You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বাগমারা উপজেলা (রাজশাহী)

বাগমারা উপজেলা (রাজশাহী) রাজশাহী জেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব থেকেই রাজশাহী জেলার মধ্যে বাগমারার মানুষ অনেকটা রাজনীতি-সচেতন ছিল। ৬৯-এর ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের সময় বাগামারায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তখন পাকিস্তান সমর্থিত শুভডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাহির উদ্দিন (বাইগাছা) মচমইল হাইস্কুলের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের লাঞ্ছিত করে। এ ঘটনায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সাধারণ জনগণ একত্রিত হয়ে বাইগাছা হাট ও গ্রাম পুড়িয়ে দিলে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে পাঁচজন পুলিশ নিহত হয়। ৭০- এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শাহ মো. জাফরউল্লাহকে এমএনএ এবং সরদার আমাজাদ হোসেনকে এমপিএ নির্বাচিত করার মধ্য দিয়েই বাগমারাবাসী পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে, যা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচনায় বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাগমারা থানা মুক্তি সংগ্ৰাম পরিষদ ও ছাত্রলীগ-এর নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা একত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। আন্দোলন- সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি চলাকালে বাগমারা থানার অবাঙালি পুলিশের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের কথা কাটাকাটি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র-জনতা বাগমারা থানা থেকে কয়েকজন অবাঙালি পুলিশকে ধরে এনে থানার পশ্চিম পাশে একডালা গ্রামের মিলমালতের পুকুরপাড়ে হত্যা করে। এ কারণে ২৫শে মার্চের কয়েকদিন পূর্বেই বাগমারা থানায় বিপুল সংখ্যক অবাঙালি পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এসময় নেতৃবৃন্দ আত্মগোপনে থেকে তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। বাগামারা ও আত্রাই থানার সীমানা ঘেঁষে বাগমারার ঝিকরগাছা ইউনিয়নের রনসিবাড়ি গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। পার্শ্ববর্তী থানার স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা সেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। নওগাঁ মহকুমার আত্রাই ও রাণীনগর থানার বামপন্থী নেতা ওহিদুর রহমান ও আলমগীর কবিরের সংগ্রহ করা বেশ কয়েকটি দেশী বন্দুক ও থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে। প্রশিক্ষণ দেন ছুটিতে আসা ও অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন বাঙালি সেনা, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্য।
শাহ মো. জাফর উল্লাহ এমএনএ, সরদার আমজাদ হোসেন এমপিএ, নূরুল ইসলাম হেড মাস্টার (বাগমারা), আব্দুস সোবহান (কামনগর), রাখাল চন্দ্র দাস (শংকরপই), এস এম আসাদুল্লাহ আল গালিব (মছমইল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক), রফিকুল্লাহ (বাড়িগ্রাম), রেফাত উল্লাহ সরকার রামরামা), ইসমাইল হোসেন মৃধা (শ্রীপুর), ডা. আব্দুর রশিদ (তিলিপাড়া), আ. হাকিম শেখ (মাড়িয়া), কফিল উদ্দিন (বাগান্না), ইয়াসিন আলী (কাঠালবাড়ি), আমজাদ হোসেন প্রামাণিক (যুগীপাড়া), আব্দুল্লাহ মৃধ (কানাই শহর), আমজাদ হোসেন সরদার (সাঁইপাড়া), মেছের আলী প্রামাণিক (সাদোপাড়া), চয়েন উদ্দিন শাহ (মথুরাপুর), কাজী সাজেদুর রহমান সরদার (খামারগ্রাম), মো. আমীর উদ্দিন পণ্ডিত (আক্কেলপুর, গণিপুর), বদরউদ্দিন সরকার (কামনগর), ডা. সাহাদাৎ হোসেন (বাগমারা), বদরউদ্দিন (গঙ্গা নারায়ণপুর), আব্বাছ আলী খান(হামিরকুৎসা) প্রমুখ এখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ছিলেন। এখানকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন আলী খাজা এম এ মজিদ (পিতা জামাল উদ্দিন প্রামাণিক, উত্তর সাজুরিয়া, ঝিকরা) এবং খয়বর আলী (পিতা সাবুর আলী প্রামাণিক, মাদিলা, নরদাশ) বাগমারায় পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ে স্থানীয় জনগণ রাজশাহী নওহাটার প্রতিরোধযুদ্ধে ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ও টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করে।
২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনী বাগমারার তাহেরপুর হাটে প্রবেশ করে গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে রাজশাহীতে ফিরে যায়। অক্টোবর মাস পর্যন্ত পাকবাহিনী রাজশাহী থেকে এসে হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে আবার রাজশাহীতে ফিরে যেত। অক্টোবর মাসের শেষদিকে বাগমারা থানায় তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া তাহেরপুর, বাইগাছা, বালানগর ও নরদাশ ইউনিয়নে -রাজাকার ক্যাম্প ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বাগমারায় পাকবাহিনীর সহযোগী শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। পাকিস্তানি হানাদারদের দোসরদের মধ্যে আইয়ুব আলী সরদার (জামায়াতে ইসলামী, নন্দনপুর), মো. রুস্তম আলী সরদার (জামায়াতে ইসলামী, নন্দনপুর), জবেদ আলী সরদার (মুসলিম লীগ, সূর্যপাড়া), জসিম উদ্দিন আহমদ (সোনাডাঙ্গা), মনিরউদ্দিন হাজি (মুসলিম লীগ- ও রাজাকার কমান্ডার, তাহেরপুর), নূর মৌলবী (মুসলিম লীগ, জগন্নাথপুর), জবান আলী (ভরট্ট), ওমর হাজি (খাজাপাড়া), ইসমাইল হাজি (খাজাপাড়া), হাবিবুর (খাজাপাড়া), ইয়াসিন (শ্রীপুর), ছাত্তার মৌলবী (জামায়াতে ইসলামী, শীতলা), খুরশেদ প্রেসিডেন্ট (নরদাশ ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান), গোলাম (-আলশামস – কমান্ডার, শুভডাঙ্গা ইউনিয়ন), তাহের উদ্দিন (বাইগাছা), আবদুল মজিদ (আলবদর কমান্ডার, বড়সগুনা) প্রমুখ।
১৪ই মে পাকিস্তানি বাহিনী তাহেরপুরে প্রবেশ করলে রাজশাহী জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আইনুদ্দিন, পুঠিয়া থানার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী ও তাহেরপুরের রাজাকার কমান্ডার মনির উদ্দিন হাজির সহযোগিতায় হানাদাররা ২০ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, যা তাহেরপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। গণহত্যায় শহীদদের লাশ তিলিপাড়া শ্রীনাথের বাড়ির পাশের ডোবায় ফেলে দেয়া হয়। এদিন তারা তাহেরপুর হাট, মাস্টারপাড়া, জেলেপাড়া এবং তিলিপাড়ায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। পরের দিন স্থানীয় জনগণ ডোবা থেকে লাশগুলো তুলে পাশেই গণকবর দেয়।
এপ্রিল মাসের শেষে তেলিপুর হিন্দুপাড়ায় জামায়াত নেতা ছাত্তার মৌলবীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করে। সেদিন তারা লবকৃষ্ণের লুকানো সম্পদের লোভে তার পুকুরঘাটের সিঁড়ি ভেঙে ফেলে। ঘরের জানালা-দরজা খুলে নিয়ে যায় এবং ধান-চাল ও গরু-ছাগল লুণ্ঠন করে। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা শাহ মো. জাফর উল্লাহ এমএনএ, সরদার আমজাদ হোসেন এমপিএ-সহ সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ৫ই নভেম্বর পাকবাহিনী বাগমারা গ্রামের কয়েকজন নারীর সম্ভ্রমহানি করে। বালানগর মাদ্রাসায় স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে ধরে এনে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হতো। তাহেরপুর তিলিপাড়ায় শ্রীনাথের বাড়ির পাশে গণকবর রয়েছে।
৫ই জুলাই তাহেরপুর ও ভবানীগঞ্জ হাটে ওহিদুর রহমান ও আলমগীর কবিরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাহেরপুর শান্তি কমিটির অফিসে ও শান্তি কমিটির মিটিংয়ে গেরিলা অপারেশন চালালে সেখানে বেশ কয়েকজন দালাল নিহত হয়। একই দিন তাঁরা ভবানীগঞ্জ শান্তি কমিটির মিটিংয়ে অপারেশন চালালে বাগমারা থানার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানসহ সেখানেও বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি দালাল নিহত হয়। এ সংবাদ পেয়ে রাতেই হানাদার বাহিনী আবার তাহেরপুরে প্রবেশ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক চয়েন উদ্দিন শাহ ও তাঁর পুত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মজিবর রহমানসহ ৫ জনকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
১৪ই আগস্ট ও ২১শে নভেম্বর দুবার বাগমারা থানা অপারেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ওহিদুর রহমান, মকলেছুর রহমান রাজা, আলমগীর কবির, আলী খাজা এম এ মজিদ প্রমুখের নেতৃত্বে একাধিক গ্রুপের ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধা থানা আক্রণণে অংশ গ্রহণ করেন। এ অপারেশনে কয়েকজন মিলিশিয়া ও পুলিশ নিহত হয় এবং অন্যরা অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা সেখান থেকে ৪০টি অস্ত্র উদ্ধার করেন। থানা দখল করার পর তাঁরা পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। মুক্তিযোদ্ধারা চলে গেলে রাজশাহী থেকে বিপুল সংখ্যক প্যারা মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনী ভারী অস্ত্রসহ এসে আবার বাগমারা থানায় অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা ৭ই নভেম্বর তাহেরপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে ৭টি রাইফেল উদ্ধার করেন। ২৭শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা হামিরকুৎসা শাহপাড়া শান্তি কমিটির ক্যাম্পে অপারেশন চালান। ১৭ই ডিসেম্বর ওহিদুর বাহিনীর আলমগীর কবির ও খয়বর হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পুনরায় বাগমারা পুলিশ স্টেশন দখল করে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। একই দিন ভবানীগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে রাজাকারআলবদর সদস্যরা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। ১৭ই ডিসেম্বর বাগমারা হানাদারমুক্ত হয়।
বাগমারা উপজেলায় ১০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন— চয়েন উদ্দিন শাহ (পিতা বাহারউদ্দিন শাহ, মথুরাপুর), মজিবর রহমান (পিতা চয়েন উদ্দিন শাহ, মথুরাপুর), সেকেন্দার আলী (পিতা গিয়াস উদ্দিন খন্দকার, তাহেরপুর; আনসার সদস্য), আনছার আলী সরদার (পিতা কাজিম উদ্দিন চৌকিদার, বাছিয়াপাড়া; আনসার সদস্য), শিবেন্দ্র নাথ সাহা (পিতা গুণধর সাহা, তেলিপাড়া), ইয়াছিন আলী (পিতা গোপাল মণ্ডল, বাঙ্গালপাড়া), রফিকুল ইসলাম (পিতা আব্দুল আজিজ, দ্বীপপুর), মেহের আলী (পিতা আসতুল্লাহ, হাসানপুর), আব্দুল কদ্দুস (পিতা মেহের উল্লাহ,

কাছারি কোয়ালিপাড়া) ও সাজেদুর রহমান (পিতা সাখাওয়াৎ হোসেন, বামনকয়া)
বাগমারা উপজেলা সদরে ভবানীগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর একটি ম্যুরল নির্মিত হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সেকেন্দার আলীর নামে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [মো. নজরুল ইসলাম মণ্ডল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!