You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে বাঘাইছড়ি উপজেলা (রাঙ্গামাটি) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে বাঘাইছড়ি উপজেলা (রাঙ্গামাটি)

বাঘাইছড়ি উপজেলা (রাঙ্গামাটি)বাঘাইছড়ি উপজেলা (রাঙ্গামাটি) ভারতের সীমান্তবর্তী একটি পার্বত্য এলাকা। এর উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম, দক্ষিণে লংগদু ও বরকল উপজেলা, পূর্বে ভারতের মিজোরাম এবং পশ্চিমে দীঘিনালা উপজেলা। এখানকার কাচালং ও শিজক নদী এবং উগলছড়ি বিল ও কাপ্তাই লেক উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৫ সালে বাঘাইছড়ি থানা গঠিত হয়, বর্তমানে এটি উপজেলা। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামান-এর ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে এখানে বসবাসকারী বাঙালি ও স্থানীয় নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাঘাইছড়িতে গঠিত হয় সংগ্রাম কমিটি। এ কমিটির সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগ-এর দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী, আব্দুল লতিফ মুন্সী, বাদল দত্ত, সগীর আহমেদ সওদাগর, শামসুল হুদা, ছাত্রলীগ-এর আব্দুল লতিফ, আব্দুস সবুর, কামাল উদ্দিন, আজিজুর রহমান, বিনয়বরণ চাকমা প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের সহযোগিতায় বাঘাইছড়ি হাইস্কুল মাঠে এলাকার ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। প্রশিক্ষণ দেন ছুটিতে আসা ইপিআর সদস্য ফজলুর রহমান।
২১শে মার্চ কিছু সংখ্যক ইপিআর সদস্য সাজেক বিওপি থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে বাঘাইছড়ি থানায় যাত্রাবিরতি করেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন ছিল অবাঙালি। অন্যান্য ইপিআর সদস্যদের সহযোগিতায় কৌশলে অবাঙালি ইপিআরদের অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়। অবাঙালি ইপিআরদের থানা হেফাজতে রেখে বাঙালি ইপিআররা পরদিন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু থানার ভারপ্রাপ্ত অবাঙালি কর্মকর্তা তাদের ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করলে ২৬শে মার্চ স্থানীয় মুক্তিকামী জনতা থানা ঘেরাও করে তাদের হত্যা করে।
উপজেলায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন অজ্ঞজয় মারমা (খাগড়াছড়ি; সাবেক যুগ্ম-সচিব) এবং মো. মোমিনুল ইসলাম (রংপুর)।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী দীঘিনালা হয়ে বাঘাইছড়িতে অনুপ্রবেশ করে এবং কাচালং নদীর পশ্চিম তীরে মরিশ্যা রেস্ট হাউজে পাকবাহিনী ও মরিশ্যা ক্লাবে পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে মিজো বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে।
বাঘাইছড়িতে পাকিস্তানপন্থী মিজোবাহিনীর তৎপরতা ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাদের বাংলাদেশ-বিরোধী তৎপরতা আরো বেড়ে যায় এবং তাদের পাশাপাশি আব্দুর রাজ্জাক মাস্টার (মারিশ্যা)-এর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি – ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এ দু-বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আব্দুল হামিদ (বাঘাইছড়ি), আব্দুল মোতালেব (লাল্যাঘোনা), আব্দুর রশিদ (লাল্যাঘোনা), আহম্মদ মিয়া ফকির (উঘলছড়ি), শহর মুল্লুক (মুসলিমপাড়া), ভুবনেশ্বর চাকমা (বাঘাইছড়ি) উল্লেখযোগ্য। মরিশ্যা ক্লাবটিকে মিজোবাহিনী নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত।
২২শে নভেম্বর কাচালং নদীর পশ্চিম তীরের যুদ্ধের সময় দূরছড়ি গ্রামের মোস্তাফা খাতুন (স্বামী নাজিরুজ্জমান), চিনু ভট্টাচার্য (পিতা বগলা ভূষণ ভট্টাচার্য) ও সোনা বড়ুয়া (পিতা রুহিনী রঞ্জন বড়ুয়া) নামে তিনজন গ্রামবাসী পাকবাহিনী ও মিজো বাহিনীর গুলিতে মারা যান।
২২শে নভেম্বর কাচালং নদীর পশ্চিম তীরে দূরছড়ি বাজারে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর মিজো বাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনীর তিব্বতীয় রেজিমেন্টর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা কাচালং নদীতীর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনী ও মিজো বাহিনী পরাজিত হয়। তবে ৩ জন সাধারণ লোক ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর দুজন যোদ্ধা শহীদ হন। ২২শে নভেম্বর বাঘাইছড়ি উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়। [স্বপন কুমার দে]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড