বাগেরহাট থানা আক্রমণ (বাগেরহাট সদর)
বাগেরহাট থানা আক্রমণ (বাগেরহাট সদর) পরিচালিত হয় ৩০শে এপ্রিল। এর উদ্দেশ্য ছিল বাগেরহাট সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সৈয়দ অজিয়র রহমানকে পুলিশের হাত থেকে উদ্ধার করা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা এতে ব্যর্থ হন এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
২৪শে এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি ইউনিট বাগেরহাট শহর আক্রমণ করে। এ-সময় তারা অর্ধশতাধিক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে শহরে তাদের দখল প্রতিষ্ঠা করে। এর পূর্ব পর্যন্ত সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক শেখ আবদুর রহমান বাগেরহাটের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। পাকবাহিনী নিয়ন্ত্রণ নিলে বাগেরহাটের নেতৃত্ব চলে যায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাতে। তখন শেখ আবদুর রহমানসহ স্বাধীনতার পক্ষের অনেক নেতা বাগেরহাট ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। এ অবস্থায় বাগেরহাটের মুক্তিকামী মানুষকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সৈয়দ অজিয়র রহমান।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে ২৮শে এপ্রিল সৈয়দ অজিয়র রহমান বাগেরহাট শহরে প্রবেশ করেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের কাছে এ খবর পৌঁছে গেলে তারা সৈয়দ অজিয়র রহমানকে পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে থানার পুলিশ রহমত হোটেলের মোড় থেকে সৈয়দ অজিয়র রহমানকে আটক করে।
সৈয়দ অজিয়র রহমানকে আটক করার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে ২৯শে এপ্রিল কামরুজ্জামান টুকু, রফিকুল ইসলাম এবং সোহরাব হোসেনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা চিরুলিয়া বিষ্ণুপুর ক্যাম্পে একত্রিত হন। সেখানে তাঁরা সৈয়দ অজিয়র রহমানকে উদ্ধার করার বিষয়ে বৈঠক করেন। তাতে সিদ্ধান্ত হয় যে, ৩০শে এপ্রিল রাত ১২টা ১ মিনিটে একদিকে রফিকুল ইসলাম খোকনের দল থানা আক্রমণ করে পুলিশকে ব্যস্ত রাখবে এবং অন্যদিকে এ সুযোগে কামরুজ্জামান টুকুর দল সৈয়দ অজিয়র রহমানকে থানা থেকে মুক্ত করবে।
২৯শে এপ্রিল রাতে ১৫টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল এবং কয়েকটি শর্টগান নিয়ে ২০ জনের একটি দল নিয়ে রফিকুল ইসলাম মুনিগঞ্জের কাছে নদী পার হন। এ দলে আসাদুল, শঙ্কর, নোমান, খসরু প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম আগে থেকে সেখানে নৌকা জোগাড় করে রেখেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা থানার উত্তর পাশের নদীর তীর, পশ্চিম পাশের বাগেরহাট স্কুল ও সিভিল সার্জনের অফিস এলাকা এবং পূর্ব পাশে ডাকঘরের দিকে অবস্থান নেন। সিভিল সার্জন অফিস ভবন এলাকায় অবস্থানরত আসাদ, শঙ্কর, নোমান ও খসরু একে-একে চারটি পাইপ গ্রেনেড থানায় নিক্ষেপ করেন। দুটি গ্রেনেড বিকট আওয়াজে বিস্ফোরিত হয়। তখন নদীর তীর ও ডাকঘর এলাকা থেকে শহীদ, গোবিন্দ, মধু, মুজিবুল, আনিস প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা থানা লক্ষ করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। গ্রেনেড ও গুলির শব্দে থানায় অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা পালানোর চেষ্টা করে। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ২ পুলিশ নিহত হয় এবং ১০ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। সৈয়দ অজিয়র রহমানকে উদ্ধারকারী কামরুজ্জামান টুকুর দল এ-সময় ভৈরব নদী পার হয়ে নাগেরবাজারে ওঠার সঙ্গে- সঙ্গে ট্রেজারি পুলিশ ও ন্যাশনাল ব্যাংকে পাহারারত পুলিশের মুখোমুখি হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে কামরুজ্জামান টুকুর দলের ২ জন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। তখন কামরুজ্জামান টুকুকে বাধ্য হয়ে পশ্চাদপসরণ করতে হয়। কামরুজ্জামান টুকু নিরাপদ অবস্থানে যাওয়ার পর বাগেরহাট শহরে অবস্থিত সকল পুলিশ একত্রিত হয়ে পুনরায় থানা উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়। রাত ৪টার দিকে পুলিশ বাহিনী রফিকুল ইসলামের দলের ওপর তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করে। আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। এ ঘটনার পর সৈয়দ অজিয়র রহমানের ওপর পুলিশের নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে স্থানীয় মুসলিম লীগ- নেতাদের যোগসাজশে তাঁকে পাকবাহিনীর খুলনা ক্যাম্পে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। ১লা মে সকালবেলা সৈয়দ অজিয়র রহমানকে অর্ধমৃত অবস্থায় খুলনা সেনানিবাসে পাঠানোর জন্য জিপে তোলা হয়। হানাদারদের হাতে আটক অবস্থায় তাঁর মৃত্যু ঘটে। [স্বরোচিষ সরকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড