে পড়ে হার্টফেল করে মারা যায় বাজিতপুরের মুসলিম লীগ-এর অন্যতম প্রধান নেতা মধু মিয়া। ২৫শে জুন মুক্তিবাহিনীর সফল অপারেশনের পর বিশেষ করে মুসা গুণ্ডার পরিণতি দেখে রাজাকাররা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা গোপনে কিশোরগঞ্জে গিয়ে হানাদার বাহিনীর শীর্ষ অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বাঁচানোর জন্য মিনতি করতে থাকে। দালালদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বাজিতপুর থানা সদরে প্রায় দুশতাধিক সদস্য নিয়ে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। বাজিতপুর থানার সরারচর শিবনাথ হাইস্কুলের রহিমা খাতুন ছাত্রাবাসে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে শক্তিশালী মিলিশিয়া- ক্যাম্প স্থাপিত হয়। হানাদার বাহিনী বাজিতপুর থানায় তাদের টহলও বৃদ্ধি করে।
২৬শে অক্টোবর রাজাকারদের রেশনবাহী একটি দলকে এম্বুশ করার সময় দুর্ভাগ্যবশত আ. মোতালিব নামে একজন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মোতালিবের শাহাদতের সংবাদে বাজিতপুর থানার সকল মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। তাঁরা বাজিতপুর থানা আবার আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
২৬শে অক্টোবর রাতে হিলচিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত সভা ডাকা হয়। সভায় বাজিতপুরে অবস্থানরত বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা দলের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। কুলিয়ারচর থানা থেকে মুক্তিবাহিনীর গ্রুপ কমান্ডার মিজবাহ উদ্দিন এ সভায় উপস্থিত হন। সভায় অন্যদের মধ্যে সুবেদার মেজর নূরুল আজম চৌধুরী, নায়েক সুবেদার বজলুর রহমান, অধ্যাপক ইয়াকুব আলী, আ. হাই (জারু মিয়া), আব্দুল বারী খান, আ. মোতালিব (বসু), গ্রুপ কমান্ডার রমিজ উদ্দিন আহমেদ, সেকশন কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ এবং গ্রুপ কমান্ডার মজিবর রহমানের পক্ষে একজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সভায় আক্রমণের সার্বিক দিক নিয়ে আলোচনা হয়। বাজিতপুরের রাজাকার ক্যাম্পে অবস্থানরত বাজাকার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা, তাদের অস্ত্রবল, থানার পুলিশ বাহিনীর শক্তিমত্তা, সরারচর মিলিশিয়া ক্যাম্পের অবস্থান, যাতায়াত ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা করা হয়। সবদিক বিচার-বিশ্লেষণ করে ২৭শে অক্টোবর ভোর রাতে বাজিতপুর আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয়।
পরিকল্পনা মোতাবেক প্রয়োজনীয় হাতিয়ার ও রসদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। গ্রুপগুলো ছিল: (১) মূল আক্রমণ গ্রুপ: কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমদ ও টুআইসি আব্দুল মোতালেব বসু, (২) কভারিং গ্রুপ: কমান্ডার অধ্যাপক ইয়াকুব আলী ও টুআইসি আব্দুল বারী খান, (৩) সপোর্টিং গ্রুপ: কমান্ডার রমিজউদ্দিন ও টুআইসি মো. ইউনুছ আলী (ইনু), (৪) বিস্ফোরক গ্রুপ: কমান্ডার এ কে এম আনোয়ারুল হক ও টুআইসি মো. কফিলউদ্দিন এবং (৫) কাট-আপ গ্রুপ: কমান্ডার মোহম্মদ আলী ও টুআইসি মো. আনিসুর রহমান।
আক্রমণ পরিচালনার জন্য প্রথমেই প্রাধান্য দেয়া হয় সরারচর-বাজিতপুর সংযোগকারী সিন্ডবি সড়কের জুমাপুর জগত্মারা ব্রিজের ওপর। কারণ এ ব্রিজ ধ্বংস করা গেলে সরারচরের মিলিশিয়ারা সহজে গাড়ি নিয়ে বাজিতপুর ঢুকতে পারবে না। সেই সঙ্গে ব্রিজটির কাছাকাছি মুক্তিযোদ্ধারা এম্বুশ করলে তা মিলিশিয়াদের জন্য মরণ ফাঁদ হিসেবে কাজ করবে। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ছিল, জুমাপুর জগত্মারা ব্রিজ অপারেশনের শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে মূল আক্রমণ গ্রুপ (কমান্ডার মহিউদ্দিন ও টুআইসি বসু) নিতারকান্দির ভেতর দিয়ে যতটুকু সম্ভব এগিয়ে গিয়ে প্রথম ফায়ার ওপেন করবে। বাকিরা নির্দেশিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন। ব্রিজ অপারেশনের দায়িত্বে থাকা বিস্ফোরক গ্রুপ (কমান্ডার আলিম উদ্দিন ও টুআইসি কফিলউদ্দিন) রাতেই দুটি মুড়ির টিন, শাবল ও খুন্তি যোগাড় করে টিনে উচ্চ বিস্ফোরক ভরে ডেটোনেটর ফিউজ ও কড ফিটিং করে রাখে। রাত ৩টার পর একটি নৌকা ও সঙ্গীদের নিয়ে সরিষাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। মূল আক্রমণ গ্রুপ যথাসময়ে ২৫-৩০ জনের একটি সশস্ত্র দল নিয়ে নিতারকান্দি পৌঁছে অন্ধকার ভেদ করে থানার আশেপাশে পজিশন নেয়। অধ্যাপক ইয়াকুব আলী ও বারী খানের নেতৃত্বে কৈলাগ দীঘির পাড়ে রাস্তা ধরে ২৫-৩০ জনের একটি কভারিং গ্রুপ বিপুলসংখ্যক জনতাসহ বাজিতপুর বাজারের বাঁশমহাল পর্যন্ত এসে জনতার দায়িত্ব আ. হাই (জারু মিয়া)-এর ওপর অর্পণ করে পৈলানপুর রাস্তা দিয়ে থানার দিকে অগ্রসর হয়। বিস্ফোরক গ্রুপ রাত ৪টার দিকে সরিষাপুরের ভাঙ্গা ব্রিজের নিকট পৌঁছে। নৌকা থেকে নেমে মালামাল ও বিস্ফোরক মাথায় করে নিয়ে হেঁটে জুমাপুরের দিকে যাওয়ার পথে নিতারকান্দির শ্মশান ব্রিজের পূর্ব পাশের বাংকার থেকে ২-৩ জন পাহারাদার রাজাকার তাদের দেখে ফেলে। এরা মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে ৩০৩ রাইফেল দিয়ে একটু পরপর গুলি করতে থাকে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা এর জবাব না দিয়ে সাবধানে জুমাপুর পৌঁছে যান। সেখানে অবস্থানরত কমান্ডার রমিজ, সরিষাপুরের রেদোয়ান, মান্নান, আব্দুল হক (কেনু), জৈনতপুরের ছামির হোসেন, জ্ঞানপুরের মেজবাহ উদ্দিন, মজলু, মান্নান-১, মান্নান-২ ও তেঘরিয়ার মো. ইউনুছ (ইনু)-সহ নির্ধারিত মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের দেখে দ্রুত সাহায্যে এগিয়ে আসেন। রমিজ উদ্দিন ও ইউনুছকে নিয়ে দ্রুত শাবল ও খুন্তি দিয়ে ব্রিজের পশ্চিম পাশে গর্ত খনন করে বিস্ফোরকের টিনদুটি মাটির নিচে পুঁতে সেফটি ফিউজে আগুন ধরিয়ে দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে পজিশন নেন। সঙ্গে-সঙ্গে বিকট শব্দে ব্রিজ ভেঙ্গে নিচে পড়ে যায়। এখানে থাকা সরিষাপুরের গ্রুপ ও অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তৎক্ষণাৎ ব্রিজের পূর্ব পাশে নিজ-নিজ পজিশনে চলে যান। এম্বুশের জন্য কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন রেদোয়ান আহমেদ।
ব্রিজ ভাঙ্গার শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে ব্রাশ ফায়ারের মাধ্যমে আক্রমণের সূচনা হয়। থানায় অবস্থানরত রাজাকার বাহিনী পাল্টা ফায়ার শুরু করে। বাজিতপুরের বাঁশমহালের দিক থেকে ছয়চিড়া, সুভারামপুর, পিউরী, কৈলাগ, কুকরারাই প্রভৃতি গ্রামের শতশত মানুষের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধারা ধীরে-ধীরে অগ্রসর হতে থাকেন। রাজাকার ও পুলিশ বাহিনী বাংকারে বসে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করেও মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রায় নূন্যতম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের বিনিময়ে হলেও বিজয় অর্জন এবং আ. মোতালিব-সহ হাজার-হাজার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হত্যার প্রতিশোধ নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। সকাল ৮টার দিকে রাজাকারদের গুলিতে রমিজ গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা সালেহ উদ্দিন কচি আহত হন। কিছুক্ষণ পর বসু গ্রুপের পীরপুর গ্রামের আবু সামাদের বুকে গুলি লাগে। তাঁদের চিকিৎসার জন্য নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। ২ জন সহযোদ্ধা আহত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তাঁরা প্রচণ্ড আক্রমণ রচনা করে থানা চত্বরে পৌঁছে যান। কমান্ডার মহিউদ্দিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্রলিং করে থানার ভারপ্রাপ্ত দারোগার কোয়ার্টার্সের টিনের দেউরী অতিক্রম করে ১টি গ্রেনেড চার্জ করেন। বিকট শব্দে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়। তবুও পুলিশ এবং রাজাকাররা থানা ও বাংকারের ভেতর থেকে অবিরত গুলি চালিয়ে যেতে থাকে। ইতোমধ্যে কভারিং গ্রুপ নিতারকান্দির ভেতর দিয়ে দড়িকান্দি পৌঁছে অতি দ্রুত থানার পশ্চিম পাশে পজিশন নেয়। কমান্ডার মহিউদ্দিন ও বসু এবং অধ্যাপক ইয়াকুব আলী দ্রুত ক্রলিং করে শত্রু-বাংকারের খুব কাছ থেকে পরপর কয়েকটি গ্রেনেড ছোড়েন। সব গ্রেনেড বাংকারের ভেতর বিস্ফোরিত হয়। তখন রাজাকার ও পুলিশের ভেতর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা বাংকার থেকে উঠে দৌড়ে থানার দিকে যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা চিৎকার দিয়ে তাদের ধরতে বলেন আর অবিরত ফায়ার করতে থাকেন। মুক্তিবাহিনী ও জনতা ক্রমে চারদিক ঘেরাও করে ফেলে। মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়। কয়েকবার হুঁশিয়ারি দেয়ার পর পুলিশ ও রাজাকার বাহিনী হাতিয়ার ফেলে আত্মসমর্পণ করে। তাদের সংখ্যা ছিল ১০০ জনের কাছাকাছি। তাদের বেঁধে বাজিতপুর বাজারের বাঁশমহালে নিয়ে যাওয়া হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের সব গ্রুপ ও উল্লসিত জনতা বাঁশমহালের চারদিকে জড়ো হতে থাকে। জনতা পুলিশ ও রাজাকারদের অতীত কার্যকলাপের কথা স্মরণ করে উত্তেজিত হয়ে ওঠে এ পরিস্থিতিতে উত্তেজিত মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার রোষানল থেকে তাদের রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ২৭শে অক্টোবর দুপুর ২টার দিকে হাজার-হাজার মানুষের উপস্থিতিতে আনন্দমুখর পরিবেশে বাজিতপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলিত হয়।
বিক্ষুব্ধ একদল মুক্তিযোদ্ধা বাজিতপুরে মুসলিম লীগের সাফি মিয়া, নশা মিয়া, কেন্তু খাঁ, ইশাদ মিয়া ও দিঘীরপাড়ের কুখ্যাত সুলতান হাজী-সহ আরো কয়েকজনকে ধরে এনে চরম শাস্তি প্রদান করেন। মুক্তিপাগল জনতা গরু জবাই করে মুক্তিযোদ্ধাদের আপ্যায়ন করে। বাজিতপুরের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার দায়িত্ব ইয়াকুব আলী, জারু মিয়া, আনিসুর রহমান, রমিজ উদ্দিন ও গাজিরচরের কমান্ডার মোহাম্মদ আলীর ওপর অর্পণ করা হয়। [মো. সিরাজুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড