বাঘভাণ্ডার যুদ্ধ (ভুরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম)
বাঘভাণ্ডার যুদ্ধ (ভুরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম) ভুরুঙ্গামারী উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে ভারতের সাহেবগঞ্জ অবস্থিত। সাহেবগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স ছিল। এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ভুরুঙ্গামারী থানার বাঘভাণ্ডারে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন। বাঘভাণ্ডারে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম ২৫টি ছোট- বড় যুদ্ধ হয়।
২৫শে মার্চের পর প্রতিরোধ যুদ্ধে বাঘভাণ্ডার বিওপি-র অবাঙালি হাবিলদার সুফি খাঁন কূটকৌশলে বাঙালিদের অস্ত্র নিজের কর্তৃত্বে নিয়ে নেয়। বাঙালি ইপিআর সদস্যদের বন্দি করে দখলকৃত অস্ত্র অবাঙালিদের অধীন বিওপি মইদামে নিয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে বিক্ষুব্ধ বাঙালি ইপিআর এবং গ্রামবাসী মইদাম বিওপি আক্রমণ করে। সেখান থেকে সুফি খাঁন তার বাহিনী নিয়ে কুলাঘাটের দিক দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হয়। এরপর সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করে পাকিস্তানিদের ব্যতিব্যস্ত ও সন্ত্রস্ত করে রাখার কৌশল নেন।
বাঘভাণ্ডার এলাকার ফুলকুমার নদীর তীরবর্তী দুদিকে পাকিস্তানি সেনারা প্রায়ই কাঁচা রাস্তায় টহল দিত। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করার জন্য ১২ই জুলাই মধ্যরাতে কাঁচা রাস্তার পাশে জঙ্গলে এম্বুশ করেন। পরদিন সকাল ৮টার দিকে ১৫ জনের একটি পাকিস্তানি দল রাস্তা ধরে টহলে এগিয়ে এলে এম্বুশে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা এলএমজি ও রাইফেল দিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করেন। তারা পাল্টা প্রতিরোধ করলে ১০ মিনিটের যুদ্ধে কমপক্ষে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়।
সুবেদার বোরহান উদ্দিন ১৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত তাঁর দলের সদস্যদের নিয়ে প্রায়ই ভুরুঙ্গামারী, বাঘভাণ্ডার ও পাথরডুবি এলাকার দিকে অগ্রসর হতেন। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে তাঁরা ফুলকুমার নদীর দুদিকে বাঘভাণ্ডার নর্থ ও বাঘভাণ্ডার সাউথ এ দুভাগে বিভক্ত হয়ে ডিফেন্স নেন। ভোরে ওয়ারলেসের মাধ্যমে বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, সকালে ফাইটার প্লেন উড়ে যাবে। খবর অনুযায়ী ফাইটার প্লেন ২-৩ রাউন্ড দিয়ে চলে যায়। এদিন সুবেদার বোরহানের দল এবং পাকসেনাদের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়।
সুবেদার বোরহানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বাঘভাণ্ডার ক্যাম্পের উত্তর ও জয়মনিরহাট রাস্তার পশ্চিমে এম্বুশ করেন। এ এম্বুশের ওপর হঠাৎ পাকসেনারা আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা-আক্রমণ করলে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। এখান থেকে ১০০ রাউন্ড গুলিভর্তি এমএমজি-র চেইন ও কিছু সামরিক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়।
আগস্টের শেষে সুবেদার বোরহানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের এ দল এম্বুশ শেষে পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত হামলার শিকার হয়। ফলে শাজাহান মানিকসহ মুক্তিযোদ্ধারা ফুলকুমার নদী পার হতে বাধ্য হন। এদিন উভয় পক্ষে তীব্র গুলি বিনিময় হয়। গুলিতে একজন চাষি আহত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য দিনহাটা হাসপাতালে পাঠানো হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পায়ের বুট রেখে খালি পায়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সাবসেক্টর কমান্ডার লে. মতিউর রহমান পরে যুদ্ধ এলাকা পরিদর্শন করেন।
১১ই অক্টোবর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি বিনিময় হয়। এদিন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ- সুবেদার আরব আলীর নেতৃত্বাধীন বাঘভাণ্ডার কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হন। তিনি কোম্পানির বিভিন্ন বাংকারও পরিদর্শন করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। [এস এম হারুন অর রশীদ লাল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড