বাজুবাঘা বৈদ্যুতিক টাওয়ার অপারেশন (বাঘা, রাজশাহী)
বাজুবাঘা বৈদ্যুতিক টাওয়ার অপারেশন (বাঘা, রাজশাহী) পরিচালিত হয় ২৪শে জুলাই। এতে দুটি টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যায়, যার ফলে রাজশাহী শহর থেকে শুরু করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত গোটা এলাকা বেশ কয়েকদিন বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।
ভারতের চাকুলিয়ায় দেড় মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে কমান্ডার শফিকুর রহমান রাজার নেতৃত্বাধীন একদল মুক্তিযোদ্ধাকে ৭নং সেক্টরের ৪নং সাবসেক্টরে মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্ত সংলগ্ন লালগোলা থানার ধুলাউড়ি নামক একটি এফএফ ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৯নং মারাঠা রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মধু। তিনি একটি বিশেষ অভিযানের জন্য এ দলের ৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ডেকে পাঠান। তাঁরা হলেন- মো. মোজাম্মেল হক, মো. লোকমান হোসেন, মো. আবদুল হামিদ, মো. রবিউল ইসলাম আবু, মো. ফজলুল হক, মুকুল ও মুহম্মদ শফিউর রহমান শফি। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট থেকে রাজশাহীর বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত হন। রাজশাহী শহরে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। রাজশাহী শহরতলীর পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত কাটাখালি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে এর সংযোগ রয়েছে। এই বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের ৬৬ হাজার ভোল্টের টাওয়ার লাইন উড়িয়ে দিতে পারলে রাজশাহী থেকে নবাবগঞ্জ পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। এর প্রভাবে রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত বিদ্যুৎহীন হয়ে গোটা এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। এসব শুনে ক্যাপ্টেন মধু মুক্তিযোদ্ধা মো. মোজাম্মেল হককে দলনেতা নির্বাচিত করে অপারেশন পরিচালনার নির্দেশ দেন। মোজাম্মেল হক তাঁর দলের অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে বাঘা (তৎকালীন চারঘাট) উপজেলার অন্তর্গত বাজুবাঘা এলাকার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের টাওয়ারটি বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিযোদ্ধা দলটি প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র, বিভিন্ন প্রকার বিস্ফোরক যেমন জিলেটিন, জিসি স্ল্যাব, পিকে ইত্যাদিসহ অভিযানের উদ্দেশ্যে ধুলাউড়ি থেকে ৯০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে কাজিপাড়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আসেন। তাঁরা এ ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার মেজর আবদুর রশিদের সঙ্গে অভিযানের বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি তাঁদের উৎসাহ প্রদান করেন। কাজিপাড়া ত্যাগ করে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের জলঙ্গী হয়ে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল কুষ্টিয়া জেলার খাজুরারথাক বিওপিতে আসেন। সেখান থেকে ২৪শে জুলাই বাঘার স্থানীয় গাইড সফিউদ্দিনের সহায়তায় হারান, মোসলেম উদ্দিন ও বেকু নামক ৩ জন মাঝির সহায়তায় রাত ১২টার দিকে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বাঘা সীমানায় পৌছান। অতিবৃষ্টিজনিত কারণে প্রবল বন্যার পানিতে গোটা বাঘা এলাকায় অথই জল। মুক্তিযোদ্ধারা তা কাজে লাগিয়ে নৌকা নিয়ে সরাসরি বাজুবাঘা-চাকিপাড়া নামক স্থানে বৈদ্যুতিক টাওয়ারের নিকট পৌঁছান। এখানে ৩টি টাওয়ার ছিল। ২টি টাওয়ারে বিস্ফোরক লাগানো হয়। এরপর সেন্ট্রি ফিউজে অগ্নিসংযোগ করে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সঙ্গে-সঙ্গে ২টি টাওয়ার টুকরো-টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। টাওয়ারের ভগ্নাংশগুলো চারদিকে গুলির মতো সাঁ-সাঁ শব্দে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ- বাতাস প্রকম্পিত করে নৌকাযোগে খাজুরারথাক বিওপিতে ফিরে যান। এ অপারেশনটি ছিল শত্রুপক্ষের জন্য এক প্রচণ্ড আঘাত। বৈদ্যুতিক টাওয়ার ধ্বংস হওয়ায় রাজশাহী শহর থেকে শুরু করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত গোটা এলাকা বেশ কয়েক দিন বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। এই আক্রমণের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিকট তাঁদের সদর্প উপস্থিতি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। [মো. মোস্তফা কামাল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড