You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর ঘোষণায় বলেন:
This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.
বাংলা (অনূদিত)
ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।
শেখ মুজিবুর রহমান
২৬শে মার্চ ১৯৭১

বঙ্গবন্ধুর এ স্বাধীনতা ঘোষণা আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান বাঙালির আশা- আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই সর্বক্ষেত্রে বাঙালিদের ওপর প্রতিষ্ঠা পায় ঔপনিবেশিক ধাচের পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন-শোষণ, বৈষম্য ও জাতি-নীপিড়ন। উদ্ভূত রাজনৈতিক অবস্থায় ভাষা- আন্দোলন-কে কেন্দ্র করে নতুন আঙ্গিকে শুরু হয় বাঙালির জাতীয় মুক্তির লড়াই। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভাষা-আন্দোলনের প্রথম (১১ই মার্চ ১৯৪৮) রাজনৈতিক বন্দিদের অন্যতম। ভাষা-আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে কারাগারে বন্দি অবস্থায় তিনি এক নাগাড়ে ১১ দিন অনশন পালন করেন। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোয় বাঙালির জাতীয় বা সার্বিক মুক্তি যে সম্ভব নয়, সেটি তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই ১৯৬৬ সালে ‘আমাদের বাঁচার দাবী’: ৬ দফা খ্যাত বাঙালির মুক্তির সনদ তিনি পেশ করেন। আইয়ুব সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার, তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা মামলায় (১৯৬৮) রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে ক্যান্টনমেন্টে বিচার অনুষ্ঠান, ৬-দফা ও ছাত্র সমাজের ১১-দফা কর্মসূচির সমর্থকদের ওপর সরকারি চরম নির্যাতন-নিষ্পেষণ ইত্যাদির পরিণতিতে সংঘটিত হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতন ঘটলে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতাসীন হন এবং সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন দিতে তিনি বাধ্য হন, যা ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ – ৬-দফার সমর্থনে গণম্যান্ডেট লাভ করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন (৭টি মহিলা আসনসহ) পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আবির্ভূত হয়। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। এরই অংশ হিসেবে ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ২দিন পূর্বে ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষণা করা হয়। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন, যা ২৫শে মার্চ পর্যন্ত চলে। এ-সময় বাঙালি জাতির বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটে। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এ ১০ লক্ষ জনতার এক উত্তাল মহাসমুদ্রকে সম্মুখে রেখে তিনি বাঙালি জাতির উদ্দেশে মুক্তির চূড়ান্ত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ সরাসরি না হলেও বস্তুত এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় স্বাধীন প্রশাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাঁর ৩২ নম্বর ধানমন্ডি বাসভবন থেকে ঐ প্রশাসন পরিচালিত হয়। অতঃপর ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু তাদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে স্বাধীনতার উল্লিখিত ঘোষণা প্রদান করেন। ঐ রাতেই তাঁর স্বকণ্ঠের ঘোষণা বার্তা টরেটক্কা মোর্স কোডে ইপিআর (বর্তমান বিজিবি)-এর সুবেদার মেজর শওকত আলী পিলখানায় তাঁর বাসা থেকে পোর্টেবল ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ইপিআর ওয়ারলেস উইং-এ ট্রান্সমিট করেন, যা দ্রুত বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র পৌঁছে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করা বিদেশী জাহাজ ও পাকিস্তানি সামরিক জান্তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ধরা পড়ে। এরপর ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ১০ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম কে উপ- রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ-কে প্রধানমন্ত্রী করে ৬- সদস্যের প্রথম ~ বাংলাদেশ সরকার- (যা মুজিবনগর সরকার- নামে বহুল পরিচিত) গঠিত এবং বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে ভিত্তি ধরে একই সভায় স্বাধীনতার সাংবিধানিক ঘোষণাপত্র (Proclamation of Independence) গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ২৬শে মার্চ এ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস। পঞ্চদশ সংশোধনী (জুলাই ২০১১)-তে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি তফশিল আকারে বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড