You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.05 | বাঙালি নগর যুদ্ধ (রায়পুরা, নরসিংদী) - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙালি নগর যুদ্ধ (রায়পুরা, নরসিংদী)

বাঙালি নগর যুদ্ধ (রায়পুরা, নরসিংদী) সংঘটিত হয় দুবার আগস্ট মাসের শেষদিকে এবং ৫ই ডিসেম্বর। প্রথমবারের যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও একজন গ্রামবাসী শহীদ এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। দ্বিতীয়বারের যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয় এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

প্রথমবারের যুদ্ধ
হাটুভাঙ্গা থেকে এক মাইলের মতো পশ্চিমে বাঙালিনগর গ্রাম। আগস্ট মাসের শেষদিকে বাঙালিনগর রেল পুলে একটি বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। পুলে হানাদারদের স্থায়ী কোনো ক্যাম্প ছিল না। মাঝে-মধ্যে তারা পুল পরিদর্শনে আসত। ঘটনার দিনও পরিদর্শনে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হয়। হানাদারদের আসার খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকেই পুলের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে এম্বুশ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর দিক থেকে গুলি করলে পাকসেনারা দক্ষিণ দিকে যায়। আবার মুক্তিযোদ্ধারা দক্ষিণ দিক থেকে গুলি করলে তারা উত্তর দিকে যায়। এমনিভাবে কিছুক্ষণ গোলাগুলির পর পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে পুলের নিচে চলে যায়। ফলে উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি চালাতে থাকেন। রেল লাইনের উভয় দিকে এবং পুলের নিচে পানি থাকায় হানাদার বাহিনী সেখানে আটকা পড়ে। পরে মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে এবং কোদাল দিয়ে কুপিয়ে কয়েকজন হানাদারকে হত্যা করে। দুজন হানাদারকে জীবিত অবস্থায় ধরে এনে জবাই করে আড়িয়াল খাঁ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এ-যুদ্ধে বাঙালিনগরের একজন মুক্তিযোদ্ধা ও সামসুদ্দিন নামে একজন গ্রামবাসী শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন (আদিয়াবাদ) গুরুতরভাবে আহত হন। স্বাধীনতার পর তাঁকে রাশিয়া পাঠানো হয় এবং চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গয়েছ আলী মাস্টারের নেতৃত্বাধীন লতিফ গ্রুপ, আজিজ গ্রুপ, মাইনুদ্দিন গ্রুপ, সফর আলী গ্রুপ ও নজরুল গ্রুপ অংশ নেয়।

দ্বিতীয়বারের যুদ্ধ
৫ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্য নরসিংদী থেকে রেল লাইন ধরে হেঁটে আমিরগঞ্জ (হাসনাবাদ) বাজারে এসে এলোপাতাড়ি গুলি করে বেশ কয়েকজন লোককে হত্যা এবং বেশকিছু দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে। এ-সময় স্থানীয় ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা দূর থেকে তাদের প্রতি রাইফেলের গুলি ছোড়েন। হানাদার বাহিনীর এলএমজি ও সাবমেশিনগানের বিরামহীন গোলাগুলিতে বহু নিরীহ মানুষের মুত্যু হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা খানাবাড়ি রেল স্টেশনের দিকে চলে যান।
বেলা ১১টার মধ্যে আশপাশের প্রায় তিন-চারশ মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন গ্রুপ কমান্ডারের নেতৃত্বে রায়পুরা থানার মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক ও যুদ্ধকালীন এফএফ বাহিনীর কমান্ডার গয়েছ আলী মাস্টারের কমান্ডে হাটুভাঙ্গায় এসে জমায়েত হন। বেলা ১২টার সময় পাকবাহিনী আমিরগঞ্জ থেকে মার্চ করে খানাবাড়ি রেল স্টেশনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ খবর শোনার পর গয়েছ আলী মাস্টার মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলোর কমান্ডারদের সঙ্গে জরুরি পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন যে, পাকবাহিনীকে প্রতিহত করা হবে। সেনাবাহিনীর সাবেক সুবেদার মেজর এনাইজুর রহমানের কমান্ডে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু বকর সিদ্দিক, আমজাদ ও আ. লতিফ তাঁদের গ্রুপসহ আরো কিছু গ্রুপ নিয়ে হাটুভাঙ্গা ও বাঙালিনগর গ্রাম সংলগ্ন রেল লাইনের দুদিকে এম্বুশ করেন। পাকবাহিনী এম্বুশে আসামাত্র তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ চালালে হানাদার বাহিনীর কয়েকজন নিহত হয়। পাকবাহিনীর নিকট এলএমজি, চাইনিজ রাইফেল ও সাবমেশিনগান ছিল। তারা মরিয়া হয়ে যুদ্ধ শুরু করে। এ- যুদ্ধ বেলা ২টা পর্যন্ত চলে। বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। বেলা আড়াইটার দিকে পাকবাহিনী পিছু হটে পশ্চিম দিক দিয়ে রেল লাইন ধরে নরসিংদী যেতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ দ্রুত বাঙালিনগর গ্রামের শেষ মাথায় গিয়ে পাকবাহিনীর পেছনে পজিশন নিয়ে তাদের পালানোর পথ বন্ধ করে দেয়। ফলে পাকবাহিনী চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়ে। বেলা ৩টার পর আশপাশের গ্রাম থেকে শতশত লোক দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে এগিয়ে আসে। এতে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্দীপ্ত হয়ে নতুনভাবে যুদ্ধ শুরু করেন। ইতোমধ্যে পাকবাহিনীর আরো কয়েকজন গুলিতে নিহত হয়। বেলা ৪টার দিকে চতুর্দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতা শত্রুদের ঘিরে ফেলায় সহজেই মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। জনতার রুদ্ররোষ থেকে পাকসেনাদের কেউ বাঁচতে পারেনি। [মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড