You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বাঘারপাড়া উপজেলা (যশোর)

বাঘারপাড়া উপজেলা (যশোর) বাঘারপাড়া থানার মানুষ নীলচাষ বিরোধী আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন প্রভৃতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
মার্চ মাসে সমগ্র দেশের মতো যশোরে অসহযোগ আন্দোলন- শুরু হলে এর ঢেউ বাঘারপাড়ায়ও পৌঁছে। ৩রা মার্চ যশোরে চারুবালা কর (গৃহিণী; পাকসেনাদের গুলিতে নিহত) শহীদ হবার পর বাঘারপাড়ার ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। সাতই মার্চের ভাষণ-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- স্বাধীনতার ডাক দিলে এলাকার তরুণ ও ছাত্র-জনতা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত হতে থাকে। যশোর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের জন্য ব্যাপক লোকসমাগম করতে বাঘারপাড়া থানা আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি মাস্টার মোমিন উদ্দীন, আওয়ামী লীগ নেতা সদর উদ্দীন ও সোলায়মান হোসেন (ইন্দ্রা) গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। এছাড়া কওসার পারভেজ, ডা. আবু বক্কার, আব্দুল আজিজ বিশ্বাস, ফসিয়ার, মোশারেফ হোসেন (কড়ইতলা), বাবর আলী, (ধূপখালী), হাসান আলী (ইন্দ্রা), মহতাপ মোল্লা (দোহাকুলা), আবীর শিকদার, হোসেন আলী(দোহাকুলা), তোজাম্মেল হোসেন প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। বৃহত্তর যশোর জেলা ছাত্রলীগ নেতা রবিউল আলম, টিপু সুলতান, আলী হোসেন মণি ও আব্দুল হাইয়ের নেতৃত্বে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম চলে। ছাত্রলীগের পক্ষে বাঘারপাড়ারসোলাইমান হোসেন (ইন্দ্রা), সোলাইমান হোসেন (মহিরোণ) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য অবদানরাখেন। ৯ই মার্চ থেকে ৪ঠা এপ্রিলের মধ্যে বাঘারপাড়ার ছাত্র-যুবক ও কৃষক-শ্রমিকদের অনেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। গোপনে এখানে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠে। এখানকার প্রশিক্ষণ শেষে অনেকে অধিকতর ও উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান, আয়েন উদ্দিন, হাসান আলী, হোসেন আলী, প্রশিক্ষক কাওসার আলী উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যান। নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের শ্রীরামপুর স্কুল ও মালঞ্চির সিদ্দিকের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি ক্যাম্প ছিল। মালঞ্চি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো এবং শ্রীরামপুর ক্যাম্প থেকে অপারেশন পরিচালনা করা হতো। বাঘারপাড়ায় আনসার বাহিনীর সদস্য কাওসার মালঞ্চি ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল চালনার প্রশিক্ষণ দেন। এ ক্যাম্পে সেনাসদস্য আকমল হোসেন মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেনেড ব্যবহার ও থ্রি-নট- থ্রি রাইফেল চালনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন।
যশোর জেলায় বিএলএফ-এর প্রধান ও উপপ্রধান ছিলেন যথাক্রমে আলী হোসেন মনি ও রবিউল আলম। বাঘারপাড়ার দায়িত্বে ছিলেন রাজেক আহম্মেদ। আব্দুর রাজ্জাক, মাস্টার গোলাম আকবর এবং আব্দুল আজিজ বাঘারপাড়ার গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পাকবাহিনীর আসার খবর শুনে বাঘারপাড়ার সংগ্রামী জনতা শেখের হাটখোলা ব্রিজের পাশে অবস্থান নেয়। কিন্তু সেদিন পাকবাহিনী বাঘারপাড়ায় প্রবেশ করেনি। সেই সময় জনতার সঙ্গে সদর উদ্দীন, আব্দুল আজিজ বিশ্বাস, মোশারেফ হোসেন, আনছার প্রমুখ নেতা উপস্থিত ছিলেন। পাকসেনা ও তাদের সহযোগীদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাঘারপাড়া-নারিকেলবাড়িয়া সড়কের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বংস করা হয়।
মে মাসে পাক হানাদার বাহিনী বাঘারপাড়ায় অনুপ্রবেশ করে। তারা রাজাকার ও আলবদরদের নিয়ে থানার সিইও অফিস ও তার বাসভবনে ক্যাম্প করে। তবে এখানে পাকবাহিনী স্থায়ীভাবে থাকত না। নারিকেলবাড়িয়া, প্রেমচারা, খাজুরা ও রায়পুর বাজারে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল।
এপ্রিল মাসের শেষভাগে বাঘারপাড়ায় থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। মে মাসের প্রথমদিকে কিছু লোক আলবদর ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। বাঘারপাড়ার কুখ্যাত রাজাকাররা হচ্ছে— নারকেলবাড়িয়া ক্যাম্পের কমান্ডার পীর শামসুর রহমান, শামসুর রহমান, আকবর, মোহম্মাদ ওদুদ, কামেশ আলী, আরসাদ আলী, সিদ্দিক আহম্মেদ, ইসাহাক, দকির আহম্মেদ, আব্দুল মজিদ, মতিয়ার বিশ্বাস, মেলাই বিশ্বাস, ডাক্তার জলিল, হাসেম বিশ্বাস, লাল মিয়া, ইসাহাক আলী, রুহুল আমিন, মোনতাজ মোল্লা, নসীম সরদার, ওসমান গনি, আলতাব হোসেন, ওদুদ প্রমুখ।
প্রেমচারা ক্যাম্পের রাজাকারদের মধ্যে ছিল- নওশের আলী, ইদ্রিস হোসেন, মোজাম বিশ্বাস প্রমুখ। রায়পুর ক্যাম্পের কুখ্যাত রাজাকাররা হচ্ছে- আব্দুল খালেক, হাবিবুর রহমান, মাহামুদুর রহমান প্রমুখ।
খাজুরা ক্যাম্পের রাজাকার কমান্ডার ছিল ডাক্তার ইব্রাহিম। ইব্রাহিমের সহযোগীদের মধ্যে ছিল- কাঠুরাকান্দির হেকমত আলী, মোসলেম আলী, আমজাত আলী, লিয়াকত আলী, হাবিবর মোল্লা, ফসিয়ার মোল্লা; যাদবপুরের আব্দুর রহমান, মোশারেফ মুন্সী; মথুরাপুরের সিরাজ কাজী, সেকেন্দারপুরের সমির উদ্দিন, হাসান আলী; কৃষ্ণপুরের কাদের ড্রাইভার, হলিহট্টের রুহুল আমীন, চাপাতলার সিদ্দিকুর রহমান, চণ্ডিপুরের নাসির, হাকিম লস্কর, চোট খুদরার জুলফিকার- সহ অন্যরা।
বাঘারপাড়ার উল্লেখযোগ্য অন্য রাজাকারদের মধ্যে ছিল— মনসের আলী, ইউসুফ আলী, আতিয়ার মৌলভি, লাল মাহমুদ, নাসির উদ্দিন, আব্দুল কাদের, জুলফিকার আলী জুলাই, নুরুল ইসলাম, হেকমত আলী, জাকির হোসেন, আসরাফ আলী, জবেদ আলী গোলদার, মশিউল আজম, আফসার আলী কারী, আতর আলী, সবেদ আলী, আমির উদ্দিন, রহমত উল্লা, ওলিয়ার রহমান, আমির হোসেন, ইদ্রিস মোল্লা, আব্দুস সালাম, আব্দুর রউফ, বদর মণ্ডল, ওহেদ আলী, মোরেজ আলী, জহিরুল হক, সোনা উল্লা, মকবুল, মোকলেস আলী, আবু তালেব, আব্দুল হামিদ, নাসির হায়দার, এবাদত মোল্লা, আব্দুর রাজ্জাক, লুৎফর রহমান, হাফিজুর রহমান, নুর বকস, জালালউদ্দিন, আলতাব বিশ্বাস, আবুল কালাম, ফজলুর রহমান, আমির আলী, সোহরাব প্রমুখ। এদের ছাড়াও এখানে আরো প্রায় ২০০ রাজাকার ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস রাজাকাররা বাঘারপাড়ায় নারকীয় তাণ্ডব চালায়। তারা বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারীধর্ষণ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। বাঘারপাড়ার রাজাকাররা এ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষদের অনেককে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। এলাকার প্রায় সব গ্রামে রাজাকারদের বর্বরতার চিহ্ন রয়েছে।
বাঘারপাড়া এলাকায় রাজাকাররা কমপক্ষে ১৫০০ মানুষকে হত্যা করে। এরা স্বামী-স্ত্রীকে হত্যা করে একজনের লাশ অপর জনের ওপর উলঙ্গ অবস্থায় ফেলে রাখে। এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে তার গোপনাঙ্গ কেটে মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে সেই লাশ ভেলায় ভাসিয়ে দেয়। এলাকার রাজাকাররা হত্যাকাণ্ড ছাড়া নিরীহ মানুষের ওপর নানা রকম অত্যাচার, জুলুম ও পাশবিকতা চালিয়েছে। তারা দেশে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও অন্যান্য দলের নেতা-কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে পাকবাহিনীকে সরবরাহ করত। অনেক জায়গায় তারা ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নারীদের ধর্ষণ করে। অনেক নারীকে পাকসেনাদের কাছে হস্তান্তর করে। এসব নারী হানাদারদের আস্তানায় পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। তারা বেয়নেট ও রাইফেলের মুখে অনেক নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটায়। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর তারা বিশেষভাবে নির্যাতন চালায়। তারা গ্রামের পর গ্রামে লুণ্ঠন চালিয়ে মানুষের সম্পদ কেড়ে নেয়।
রাজাকাররা নারকেলবাড়িয়া ক্যাম্পে আজিজ আহম্মদ, আরশাদ আলী, একরাম আলী, দেদার উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন, আবদুল ওদুদ (ক্ষেত্রপালা), জমির হোসেন, আব্দুল বারি, মোজাম্মেল হক (ধূপখালি), সোওরাব হোসেন (মালঞ্চি), আবু বক্কর (বলরামপুর), সোকির আহম্মদ, নুর মহম্মদ (খানপুর) প্রমুখকে হত্যা করে। প্রেমচারা রাজাকার ক্যাম্পে হত্যা করা হয় সিরাজুল ইসলাম মাস্টার, সাখাওয়াত হোসেন, আবুল হোসেন, আফসার বিশ্বাস, রহম আলী (প্রেমচারা), সুরত আলী বিশ্বাস, মোক্তার আলী (গাইদঘাট), রজব আলী, চাঁদ আলী, চাঁদ আলীর স্ত্রী (পিয়ারপুর), আবদুল মান্নান (আড়োকান্দি), সিরাজুল ইসলাম ও তার পিতা (শতখালি), আইনাল (উত্তর চাঁদপুর), তারাপদর স্ত্রী (নিমটা), বরিশালের ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা নওশের-এর মা-বাবা, নিয়ামত আলী, হাফিজুর, শামসুর (ভবানীপুর)-কে। এছাড়া রাজাকাররা শোভন মল্লিক, ইসমাইল হোসেন (সেকেন্দারপুর), মোসলেম আলী, মোকাম আলী (আজমপুর), আবদুল আজিজ (চণ্ডিপুর), সুরত আলী, মোক্তার আলী, আইনাল হোসেন (গাইদঘাট), জগবন্ধু তরফদার ও তার স্ত্রী (রামকৃষ্ণপুর), সরাফত আলী, বজলুল রহমান, আবদুল আলিম, ওদুদ মিয়া (নলডাঙ্গা), মোশারফ আলী (কয়েলখালি), জাহাঙ্গীর আলম (কৃষ্ণনগর), নুর ইসলাম (আজমখালী), কাওসার আলী (লক্ষীপুর), ইমান আলী, ইসহাক আলী, সুরত আলী (দেয়ারা), হাসেম আলী, বান্দা আলী (রায়পুর), আবদুল লতিফ আলী, আব্দুল জব্বার (মনোহরপুর), ডাক্তার আব্দুল কাদের, লক্ষণ পরামানিক, দুই সহোদর মুক্তিযোদ্ধা ময়েন উদ্দিন ময়না ও আইন উদ্দিন আয়না (খাজুরা) প্রমুখকে হত্যা করে। নাম ও পরিচয় জানা যায়নি এমন অনেক মানুষও রাজাকারদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।
এপ্রিলের প্রথমদিকে পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বাঘারপাড়ার গ্রামে-গ্রামে তল্লাশি চালায়। তারা বাঙালি সেনাসদস্য মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দীনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
যশোর-মাগুরা সড়কের পাশে বাঘারপাড়া উপজেলার খাজুরা বাজার একটি উল্লেখযোগ্য জনপদ। খাজুরা ক্যাম্পের রাজাকার কমান্ডার ইব্রাহিম নিজেকে ওসি বলে পরিচয় দিত। সে জুলাই মাসে জামায়াতে ইসলামী-র ২৫ জন নেতা- কর্মী নিয়ে একটি বিশেষ রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলে। তারা এম এন মিত্র স্কুলে ক্যাম্প ও নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপন করে। প্রথমদিকে রাজাকাররা চিত্রা নদী পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করার সাহস পায়নি। কিন্তু এ ক্যাম্প স্থাপনের পর তাদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পায়। এলাকার মানুষের ওপর তাদের অত্যাচারের মাত্রাও বাড়তে থাকে। এ কেন্দ্রে নির্যাতন চালিয়ে শতাধিক বরেণ্য ব্যক্তি, মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষকে তারা হত্যা করে। নির্যাতনকেন্দ্রে মানুষদের কয়েকদিন আটক রেখে জবাই করে হত্যা করে লাশ চিত্রা নদীতে ফেলে দিত। এখানে রাজাকাররা প্রথমে এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি ডাক্তার আব্দুল কাদের ও লক্ষ্মণ পরামানিককে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধা ময়েন উদ্দিন ময়না ও আইন উদ্দিন আয়নাকে হত্যা করে। চণ্ডিপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আজিবরকে ধরে নিয়ে তাঁর ওপর নির্যাতন চালায়। এরপর তাঁকে টুকরো-টুকরো করে হত্যা করে। আজিবরের গোপনাঙ্গ কেটে তার মুখে ঢুকিয়ে লাশ ভেলায় করে চিত্রা নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা ফরিদপুর যাওয়ার সময় কাঠুরাকান্দি গ্রামের পালবাড়ি ঘাটে রাজাকারদের সহযোগী আলী আহমদ তাঁদের দেখে ফেলে। সে মুক্তিযোদ্ধাদের মিথ্যা কথা বলে একটি ঘরে নিয়ে আসে। কৌশলে তাঁদের অস্ত্র অন্য ঘরে রেখে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীকে খবর দেয়। রাজাকার কমান্ডার ইব্রাহীম তার দলবল নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে যায়। তাঁদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। কয়েকদিন নির্যাতন চালিয়ে ২২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনা কাঠুরাকান্দি মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। বাঘারপাড়ার দৌলতপুর গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার আব্দুল খালেক বাঘারপাড়া-রায়পুর রাজাকার ক্যাম্পের কমান্ডারের দায়িত্বে ছিল। সে তার বাহিনী নিয়ে পুরো এলাকায় নৃশংসতা ও নারকীয়তার নতুন-নতুন নজির স্থাপন করে। তার নেতৃত্বে রাজাকাররা রামকৃষ্ণপুর গ্রামের জগবন্ধু ও তার স্ত্রীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এখানে তারা এক লোমহর্ষক ঘটনা ঘটায়। জগবন্ধুর বাড়ির উঠানে প্রথমে তার স্ত্রীর স্তন কেটে উল্লাস করে। এরপর স্বামী-স্ত্রী দুজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তারা মৃতদেহগুলো উলঙ্গ করে একজনের দেহ অন্যজনের ওপর ফেলে রেখে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দেয়।
নলডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফকে দৌলতপুরের রাজাকার খালেক, কৃষ্ণনগরের ধলু ও রায়পুরের ওমর ধরে রায়পুর রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এরপর তিনদিন ধরে তাঁর ওপর অত্যাচয়ে ঢ্যাপাখালী গ্রামে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। একই গ্রামের সরাফত আলী, বজলুর রহমান ও আব্দুল আলীমকে রাজাকাররা রায়পুর বাজারের পূর্বপাশে মশারিরদাড় এলাকায় এনে হত্যা করে। রাজাকাররা গাইদঘাট গ্রামের সুরত আলী, তার ভাইপো মোক্তার আলী ও আইনাল হোসেনকে খাজুরা ক্যাম্পে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে। আজমপুর গ্রামের দুই সহোদর মোসলেম আলী ও মোকাম আলীকেও তারা নির্মমভাবে হত্যা করে।
২৫শে জুন মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রীরামপুর ক্যাম্পের পাশের এক বাড়িতে অবস্থানকালে মুক্তিযোদ্ধা হালিমার সঙ্গে সোহরাব (মালঞ্চি), বিনয়, কোরবান (হাসিনার ফুফাতো ভাই), ফাতেমা ও রোকেয়া ধরা পড়েন। হানাদাররা গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে তাঁদের বাঘারপাড়া পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এ ক্যাম্পে অন্যদের সামনে কোরবান ও সোহরাবকে গুলি করে হত্যা করে। অন্যদের যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। তিনজনকে ক্যান্টনমেন্টে পৃথক স্থানে বন্দি করে রাখা হয়। বর্তমান উপজেলা পশু হাসপাতাল ও প্রধান নির্বাহীর বাসভবন, নারিকেলবাড়িয়া রাজাকার ক্যাম্প, প্রেমচারা ক্যাম্প, খাজুরা ক্যাম্প ও রায়পুর ক্যাম্প পাকবাহিনী ও রাজাকারদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল। এসব স্থানে অগণিত মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।
উপজেলার বর্তমান কবর স্থান, চিত্রা নদীর শ্মশানপাড়, খাজুরা এম এন মিত্র স্কুল গোডাউনের পেছনে প্রবাহিত চিত্রা নদীর পাড়, রায়পুর মশারিরদাড়, শুঢ়া বাগডাঙ্গা, নারিকেলবাড়িয়া চিত্রা নদীর পাড়, বাঘারপাড়া দোহার ভিতর, জহরপুর রামগোপাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পেছনের স্থান, মহিরণ কওমি মাদ্রাসার পার্শ্ববর্তী জায়গা ইত্যাদি স্থানে বধ্যভূমি ও গণকবর ছিল। মহিরণ গ্রামের উত্তর প্রান্তে তিন বীর শহীদের গণকবর রয়েছে।
বাঘারপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনী ও রাজাকার আলবদর বাহিনীর অনেক যুদ্ধ হয়। ২৯শে মার্চ সকালে খন্দকার আব্দুল হাফিজ এমএনএ, এস এম মতিউর রহমান এমপিএ, শাহিদ আলী খান এমপিএ, আওয়ামী লীগ নেতা এখলাসউদ্দীন, বি এম মতিউর রহমান, প্রফেসর নূর মোহাম্মদ প্রমুখের নেতৃত্বে যশোর সেনানিবাস আক্রমণের লক্ষ্যে নড়াইল থেকে একটি মিছিল যশোরের দিকে রওনা হয়। এ মিছিলে বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জ থেকে অসংখ্য মানুষ অংশগ্রহণ করে। মিছিলটি চাড়াভিটা বাজারে পৌঁছলে লে. মতিউর রহমান ও প্রফেসর নূর মোহাম্মদের নেতৃত্বে মিছিলের একটি অংশ বাঘারপাড়া থানা ঘেরাও করে। ঘেরাওয়ের মুখে থানায় অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে। তারা ১৬টি রাইফেল ও অন্যান্য অস্ত্র লে. মতিউর রহমান ও প্রফেসর নূর মোহাম্মদের কাছে হস্তান্তর করে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (ইপিসিপি-এমএল)-এর নেতা-কর্মীরা একত্রিত হয়ে খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। বেশ সময় ধরে এ আক্রমণ চলে এবং রাজাকাররা ক্যাম্পে হতাহত হয়। কিন্তু সেদিন রাজাকার ক্যাম্পের পতন ঘটেনি। এ-যুদ্ধে ইপিসিপি কর্মী মিজান শহীদ হন।
মে মাসের প্রথম দিকে রাজাকার ও পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মালঞ্চি ক্যাম্প থেকে ২৬-২৭ জন যোদ্ধা এতে অংশ নেন। পাকবাহিনী যুদ্ধে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। এক সময় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে মালঞ্চি ক্যাম্পে ফিরে যান। তিনদিন পর রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের এ ক্যাম্প ঘেরাও করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে মক্তিযোদ্ধা গোলাম সরোয়ার গুলিবিদ্ধ হন। মুক্তিযোদ্ধারা পার্শ্ববর্তী শেখের বাতান গ্রামে আশ্রয় নেন। সকাল ১০টার দিকে এখানে আবার যুদ্ধ হয়। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান বদল করতে বাধ্য হন। শ্রীরামপুর স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় ক্যাম্প ছিল। এখানে সংগঠিত হয়ে তারা বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ পরিচালনা করতেন। মে মাসের শেষে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের এ ক্যাম্পে হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। রাজাকার জয়নাল আবেদিন (পিতা ফটিক মোল্লা, দোহাকুলা) এ-যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়।
২৯শে মে সকালে থানা রাজাকার ক্যাম্পে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ ও ইপিসিপি-র যুদ্ধ হয়। গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। তিনজন মুক্তিযোদ্ধা পাইপ বেয়ে থানার খোলা ছাদে ওঠেন তারপর পাহারারত রাজাকারদের লক্ষ করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। কয়েকটি গ্রেনেড চার্জ করা হয়। কিন্তু সেগুলো বিস্ফোরিত হয়নি। পাহারারত রাজাকাররা গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকেও গুলি করা হয়। এতে একজন রাজাকার নিহত হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাইপ বেয়ে নামতে থাকেন। কেউ পাইপের মাঝামাঝি, কেউ নিচে থাকা অবস্থায় রাজাকাররা এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। গুলিতে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— শামসুর রহমান (গোপালপুর, রামনগর ইউনিয়ন, যশোর সদর), বজলুর রহমান বিশ্বাস (নলডাঙ্গা, রায়পুর ইউনিয়ন, বাঘারপাড়া) এবং রতন কুমার (নড়াইল, মূল বাড়ি আশোকনগর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)। এ-যুদ্ধে সোলায়মান হোসেন, ওসমান, আকমল, কওসার, সেহরাব, বিমল, লতিফ, মোজাহার, প্রদীপ, অরবিন্দ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাও অংশগ্রহণ করেন।
বাঘারপাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে হালিমা (পিতা ইসরাইল বিশ্বাস, ইন্দ্রা), ফাতেমা (পিতা সৈয়দ আলী মীর, ইন্দ্রা), রোকেয়া (পিতা সেলু কারিগর, মালঞ্চি) প্রমুখ নারী মুক্তিযোদ্ধা স্মরণীয় হয়ে আছেন। এঁরা অস্ত্রহাতে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সে অবস্থায় ধরা পড়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণও থেকেছেন। ২৫শে জুন শ্রীরামপুর ক্যাম্পের পাশের এক বাড়িতে অবস্থানের সময় হানাদাররা হালিমা-সহ অন্য কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে ঘিরে ফেলে। তারা ভারী অস্ত্রের গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও প্রাণপণ লড়তে থাকেন। তাঁদের কাছে থাকা রাইফেলের ৫০টি গুলি শেষ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে হালিমা অন্য কয়েকজনসহ হানাদারদের হাতে ধরা পড়েন। উল্লেখ্য যে, হালিমা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁকে ধরার জন্য পাকসেনারা ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। রায়পুর বাজার ছিল রাজাকারদের ঘাঁটি। নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের মহিরন ও শ্রীরামপুর গ্রামে রাজাকার ও পাকিস্তানিদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক যুদ্ধ হয়। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় ১০৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের শ্রীরামপুর-মালঞ্চি স্কুল মাঠে আটক করে তাঁদের কাছে থাকা ভারী অস্ত্র কেড়ে নেয়। এদিন রাতে অর্ধ সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে তারা গুলি করে হত্যা করে। বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের তারা যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শ্রীরামপুর-মালঞ্চি মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকাণ্ড হিসেবে পরিচিত। ১০৫ জন মুক্তিযোদ্ধার প্রায় সবাই ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত। এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মিত্রবাহিনী – ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর তপনের নেতৃত্বে একটি দল গঠন করা হয়। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে এ দল ১১ই নভেম্বর বাংলাদেশে প্রবেশ করে যশোর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অবস্থান নেয়। এরপর ৬ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীকে হটিয়ে তাঁরা যশোর মুক্ত করেন।
৭ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে খাজুরার পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীকে আক্রমণ করে। এখানে দুপক্ষের মধ্যে দুঘণ্টা যুদ্ধ চলে। খাজুরা যুদ্ধ এ মিত্রবাহিনীর ৭ জন সৈনিক ও ১৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপর পক্ষে অনেক পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। বাঘারপাড়া এলাকায় কমিউনিস্ট নেতা আব্দুল হক (খড়কী, যশোহর)-এর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (ইপিসিপি-এমএল)-এর কার্যক্রম ছিল। এ পার্টি সাধারণভাবে ‘নকশাল’ বলে পরিচিত ছিল। এদের কৌশল ছিল গোপন সংগঠন গড়ে জনযুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা। বাঘারপাড়ায় বিশ্বনাথ বসু ও মো. মুসার নেতৃত্বে তাদের কার্যক্রম চলছিল।
মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে আসার পূর্বে ইপিসিপি (এমএল) দখলদার পাকবাহনীকে প্রতিরোধ করে। পাকবাহিনীর হাতে তাদের অনেক কর্মী নিহত হয়। তাদের এ ভূমিকা অনেকের কাছে তাদেরকে তখন আস্থাশীল করে তোলে। অনেকে তাদের দলে যোগ দেয়। তারা বাঘারপাড়ার নারকেলবাড়িয়া, খাজুরা এলাকা, তেলকূপ ও দামোদরপুর বাজারে ঘাঁটি গড়ে তোলে। চাপরাইল স্কুলকে কেন্দ্র করে তাদের শক্তির বিকাশ ঘটে। এক সময় তারা কোনো-কোনো জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে মুক্তিবাহিনী তাদের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে আসতে বাধ্য হয়। মে মাসে পুনিহার বাজারে পাকবাহিনী ও ইপিসিপি (এমএল) বাহিনীর মধ্যে একটি যুদ্ধ হয়।
বাঘারপাড়া উপজেলা ৮ই ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয়। ৭ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনা ও রাজাকারদের হটিয়ে বাঘারপাড়ার পার্শ্ববর্তী অভয়নগর থানার ধলগ্রাম শত্রুমুক্ত করেন। যশোর সদর মুক্ত হওয়ার পর রাজাকার ও আলবদররা দুর্বল হয়ে পড়ে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বাঘারপাড়া হেডকোয়ার্টার্স ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা পালিয়ে যায়। বাঘারপাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
৮ই ডিসেম্বর সকাল ১০টায় বাঘারপাড়া পাইলট স্কুল মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ বিশ্বাসের নেতৃত্বে ব্রাশ ফায়ার করে বাঘারপাড়াকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। আব্দুল মজিদ মাস্টার ও ইমান আলী মাস্টারের দেয়া স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা শতশত মানুষের উপস্থিতিতে পাইলট হাইস্কুল মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ বিশ্বাস উত্তোলন করেন। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস, ওসমান গণি, স্বামী স্মরণ, শরীফ জামালউদ্দীন, আব্দুল জলিল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। শত্রুমুক্ত হওয়ার পর রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। প্রথম দিন তারা ২৮৫টি অস্ত্র জমা দেয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন— এ কে এম ইসহাক, বীর প্রতীক (পিতা মো. মজিবুর রহমান মোল্লা, ধলা)।
বাঘারপাড়ায় সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অনেক বীর যোদ্ধা শহীদ হন। এ উপজেলার যেসব মুক্তিযোদ্ধা এখানে ও দেশের অন্যত্র শহীদ হন, তাঁরা হলেন— আব্দুল মান্নান (পিতা হোসেন আলী, কৃষনগর), জমির উদ্দীন (পিতা মোজাম্মেল মোল্লা, ধূপখালী), আকসেদ আলী (পিতা ভোলাই মোল্লা, মামুদালীপুর), শামসুর রহমান (পিতা ইউনুস বিশ্বাস, সাকটি গোপাল) ও বজলুর রহমান বিশ্বাস (পিতা ইউনুস বিশ্বাস, নলডাঙ্গা)। অন্য উপজেলার যেসব মুক্তিযোদ্ধা বাঘারপাড়ায় শহীদ হন, তাঁরা হলেন- শামসুর রহমান (গোপালপুর, রামনগর ইউনিয়ন, যশোর সদর), রতন কুমার (নড়াইল; মূল বাড়ি আশোকনগর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) ও মিজান (ইপিসিপি কর্মী; আন্দোলপোতা, লেবুতলা ইউনিয়ন, যশোর সদর)।
মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের স্মরণে বাঘারপাড়ায় যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো হলো- থানা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণে ৩ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামফলক, বাঘারপাড়া খেয়াঘাট বধ্যভূমি ও ‘স্বাধীনতা চত্ত্বর’ স্মৃতিস্তম্ভ, খাজুরা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ, মিত্রবাহিনীর স্মৃতি মিনার, খাজুরা শহীদ সিরাজ উদ্দীন হোসেন মহাবিদ্যালয় (শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দীন হোসেন স্মরণে), বীর প্রতীক ইসহাক মাধ্যমিক বিদ্যালয় (ধলগ্রাম), বীর প্রতীক ইসহাক মহাবিদ্যালয় (ধলগ্রাম) ইত্যাদি। যশোরের প্রথম শহীদ চারুবালা করের নামে শহরের টিএন্ডটি অফিসের সামনের রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে। [মো. হাবিবুর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!