You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাঘাবাড়ি প্রতিরোধযুদ্ধ (শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ)

বাঘাবাড়ি প্রতিরোধযুদ্ধ (শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ) সংঘটিত হয় ২২-২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত। প্রতিরোধযোদ্ধারা এখানে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুললেও পাকবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে এক পর্যায়ে তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হন। শাহজাদপুর উপজেলা ও সিরাজগঞ্জ সদরে যাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বাঘাবাড়িতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। এটি উত্তরবঙ্গের একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ প্রচেষ্টা হিসেবে খ্যাত। সিরাজগঞ্জের একেবারে দক্ষিণে শাহজাদপুর থানার শেষ প্রান্তে বড়াল নদীর তীরে বাঘাবাড়ি অবস্থিত। ঢাকা থেকে নগরবাড়ি হয়ে সিরাজগঞ্জে প্রবেশে প্রথমে পড়ে বাঘাবাড়ি ফেরিঘাট। এ ফেরি পার হয়ে সিরাজগঞ্জ তথা উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করতে হয়। তাই শাহজাদপুর ও সিরাজগঞ্জকে রক্ষা করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল বাঘাবাড়িকে নিরাপদ রাখা। এ-সময় সিরাজগঞ্জের এসডিও এ কে শামসুদ্দিনের তত্ত্বাবধানে বাঘাবাড়িতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়।
৯ই এপ্রিল মহকুমা প্রশাসক এ কে শামসুদ্দিন, আব্দুল লতিফ মির্জা, মোজাফফর হোসেন মোজাম, লুৎফর রহমান অরুণ, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ল্যান্স নায়েক মহিউদ্দিন, বাকসু-র জিএস আবদুস সামাদ-সহ অন্য নেতৃবৃন্দ এবং ইপিআর-এর বাঙালি সৈন্য, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর প্রায় ১০০ যোদ্ধা রাত ১২টার দিকে বাঘাবাড়ি আসেন। বাঘাবাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। বাঘাবাড়িতে তখন ব্রিজ ছিল না। ফেরিঘাট ছিল এবং ফেরিতে করে নদী পাড় হতে হতো। মুক্তিযোদ্ধারা ফেরিঘাটের ডানে-বাঁয়ে বাংকার করে পজিশন নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ট্রেঞ্চের নিরাপদ বেষ্টনী দেয়ার জন্য বস্তার প্রয়োজন হয়। এ কে শামসুদ্দিন শাহজাদপুরের ছাত্রনেতা শহিদুজ্জামান হেলাল এবং অধ্যাপক শরফুদ্দিন আউয়ালকে শাহজাদপুরের গোডাউন থেকে বস্তা আনার জন্য একটি জিপ দেন। রাত ৪টার দিকে তাঁরা গোডাউন থেকে ৫০টি বস্তা আনেন। শামসুদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্সে রেখে সিরাজগঞ্জ যান। পরদিন ইপিআর, পুলিশ, আনসার, বেঙ্গল রেজিমেন্ট মিলে আরো ১৫০ মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি সেখানে পাঠান। উল্লাপাড়া, বাঘাবাড়ি ও শাহজাদপুরের অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও সেখানে যোগ দেন। প্রতিরোধে অংশ নেয়া শাহজাদপুরের মুক্তিযোদ্ধা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন অধ্যক্ষ তাহাজ্জত হোসেন, অধ্যাপক শরফুদ্দিন আউয়াল, সৈয়দ হোসেন মনসুর এমএনএ, মো. আব্দুর রহমান এমপিএ, মির্জা আব্দুল বাকী, শাহিদুজ্জামান হেলাল, কোরবান আলী, আব্দুল গফুর সরবত, ফেরদৌস হোসেন ফুল, গোলাম আজম (মওলা), মিজানুর রহমান, মো. গোলাম মোস্তফা হিলালী, হাসিবুর রহমান স্বপন, আজাদ শাহ নেওয়াজ ভূঁইয়া, আজাদ রহমান শাজাহান, হালিমুল হক মিরু (নলুয়া, শাহজাদপুর), আবুল হোসেন, মো. সাইফুদ্দিন তারা (দ্বারিয়াপুর), নেয়ামুল ওয়াকিল খান আওরঙ্গ (দ্বারিয়াপুর), আ ন ম হাবিবুল হক হাবিব, ফকরুল ইসলাম প্রমুখ। এছাড়া শাহজাদপুরের সর্বস্তরের মানুষ যার যা আছে তা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। কাছের এবং দূরের গ্রাম থেকে সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করে খাবার নিয়ে আসত। অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রুটি-চিড়া-গুড় নিয়ে আসে। কেউ-কেউ লাঠি, কারাইল, বেত, বাঁশ নিয়ে হাজির হয়।
নদীর উত্তর পড়ে প্রায় দুই মাইল জুড়ে ২০০ গজ পরপর পাকা মরিচা খনন করে সেখানে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করা হয়। সিরাজগঞ্জ থেকে আনোয়ার হোসেন রতু বাঘাবাড়িতে লতিফ মির্জা, ইসমাইল প্রমুখের কাছে টাকা পাঠাতেন আব্দুল লতিফ মির্জা, আমীর হোসেন ভুলু প্রমুখ নেতৃত্ব দিয়ে বাঘাবাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করেন। তারা ফেরিঘাটের অপর পাড়ে অবস্থান নেন। বাঘাবাড়ি, শাহজাদপুর এবং পাশের গ্রামগুলোর শতশত নারী-পুরুষ কোদাল, শাবল, টুকরি ইত্যাদি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কাঁধে কাঁধ চ মিলিয়ে কাজ করে, বাংকার খোঁড়ে। এ-সময় বাঘাবাড়িতে ছিলেন সিরাজগঞ্জ-শাহজাদপুরসহ সমগ্র জেলার নেতৃবৃন্দ। শাহজাদপুরের আব্দুর রহমান এমপিএ আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাহায্যে পারাপারে ব্যবহৃত সমস্ত ফেরি এবং নৌকা সরিয়ে ফেলেন যাতে শত্রুরা সহজে নদী পার হয়ে আসতে না পারে। এখানে দুই সপ্তাহের বেশি সময় মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করেন। প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা এ ডিফেন্সে অংশ নেন। তাঁদের হাতে ৬৭টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ১৪টি বন্দুক, ৩টি এলএমজি, ১টি আরএল, ৪টি স্টেনগান ও ১টি দেশী কামান ছিল। ডিফেন্সে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধারা পালাক্রমে বাঘাবাড়ি অবস্থানে ছিলেন। স্বাধীন বাংলার সরকার গঠিত হলে নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়। বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য মানুষজন নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে। ১৯শে এপ্রিল ডাববাগান যুদ্ধের পর অনেক মুক্তিযোদ্ধা এদিকে আসায় বাঘাবাড়ির প্রতিরোধ আরো শক্তিশালী হয়।
২২শে এপ্রিল বিকেলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঘাবাড়ির ওপর আক্রমণ করে। তারা ফেরির দক্ষিণ পাড়ের রাস্তার দুই পাশে অবস্থান নেয়। পাকসেনারা ২ ইঞ্চি মর্টার, মেশিনগান এবং ভারি আর্টিলারির ফায়ার শুরু করে। তাদের নিক্ষিপ্ত মর্টার শেল শাহজাদপুরের ডায়য়া গ্রামের মাঠ, নরিনা খেয়াঘাট, বগাই বিল এবং বাঘাবাড়ির পূর্বদিকে এসে পড়ে। মর্টারের বিকট আওয়াজে অনেক মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালাতে থাকে। এদিন পাকিস্তানি সেনারা নদী পার হতে পারেনি। তবে প্রচণ্ড চাপের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা ডিফেন্স প্রত্যাহার করেন। এ-সময় অনেকে উল্লাপাড়া চলে যান। ভারত থেকে ফিরে এসে এসডিও এ কে শামসুদ্দিন, মোজাফফর হোসেন মোজাম, গাজী আনোয়ারুল ইসলাম মাখন প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং তখন তাঁরা উল্লাপাড়া বাজারে অবস্থান করছিলেন। বাঘাবাড়ির খবর শুনে এসডিও শামসুদ্দিন শাহজাদপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তালগাছির কাছাকাছি আসার পর তাঁরা কিছু ইপিআর সদস্যের সম্মুখীন হন। তাঁদের কাছ থেকে বাঘাবাড়ির পরিস্থিতি অবহিত হয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ ইপিআর সদস্যদের নিয়ে বাঘাবাড়ির দিকে রওনা দেন। বাঘাবাড়ি ঘাটের কাছে একটি বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা তৌহিদ ও জিন্নাহকে পান। তাঁদের সঙ্গে নিয়ে বাংকারের দিকে গিয়ে দেখেন অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ফেলে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। তখন তিনি এবং মোজাফফর হোসেন মোজাম মুক্তিবাহিনী, আনসার ও পুলিশ সদস্যদের ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে মাইকিং করানো হয়। এর ফলে অনেকে ফিরে আসেন। শামসুদ্দিন তাঁদের বুঝিয়ে আবার বাংকারে পজিশন নিতে বলেন। তিনি যে-কোনো মূল্যে শত্রুকে মোকাবেলা করতে এবং কোনোক্রমেই এ স্থানকে পলাশির প্রান্তর হতে দেয়া যাবে না বলে উদ্দীপনাময় বক্তব্য রাখেন। তারপর আনসার, পুলিশ এবং মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নেন। তাঁরা পজিশন নেয়ার দুই/আড়াই ঘণ্টা পর শামসুদ্দিন সিরাজগঞ্জ যান। তিনি সিরাজগঞ্জ এসে স্থানীয়ভাবে তৈরি করা দুটি কামান পরীক্ষা করে দেখেন। দেখা যায় ৩০০ থেকে ৪০০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত এগুলো থেকে গোলা নিক্ষেপ করা যায়। ২৩শে এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে শামসুদ্দিন কামান দুটিসহ তৌহিদ, জিন্নাহ ও বাবলুকে নিয়ে বাঘাবাড়ি যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন। ২৪শে এপ্রিল পর্যন্ত বাঘাবাড়িতে লতিফ মির্জা ও ইসমাইলের কাছে প্রয়োজনীয় টাকা ও রাইফেলের গুলি প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। এদিকে ২৩শে এপ্রিল মোতাহার হোসেন তালুকদার এমএনএ, দবির উদ্দিন আহম্মদ এমপিএ, সৈয়দ হায়দার আলী এমপিএ, আব্দুল মমিন তালুকদার এমএনএ, শহিদুল ইসলাম, রওশনুল হক এমপিএ, ড. আবু হেনা এমপিএ, আনোয়ার হোসেন রতু, আমির হোসেন ভুলু এবং আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আবার বাঘাবাড়িতে যান। ২৫শে এপ্রিল সকাল ৯টায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কামান, মর্টার, মেশিনগান ও চাইনিজ রাইফেল দিয়ে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ শুরু করে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে ভেঙ্গে যায়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। [মাহফুজা হিলালী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!