বাঘা দরগা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন (বাঘা, রাজশাহী)
বাঘা দরগা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন (বাঘা, রাজশাহী) পরিচালিত হয় ১৬ই সেপ্টেম্বর। এতে ১ জন রাজাকার নিহত হয় এবং তাদের অনেক অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
কুষ্টিয়ার মুক্তাঞ্চল খাজুরারথাকে অবস্থান গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধারা বাঘার উত্তরে বাউশা, আড়ানি রেল স্টেশন ও পাকুড়িয়া হাটে অপারেশন সম্পন্ন করায় পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। তারা বাঘার অরক্ষিত স্থানগুলোর দিকে মনোযোগী হয়। এর অংশ হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনী ১৪ই সেপ্টেম্বর ৮০-৯০ জন রেঞ্জার, বিহারি, মিলিশিয়া, রাজাকার ও আলবদর এর সমন্বয়ে শাহ দৌলাহর (রহঃ) দরগাকে কেন্দ্র করে একটি ক্যাম্প তৈরি করে। এ ক্যাম্পের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোটা বাঘা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সর্বদা নজরদারি করা, স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর অত্যাচার- নির্যাতন চালানো, ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, মুক্তিবাহিনী সন্দেহে যুবক ও বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে হত্যা এবং লুটপাটের মাধ্যমে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। ক্যাম্প তৈরি ও নানা অপকর্মের সংবাদ জানতে পেরে কমান্ডার আজাদ আলী ও নাজির হোসেন হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টরের ৪নং সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর নিকট থেকে কমান্ডারদ্বয় সম্মতি নিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলাউড়ি ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক ক্যাপ্টেন পি জি ভাটের সঙ্গে দেখা করেন। প্রয়োজনীয় অস্ত্র নিয়ে তাঁরা অপারেশনের উদ্দেশ্যে খাজুরারথাকে ফিরে আসেন। এরপর কমান্ডার আজাদ আলী ও নাজির হোসেন তাঁদের অধীনস্থ সব মুক্তিযোদ্ধাকে ডেকে একত্রে বসে অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। এ অপারেশনে দুটি মুক্তিযোদ্ধা দলের ২৪ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। দক্ষ মাঝি আফসার আলীর পরিচালনায় একটি বড় নৌকায় করে তাঁরা ১৬ই সেপ্টেম্বর রাতে বাঘা দরগা ক্যাম্প আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেখানে পৌঁছে নারায়ণপুরে পাণ্ডেদের পরিত্যক্ত বাড়িতে তাঁরা অবস্থান নেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ রাতে আহার গ্রহণরত অবস্থায় শত্রুবাহিনীর ওপর হামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। সোর্স শফিউর রহমান, মো. ইনসার আলী, মো. জমির হোসেন ও মো. মোরশেদের নিকট থেকে রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর ২৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তিনটি সেকশনে বিভক্ত করেন। বাঘা বাজারের পশ্চিম দিকে রহমত কোম্পানির রাইস মিলের পার্শ্বে প্রথম সেকশন, বাঘা বাজারস্থ ইয়াকুব আলীর চামড়ার আড়তের পার্শ্বে দ্বিতীয় সেকশন এবং বাঘা শাহী মসজিদের উত্তর-পূর্ব বটতলা থেকে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা খাল পর্যন্ত তৃতীয় সেকশন অবস্থান নেয়। প্রথম সেকশনের কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে আজাদ আলী, বীর প্রতীক এবং মাহবুবউল গণি বাবলু। অন্য সদস্যরা হলেন- মো. মোজাম্মেল হক, মো. আকছেদ আলী, মো. মকছেদ আলী, মো. এজাহার আলী, মো. ফজলুল হক, মো. ওসমান আলী, মো. আনছার আলী, মো. আবদুস ছাত্তার, মো. হাফিজুর রহমান, মো. হামিদুল হক ও মো. মখলেসুর রহমান মুকুল। এঁদের সঙ্গে স্থানীয় গাইড হিসেবে ছিলেন মো. আমজাদ হোসেন প্রামাণিক, মো. জাহাঙ্গির ও মো. নুরুজ্জামান সরকার। দ্বিতীয় সেকশনের কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে নাজির আহমেদ ও মো. রবিউল ইসলাম আবু। অন্য সদস্যরা হলেন- মো. লোকমান হোসেন, মো. মোজাম্মেল হক জিপ্পু, মো. সাদেক আলী, মো. ফজলুল হক, মো. জমির উদ্দিন ও মো. আফছার আলী, এবং স্থানীয় গাইড মো. আমির আলী, মো. শুকুর আলী, মো. রফিকুল ইসলাম ও মো. আমজাদ সরদার। তৃতীয় সেকশনের কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে মো. মোজাম্মেল হক ও মো. আব্দুল জলিল মোল্লা। সদস্যরা হলেন- আলাউদ্দিন, মো. জামাল উদ্দিন, ওয়ায়েজ উদ্দিন, হায়দার আলী ও স্থানীয় গাইড শফিউর রহমান শফি।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে বাঘার মাজার প্রাঙ্গণে ইট, কাঠ, টিন ও মাটি দিয়ে সুরক্ষিত মোট ৭টি বাঙ্কার নির্মাণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা রাত ৯টার দিকে অপারেশন শুরু করেন। দুপক্ষে এক ঘণ্টার মতো তুমুল গোলাগুলি হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এক পর্যায়ে রাজাকারদের বাঙ্কারে জেলোটিন বোমা নিক্ষেপ করেন। এতে রাজাকারদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। এরপর তারা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট। আত্মসমর্পণ করে। এ-যুদ্ধে ১ জন রাজাকার নিহত হয় এবং তাদের অনেক অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ অপারেশনটি সফল হওয়ায় এতে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় অধিবাসী, ভারত ও বাংলাদেশের সেনা কর্মকর্তাগণ স্বস্তি পান। এ অপারেশনের পর সম্পূর্ণ বাঘা অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে এ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতাও বেড়ে যায়। [মো. মোস্তফা কামাল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড