You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার)

বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠা ১০ই এপ্রিল ১৯৭১। একই দিন গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (The Proclamation of Independence) হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ম্যাগনাকার্টা বা স্বাধীনতার সনদ। ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহাকুমার (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলায় এ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ- শপথ গ্রহণ শেষে এ স্থানের নতুন নাম ‘মুজিবনগর’ ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগর সরকার- নামে পরিচিতি লাভ করে।
নিরাপত্তার স্বার্থে মুজিবনগর সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে স্থানান্তর করা হয়। তবে সরকারের কার্যক্রমে স্থান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস মুজিবনগর ব্যবহৃত হয়। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও এর কার্যাবলি পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায় কত ব্যাপক এবং সুসংগঠিত ছিল এ সরকার।

পটভূমি
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি (১৬০টি এলাকা ভিত্তিক + ৭টি সংরক্ষিত মহিলা; সবই পূর্ব পাকিস্তানে) আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনের এ ফল ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তির সনদ হিসেবে খ্যাত আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্মসূচি- ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি গণ-ম্যান্ডেট। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এরূপ বিজয় জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নিকট আদৌ প্রত্যাশিত ছিল না। পাকিস্তানের শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ওপর শাসন-শোষণ ও বৈষম্য চালিয়ে আসে। সমমর্যাদায় রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার পরিবর্তে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের তাদের প্রজা হিসেবে দেখে। বাঙালিরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসক হোক, তা তারা কখনোই চায় নি, যদিও বাঙালিরা ছিল ঐ রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ৭০-এর নির্বাচন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এতদিনের হিসাব-নিকাশ উল্টে দেয়। নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে অখ্যায়িত করে বটে (১৪ই জানুয়ারি ১৯৭১), তবে নির্বাচনের ফলাফল নস্যাৎ করতে তারা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। এরই অংশ হিসেবে ৩রা মার্চ ১৯৭১ অনুষ্ঠেয় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ২ দিন পূর্বে ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন, যা ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এর জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বাঙালিদের প্রতি দিকনির্দেশনাপূর্ণ এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ভাষণের শেষে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এদিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নাম করে গোপনে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্লেনে ও জাহাজে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য ও অস্ত্র আনতে থাকে। সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর বঙ্গবন্ধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর পূর্বেই বঙ্গবন্ধু দলের নেতৃবৃন্দকে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু ওয়ারলেস মেসেজের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
২৫শে মার্চের ভয়াল রাতের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এমএনএ-কে সঙ্গে নিয়ে ২৭শে মার্চ ভারতের উদ্দেশে ঝিনাইদহে পৌঁছেন। সেখানকার এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমদ এবং মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরীর সহায়তায় তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান। ৩০শে মার্চ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২রা এপ্রিল তাঁরা দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার জন্য একটি সরকারের আবশ্যকতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

সরকার গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ
দিল্লি থেকে ফিরে এসে তাজউদ্দীন আহমদ সরকার গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং এমপিএ-দের এক অধিবেশন আহ্বান করেন। অধিবেশনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে একটি সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এভাবে ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ-কে প্রধানমন্ত্রী করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান – এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদ-কে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১০ই এপ্রিল কর্নেল (পরবর্তীতে জেনারেল) এম এ জি ওসমানী-কে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১১ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতারে তাঁর এক ভাষণে মন্ত্রিসভা গঠনের ঘোষণা দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভা ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বিপুল সংখ্যক দেশী- বিদেশী সাংবাদিক ও জনগণের উপস্থিতিতে শপথ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য ১০ই এপ্রিলের সরকার গঠনের ব্যাপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায়ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের একটি বৈঠক হয়েছিল।
১০ই এপ্রিল মন্ত্রিসভা গঠনের দিন আওয়ামী লীগ থেকে ৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিবৃন্দ (এমএনএ ও এমপিএ) ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম প্রণীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্ৰ (The Proclamation of Independence) গ্রহণ করেন। এটি উপস্থাপন করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ। এ ঘোষণাপত্রে সুষ্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে কেন, কোন ক্ষমতার বলে এবং কী পরিস্থিতিতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলো। ঘোষণাপত্রে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।’
১০ই এপ্রিল মন্ত্রিসভা গঠনের দিন দিন থেকেই বাংলাদেশ সরকারের কার্যাবলি শুরু হয়। ১৮ই এপ্রিল
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তক্রমে মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করা হয়, যা ছিল এরূপ- তাজউদ্দীন আহমদ, প্রধানমন্ত্রীর অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা, তথ্য ও বেতার, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ, শিক্ষা, স্থানীয় প্রশাসন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়; ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী- কে অর্থ, জাতীয় রাজস্ব, বাণিজ্য ও শিল্প, পরিবহন মন্ত্রণালয়; এ এইচ এম কামারুজ্জামান-কে স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়, এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদ-কে পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব ছাড়াও কর্নেল ওসমানীকে মন্ত্রীর পদমর্যদা দেয়া হয়। যেহেতু মন্ত্রিসভার অধিকাংশ বৈঠকে প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধ পরিচালনা মুখ্য আলোচ্য বিষয় হিসেবে থাকত, সেহেতু কর্নেল ওসমানী মন্ত্রিসভার প্রায় প্রত্যেক বৈঠকেই উপস্থিত থাকতেন।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অপর তিন মন্ত্ৰী এবং প্রধান সেনাপতি এঁরাই ছিলেন সরকার পরিচালনায়। নীতি- নির্ধারণের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল তাঁদের। যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা বিবেচনায় রেখে সরকার পরিচালনা করতে হয়েছে। তাই মন্ত্রিসভার প্রাত্যহিক বৈঠক ছাড়াও প্রয়োজনে যে-কেনো স্থানে যে-কোনো সময় এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি ছিল দ্রুত ও দৃঢ়; সিদ্ধান্তসমূহের বাস্তবায়ন গতি ছিল তড়িৎ। প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্দেশনায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিববৃন্দ সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেন। সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন এইচ টি ইমাম৷
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় / বিভাগ, সংস্থা ও অন্যান্য সংগঠন
সরকারের কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে একটি নিয়মিত সরকারের মতো মুজিবনগর সরকারও একাধিক মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে।

মন্ত্রণালয় / বিভাগ
১. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, ২. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ৩. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ৪. অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ৫. মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়, ৬. সাধারণ প্রশাসন বিভাগ, ৭. স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়, ৮. তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, ৯. ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়, ১০. সংসদ বিষয়ক বিভাগ, ১১. কৃষি বিভাগ, ও ১২. প্রকৌশল বিভাগ।

সংস্থা
১. পরিকল্পনা কমিশন বা প্ল্যানিং সেল, ২. শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড, ৩. যুব নিয়ন্ত্রণ বোর্ড ও অভ্যর্থনা শিবির, ৪. ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি, ও ৫. শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড।

সংগঠন
উল্লিখিত মন্ত্রণালয় / বিভাগ ও সংস্থার কার্যাবলি পরিচালনা ছাড়াও সরকারকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বেশকিছু সংগঠন ও সমিতির কার্যাবলি পরিচালনা, সমন্বয় ও তদারকি করতে হয়েছে। এসব সংগঠন / সমিতির মধ্যে যুব নিয়ন্ত্রণ পরিষদ ও প্রশিক্ষণ বোর্ড, বাংলাদেশ হাসপাতাল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, জয়বাংলা পত্রিকা, বাংলাদেশ বুলেটিন, বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী সংগঠন, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল, বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি, বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ, নিউইয়র্ক বাংলাদেশ লীগ, বাংলাদেশ স্টুডেন্ট একশন কমিটি (লন্ডন), লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তরে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেক বেসামরিক কর্মকর্তা- কর্মচারী পূর্ববাংলার সরকারি দপ্তর পরিত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও কিছু বাঙালি কর্মকর্তা পালিয়ে এসে মুজিবনগর সরকারে এবং কিছু সেনা অফিসার মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োজিত থেকে যেসব কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁরা হলেন- ১.এইচ টি ইমাম, সিএসপি (মন্ত্রিপরিষদ সচিব; পূর্বে ডিসি, পার্বত্য চট্টগ্রাম), ২. খন্দকার আসাদুজ্জামান, সিএসপি (সচিব; পূর্বে যুগ্ম-সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়), ৩. নূরুল কাদের, সিএসপি (সচিব, সংস্থাপন; পূর্বে পাবনার ডিসি), ৪. এম এ সামাদ, সিএসপি (সচিব, প্রতিরক্ষা; পূর্বে সিলেটের ডিসি), ৫. মাহবুবুল আলম চাষী, সাবেক সিএসপি (সচিব, পূর্বে পররাষ্ট্র), ৬. আনোয়ারুল হক খান (সচিব, তথ্য), ৭. আবদুল খালেক, পিএসপি (সচিব, স্বরাষ্ট্র ও ডিজি পুলিশ; পূর্বে অধ্যক্ষ, পুলিশ একাডেমি, সারদা), ৮. ডা. টি হোসেন (সচিব, স্বাস্থ্য), ৯. নূরুদ্দীন আহমেদ (সচিব, কৃষি; পূর্বে প্রধান বন সংরক্ষক), ১০. আবদুল হান্নান চৌধুরী (সচিব, আইন; পূর্বে জেলা জজ, দিনাজপুর), ১১. এমদাদ আলী (প্রধান প্রকৌশলী), ১২. জয়গোবিন্দ ভৌমিক (ত্রাণ কমিশন), ১৩. রুহুল কুদ্দুস, সাবেক সিএসপি (মহাসচিব), ও ১৪. ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ (গণহত্যা ও স্নায়ুযুদ্ধ সেলের দায়িত্বে)।

মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়
মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়ের প্রধান দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় উত্থাপন, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ, লিপিবদ্ধকরণ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন।

অর্থ বিভাগ
অর্থ-শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সরকারের বাজেট প্রণয়ন, অভ্যন্তরীণ ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত সম্পদের হিসাব তৈরি, বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গকে অর্থ ছাড়করণের নীতিমালা প্রণয়ন, রাজস্ব ও শুল্ক আদায়, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে একটি তহবিল প্রতিষ্ঠা করা হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
যুদ্ধকালীন সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশে মিশন স্থাপনের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে অবস্থানরত বাংলাদেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা, তাদের মাধ্যমে সেসব দেশে জনমত তৈরি এবং সরকারের সমর্থন লাভের প্রচেষ্টা চালায়। এছাড়া বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে।

প্ল্যানিং সেল
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্ল্যানিং সেল গঠন ছিল সরকারের একটি পূর্ব প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ। স্বাধীনতা অর্জনের পরপর যাতে বাংলাদেশকে দ্রুত পুনর্গঠিত করা যায় এবং নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের উন্নয়ন ভাবনা ও পন্থা কী হবে তা নির্ধারণের অগ্রিম দায়িত্ব দিয়ে এ সেল গঠিত হয়েছিল। এর সদস্যরা ছিলেন- ১. ড. মুজাফ্ফার আহমেদ ……. চৌধুরী, ২. ড. খান সরওয়ার মুরশিদ, ৩. ড. মুশাররফ হোসেন, ৪. ড. স্বদেশ বোস ও ৫. ড. আনিসুজ্জামান।

তথ্য ও বেতার
আবদুল মান্নান (টাঙ্গাইল) এমএনএ বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতারের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র জয়বাংলা পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন।

যুবশিবির
মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপুল সংখ্যক ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক ও রাজনৈতিক দলের কর্মী ভারতে যায়। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণের পরিবর্তে এদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ট্রেনিং নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। বাংলাদেশ সরকারকে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও পরিকল্পিতভাবে এদের পরিচালনা করতে হয়। এজন্য চার শ্রেণির শিবির স্থাপন করা হয়, যথা- অভ্যর্থনা (Reception), উদ্বুদ্ধকরণ (Motivation), মৌলিক প্রশিক্ষণ (Base Training) ও মিলিটারি প্রশিক্ষণ (Military Training)। এরপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের পারদর্শিতা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োজিত করা হয়। এসব শিবির থেকে ছাত্রলীগ এর নেতা-কর্মীদের বাছাই করে প্রশিক্ষণ দিয়ে মুজিব বাহিনী-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দেশের পূর্বাঞ্চলের যুবকদের নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে প্রথম যুবশিবির প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জুলাই মাস নাগাদ পূর্বাঞ্চলেই যুবশিবিরের সংখ্যা ছিল ৩৩টি। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও যুবশিবির প্রতিষ্ঠা লাভ করে। একটি বোর্ডের মাধ্যমে যুবশিবির সরকারের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়। ঐ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ এবং পরিচালক ছিলেন উইং কমান্ডার মির্জা। এছাড়া মাঠ পর্যায়েও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে অন্তর্ভুক্ত করে যুবশিবির পরিচালন বোর্ড গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় বোর্ড, মাঠ পর্যায়ের বোর্ড, জোনাল কাউন্সিল, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে সকল শ্রেণির যুবশিবিরের কার্যক্রম তদারকি ও পরিচালন করত।

যুদ্ধ পরিচালনা
মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ ও স্বাধীনতা অর্জনই ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের একমাত্র লক্ষ্য। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সরকারের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। উল্লেখ্য, ১১ই জুলাই যুদ্ধাঞ্চলসমূহকে পুনর্বিন্যস্ত করে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং প্রত্যেক সেক্টরের দায়িত্ব একজন সেক্টর কমান্ডারের ওপর ন্যস্ত করা হয়। অভ্যন্তরীণভাবে প্রত্যেক সেক্টরকে একাধিক সাব-সেক্টরে বিভক্ত করে প্রত্যেকটিতে একজন সাব-সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। যুদ্ধকালে যাঁরা ১১টি সেক্টরে কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন— মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর এম আবুল মঞ্জুর, মেজর এম এ জলিল, মেজর আবু তাহের, মেজর রফিকুল ইসলাম, মেজর এ টি এম হায়দার, মেজর এ এন এম নুরুজ্জামান, মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, মেজর মীর শওকত আলী, উইং কমান্ডার এম কে বাশার, মেজর খন্দকার নাজমুল হক, মেজর কাজী নুরুজ্জামান ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহ খান। এছাড়া যুদ্ধের এক পর্যায়ে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ‘জেড-ফোর্স’, ‘এস- ফোর্স’ ও ‘কে-ফোর্স’ নামে ৩টি নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করা হয়। ৩ জন ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ ও মেজর খালেদ মোশাররফ। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রধান সেনাপতি সেক্টর কমান্ডার ও ব্রিগেড কমান্ডারদের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। উল্লেখ্য, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ওপর ন্যস্ত ছিল এবং তিনি এর কার্যাবলি তদারক করতেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মুক্তাঞ্চল ও শরণার্থী ক্যাম্পে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল। প্রথমে আইজিপি, পরে সচিব হিসেবে নিযুক্ত আব্দুল খালেক পিএসপি এ মন্ত্রণালয়কে প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত করে এর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন।

আঞ্চলিক প্রশাসন: জোনাল কাউন্সিল
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আঞ্চলিক প্রশাসন স্থাপন ও পরিচালনা ছিল বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্পূর্ণ নতুন চিন্তাধারার ফসল। পূর্ণাঙ্গ একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করে এর অধীনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগীয় কার্যক্রম পরিচালনা এবং মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত সেক্টর কমান্ডার ও মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান ছিল এর ভাবনামূলে। এ লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১১ই জুলাই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সভায় ১১টি সেক্টরের সঙ্গে ১১টি আঞ্চলিক পরিষদ (Zonal Councils) প্রতিষ্ঠা করা হয়। জোনাল কাউন্সিলের অধীনে কতিপয় সাব-কমিটি ছিল, যথা- অর্থ উপ-কমিটি, ত্রাণ উপ- কমিটি, স্বাস্থ্য উপ-কমিটি, প্রচার উপ-কমিটি ও শিক্ষা উপ- কমিটি। নির্দিষ্ট এলাকার নির্বাচিত এমএনএ/এমপিএ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জোনাল কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। তাঁদের মধ্য থেকে একজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১১টি আঞ্চলিক পরিষদে যাঁরা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা হলেন— নূরুল ইসলাম চৌধুরী এমএনএ (চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী); জহুর আহমদ চৌধুরী এমএনএ (ঢাকা, কুমিল্লা ও নোয়াখালী); কর্নেল এম এ রব এমএনএ (হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার); দেওয়ান ফরিদ গাজী এমএনএ (সিলেট সদর ও সুনামগঞ্জ); শামসুর রহমান খান এমএনএ (ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল); মতিউর রহমান এমএনএ (রংপুর), আব্দুর রহিম এমএনএ (দিনাজপুর ও বগুড়া); আশরাফুল ইসলাম মিয়া এমএনএ (রাজশাহী); এম এ রউফ চৌধুরী এমপিএ (পাবনা ও কুষ্টিয়া); ফণিভূষণ মজুমদার এমপিএ (যশোর ও ফরিদপুর) ও আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ (বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনা)। জোনাল কাউন্সিলকে প্রশাসনিক সাহায্য দেয়ার জন্য প্রত্যেকটিতে একজন করে আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা (Zonal Administrator) নিয়োগ করা হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাগণ নিযুক্ত হন। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর শাসনভার গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত এ প্রশাসনিক কাঠামো কার্যকর ছিল।
আঞ্চলিক পরিষদ এবং দপ্তরগুলো প্রতিষ্ঠার ফলে দেশ সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হওয়ার পূর্বেই সরকারের নিজস্ব এক প্রকার প্রশাসনিক প্রস্তুতি ছিল। সে-কারণে ১৬ই ডিসেম্বরেই (কোনো-কোনো ক্ষেত্রে তার আগেই) মুজিবনগর সরকারে নিয়োজিত সকল জেলা প্রশাসক/পুলিশ সুপার ও অন্যান্য কর্মকর্তাগণ স্ব-স্ব পদে যোগদান করে কালবিলম্ব না করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

মুক্তাঞ্চলে প্রশাসন
মুজিবনগর সরকারের সকল দপ্তর কলকাতায় অবস্থিত হলেও এর পরিচালন, ব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রম শুধুমাত্র প্রবাসে সীমাবদ্ধ ছিল না। বিশেষ করে যুদ্ধের শেষের দিকে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। তাছাড়া দেশের বহু এলাকা শত্রুবাহিনী শুরু থেকেই আদৌ দখল করতে পারেনি। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধকালে সেসব অঞ্চল শত্রুমুক্ত ছিল। যেমন রংপুরের উত্তর-পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের বহু এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল এবং তা সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধের নয় মাস মুক্ত রাখা হয়। শুধু তাই নয়, ক্রমান্বয়ে মুক্তাঞ্চল সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশের লাল- সবুজের পতাকা যেখানে একবার উড্ডীন হয়েছে, সেখানে তা আর নামেনি। কুড়িগ্রামের রৌমারি মুক্ত এলাকার কথা সবার জানা। চিলমারী (কুড়িগ্রাম) এবং দিনাজপুরের বড় একটি অংশ মুক্ত ছিল। যুদ্ধকালে এসব অঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ফেনী-বেলোনিয়ার মুক্তাঞ্চলও সরকারের স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনের আওতাধীন ছিল। এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা এবং জনগণ যুদ্ধ ও প্রশাসন পরিচালনায় সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করে। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ-এর যুদ্ধকালে নির্মিত ‘মুক্তির গান’ ভিডিও-সিডিতে এসব মুক্তাঞ্চলের বাস্তব চিত্রের বর্ণনা ফুটে উঠেছে।
সরকারের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসকগণ মুক্ত এলাকাগুলোতে অবাধে যাতায়াত করতেন। নিকটবর্তী আঞ্চলিক প্রশাসনের (Zonal Council) অধীনে সেসব এলাকায় বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকার পরিকল্পিতভাবে ঐসব অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণের জন্য খাদ্য, বস্ত্র ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ নিশ্চিত করে। সেক্টর কমান্ডারগণ মুক্তাঞ্চল থেকেই শত্রু-অধিকৃত অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করতেন। গেরিলাদের দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো। সরকারের পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী কমান্ডারগণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি থেকে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত সেক্টর এবং সাব-সেক্টর কমান্ডারগণ সার্বক্ষণিকভাবে মুক্তাঞ্চল প্রহরা এবং প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেন। তাঁরা ঐসব অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলাও বজায় রাখেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত অসংখ্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে দেশে ও বিদেশে অনেক প্রামাণ্য চিত্র তৈরি হয়েছে। সেসব প্রামাণ্যচিত্রে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিবর্গের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন, জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতা ইত্যাদি দৃশ্যমান। তাঁদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার বা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিও লক্ষণীয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- থেকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস মুক্তাঞ্চলভিত্তিক এসব এবং অন্য অনেক অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়।
বিদেশী জনপ্রতিনিধি, সংবাদ মাধ্যম ও পত্র-পত্রিকার প্রতিনিধিরা মুজিবনগরে এসে মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনে যেতেন। Time Magazine, Newsweek, Reader’s Digest, London Times, Gaurdian, New York Times, Washington Post, La Monde, Reuter, AFP, AP সহ আরো অনেক সাংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ বিভিন্ন সময়ে মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন শেষে ফিরে গিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তাঁদের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনের যাবতীয় ব্যবস্থা বাংলাদেশ সরকারই করত। এক্ষেত্রে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তাও গ্রহণ করা হতো।
মুক্তিযুদ্ধকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আকারে বিশাল না হলেও তা অত্যন্ত সুসংগঠিত ছিল। প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে এ সরকার গঠন করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একদিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দান, অন্যদিকে ভারতে আশ্রয় নেয়া এক কোটির ওপর শরণার্থীর জন্য ত্রাণব্যবস্থা, দেশের ভেতর থেকে আসা লক্ষলক্ষ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা ও যুবকদের যুবশিবিরে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা, মুক্তাঞ্চলে প্রশাসন চালানো, বিশ্ব জনমত গঠন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতা সমন্বয় ইত্যাদি ছিল বাংলাদেশ সরকারের অবিস্মরণীয় কীর্তি, যা সমকালীন ইতিহাসে অতুলনীয়। [এইচ টি ইমাম ও হারুন-অর-রশিদ] তথ্যসূত্র: এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, বাংলা একাডেমি, ২০১২

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড