বাঘের খাঁচায় মানুষ হত্যা (ঠাকুরগাঁও সদর)
বাঘের খাঁচায় মানুষ হত্যা (ঠাকুরগাঁও সদর) পাকবাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর নির্মম অত্যাচারের একটি ভয়ঙ্কর পদ্ধতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনকে ধরে এনে নির্যাতনকেন্দ্রে বন্দি করে রাখত। তারপর তাদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বন্ধে তথ্য আদায়ের জন্য দিনের পর দিন নানা ধরনের নির্যাতন চালাত। কোথাও কোথাও এমন নির্যাতন চালানো হতো, যা ছিল লোমহর্ষকর ও মধ্যযুগীয়। এমনই একটি নির্যাতনকেন্দ্র ছিল ঠাকুরগাঁও ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স। এখানে লোহার গ্রিল দ্বারা নির্মিত একটি বাঘের খাঁচা ছিল। তাতে দুটি হিংস্র চিতাবাঘ ও দুটি শাবক ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন ধরে এনে হানাদার বাহিনী কর্তৃক প্রথমে তাদের ওপর চরম নির্যাতন চালানো হতো। এরপর রক্তাক্ত শরীরে কখনো অর্ধমৃত, কখনো হাত পেছনে বাঁধা অবস্থায় আবার কখনো সরাসরি এসব বন্দিদের খাঁচায় বাঘের মুখে নিক্ষেপ করত। এভাবে এখানে কমপক্ষে ৫০ জন মানুষকে খাঁচায় ঢুকিয়ে বাঘ দিয়ে খাওয়ানো হয়। পৈশাচিক এরূপ নির্যাতনের এক নির্মম শিকার পীরগঞ্জ থানার কোসারাণীগঞ্জ ইউনিয়নের কোসাগুলপাড়া গ্রামের যুবক দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্র ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিন। কোনোভাবেই কোনো তথ্য আদায় করতে না পেরে পাকিস্তানি মেজরের নির্দেশে দুহাত পেছনে বাঁধা অবস্থায় তাঁকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করা হয়। সঙ্গে-সঙ্গে হিংস্র বাঘ তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ক্ষতবিক্ষত হয় তাঁর সমগ্র শরীর। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। নিমেষেই সব শেষ। বাঘের পেটে যায় বীর এ মুক্তিযোদ্ধার শরীরের মাংস। খাঁচার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে রাজাকার, শান্তি কমিটির সদস্য ও পাকহায়েনার দল এ পৈশাচিক দৃশ্য দেখছিল আর উল্লাস করছিল! বাঘের খাঁচায় একাধিকবার নিক্ষেপ করার পরও বাঘের মুখ থেকে অলৌকিকভাবে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে এসেছিলেন শফিকুল আলম চৌধুরী (২০১৮ সালে প্রয়াত) নামে অপর একজন। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ও ঠাকুরগাঁও কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বে পঞ্চগড় জেলার বোদা থানার ছাত্র-তরুণ ও স্থানীয় জনগণের অনেককে তিনি যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দান করেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা )। এভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা এমনকি সাধারণ নিরীহ অনেক মানুষকে বর্বর পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও হত্যার শিকার হতে হয়। [হারুন-অর-রশিদ ও মনতোষ কুমার দে]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড