You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বাঁশখালী উপজেলা (চট্টগ্রাম)

বাঁশখালী উপজেলা (চট্টগ্রাম) পূর্বে পাহাড়রাজি (সাতকানিয়া), পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে সাঙ্গু নদী (আনোয়ারা) এবং দক্ষিণে পেকুয়া (সাবেক চকরিয়া) দ্বারা বেষ্টিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি ছিল একটি দুর্গম এলাকা। চট্টগ্রামের সঙ্গে এর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না। দুর্গম এলাকা হলেও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ-এর নেতৃবৃন্দের সক্রিয় ভূমিকার কারণে বাঁশখালীবাসী মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। আতাউর রহমান খান কায়সার এমএনএ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ (পরবর্তীতে এমপি), চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জাকেরুল হক চৌধুরী (পরবর্তীতে এমপি), বামপন্থী নেতা অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন আহমেদ (৫৪’র যুক্তফন্ট-এর নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্য), ননী গোপাল দত্ত (কমরেড মোস্তাক নামে খ্যাত), জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক মোখতার আহমদ (পরবর্তীতে এমপি), চট্টগ্রামের ছাত্রনেতা ছৈয়দ আহমদ (বৃহত্তর চট্টগ্রাম গেরিলা বাহিনীর প্রধান), দানেশ আহমদ চৌধুরী (পরবর্তীতে লাল বাহিনীর প্রধান), শাহ-ই- জাহান চৌধুরী (পরবর্তীতে এমপি), সুলতানুল কবির চৌধুরী (পরবর্তীতে এমপি) প্রমুখের নেতৃত্বে বাঁশখালীতে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয়।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন-সহ প্রগতিশীল দলসমূহের নেতা-কর্মীরা সম্মিলিতভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। প্রশিক্ষণ প্রদানে বিশেষ ভূমিকা রাখেন অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে আসা সামরিক বহিনী, পুলিশ বাহিনী এবং স্থানীয় আনসার বাহিনীর সদস্যরা। ২৬শে মার্চ থেকে ছাত্র-জনতা বাঁশখালীর বিভিন্ন সরকারি অফিসে উপস্থিত হয়ে কর্মকর্তা- কর্মচারীদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে আবেদন জানালে তাতে তাঁরা সকলেই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেন। পুরো এপ্রিল মাস বাঁশখালী ছিল মুক্ত এলাকা। ফলে এ সময়টা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য অনুকূল ছিল।
মোখতার আহমদ, সুলতানুল কবির চৌধুরী, ডা. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ চৌধুরী, নুরুল আনোয়ার চৌধুরী, ওয়াজেদ আলী খান, শফিকুল ইসলাম, খন্দকার ছমিউদ্দিন, সুশীল চন্দ্ৰ রায়, সুলতান আহমেদ আনোয়ার প্রমুখের নেতৃত্বে সমগ্র বাঁশখালীতে মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ গঠিত হয়। বাঁশখালী, আনোয়ারা ও কুতুবদিয়া থেকে নির্বাচিত আতাউর রহমান খান কায়সার এমএনএ নানা স্থানে দূত পাঠিয়ে সার্বিক খোঁজ- খবর নিতে থাকেন। মার্চ মাসে অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ ছাত্র-যুবক ও সংগ্রামী জনতাকে নিয়ে বাঁশখালীর প্রধান সড়কে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিশাল প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। আগস্ট মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র কেনার লক্ষ্যে সুলতান আহমেদ আনোয়ার ও খন্দকার ছমিউদ্দিনের নেতৃত্বে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। খাজনা- ট্যাক্স আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য মুক্তিযোদ্ধারা বাঁশখালীর সব তহশীল অফিস জ্বালিয়ে দেন। পাকবাহিনীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য চট্টগ্রাম শহর থেকে নানা দুর্গম পথ দিয়ে আগত হাজার-হাজার উদ্বাস্তু জনতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নবগঠিত মুক্তিযোদ্ধা দলের সদস্য ও স্থানীয় সংগঠকরা নানাবিধ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। বাঁশখালীর অধিকাংশ এলাকায় ট্রেনিং-এর জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো গ্রুপ সৃষ্টি হয়। সমন্বয়কারী জনাব আতাউর রহমান খান কায়সার নানাভাবে হালকা ও মাঝারি অস্ত্র সংগ্রহ করে বিভিন্ন গ্রুপের নিকট পৌছানোর চেষ্টা করেন। স্থানীয় জনতা যে যেভাবে পারে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করে। অনেকে অস্ত্র কেনার জন্য অর্থ সাহায্য করে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা নানা উপায়ে অস্ত্র সংগ্রহে তৎপর হন।
বাঁশখালী উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য সংগঠকরা হলেন- অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ, আতাউর রহমান খান কায়সার এমএনএ, আবদুচ ছবুর এডভোকেট (সভাপতি, বাঁশখালী থানা ২২°১৮ আওয়ামী লীগ), নুরুল আনোয়ার চৌধুরী (সাধারণ সম্পাদক, বাঁশখালী থানা আওয়ামী লীগ), সুশীল চন্দ্র রায়, ওয়াজেদ আলী খান (সহ-সভাপতি, বাঁশখালী থানা আওয়ামী লীগ), ছৈয়দুল হক চৌধুরী, শেখ মর্তুজ আলী চৌধুরী, মোহাম্মদ মিয়া কন্ট্রাক্টর, জাকেরুল হক চৌধুরী, মফজল আহমদ চেয়ারম্যান, মোকারেমুল কাদের চৌধুরী (ছাত্রনেতা), এস এম শাহ আলম (ছাত্রনেতা), শাহ-ই-জাহান চৌধুরী (ছাত্রনেতা), জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান, ননী গোপাল দত্ত (বামপন্থী নেতা), দানেশ আহমাদ চৌধুরী, সুলতানুল কবির চৌধুরী, নুরুল কবির চৌধুরী প্রমুখ।
এ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার, ছিলেন ২১°৫৬’ মোখতার আহমদ (বাঁশখালী, আনোয়ারা ও কুতুবদিয়া থানার এফএফ কমান্ডার) এবং ডা. মো. আবু ইউছুফ চৌধুরী (বাঁশখালী ও কুতুবদিয়া থানার বিএলএফ কমান্ডার)। এছাড়া স্থানীয় অপারেশন কমান্ডার ছিলেন- সুলতানুল কবির চৌধুরী, ২১°৫২′ উ শফিকুল ইসলাম, সুভাষ চন্দ্র আচার্য, খন্দকার ছমিউদ্দিন, মোহাম্মদ হাসেম, স্বপন ভট্টাচার্য, রঞ্জিত রঞ্জন চৌধুরী, বিধান চন্দ্র দে ও মানবেন্দ্ৰ মিত্ৰ চৌধুরী।
পশ্চিম বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকায় পাকহানাদার বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ ‘আকবর’ ও ‘বাবর’ নোঙর ফেলবে এ মর্মে খবর প্রচারিত হলে শতশত সংগ্রামী জনতা বন্দুক, দা, কুড়াল, লাঠি ‘যার যা আছে তা নিয়ে’ যুদ্ধ জাহাজ প্রতিরোধের জন্য সাগরপাড়ে এগিয়ে যায়। স্থলপথে বাঁশখালীতে প্রবেশের একটি মাত্র পাহাড়ি পথে প্রতিরোধ যোদ্ধারা এম্বুশ করে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ৪ঠা এপ্রিল বানীগ্রামের সুশীল চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে ৮০ জনের একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীর গ্রুপ লিডার ছিলেন সুভাষ চন্দ্র আচার্য, বিধান চন্দ্র দে, স্বপন ভট্টাচার্য ও রঞ্জিত রঞ্জন চৌধুরী।
নেজামে ইসলামী-র নেতা আহমেদ ছগীর শাহজাদা এমপিএ ও মুসলিম লীগ নেতাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকবাহিনী ১৯শে মে বাঁশখালীতে প্রথম অনুপ্রবেশ করে। ঐদিন তারা বাঁশখালীর পুর্বাঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন ও লুটতরাজ করে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। এরপর ৭ই সেপ্টেম্বর পুনরায় তারা বাঁশখালীতে এসে গুনাগুরি ওয়াপদা অফিস কাম রেস্ট হাউজে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং ৩০শে অক্টোবর পর্যন্ত এখানে অবস্থান করে হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালায়।
বাঁশখালীতে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন হিসেবে তৎপর ছিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী- ও নেজামে ইসলামী। ৭০-এর নির্বাচনে সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ সত্ত্বেও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বাঁশখালীতে নেজামে ইসলামীর প্রার্থী আহমেদ ছগীর শাহজাদা (একজন বুজুর্গ পুত্র) জয়লাভ করে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তার হিংস্রতার আসল রূপ প্রকাশ পায়। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে স্বাধীনতাবিরোধীরা সংগঠিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে -রাজাকারআলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। আহমদ শফি (শফি মাস্টার, পুইছড়ি; পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), শামসুল ইসসাম চৌধুরী (কালিপুর), মৌ, হোসাইন (সরল ; পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), ছাবের আহমদ চৌধুরী (বাহারচরা), শফি চৌধুরী (গুনাগুরি), নুরুল ইসলাম চৌধুরী (বৈলছড়ি), বদরুল হক চৌধুরী (কোটপাড়া পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), ছোট মিয়া (রায়ছটা), ছৈয়দ আহমদ চৌধুরী (পুইছড়ি), আনোয়ারুল আজীম ভোলা (চেচুরিয়া), হারুনুর রশীদ চৌধুরী (জলদী), ডা. মনিরুল আলম চৌধুরী (বৈলছড়ি), মোহাম্মদ ইউনুচ (বৈলগাঁও), সিরাজুল ইসলাম (বৈলগাঁও), নাসিরুদ্দিন (পুকুরিয়া; পরে পাকিস্তানে পালিয়ে যায়), হাফিজ আহমদ তালুকদার (খানখানাবাদ), এয়ার আলী (সাধনপুর), লোকমান আহমদ চৌধুরী (মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত), জমীর মাস্টার (বৈলছড়ি), রশিদ আহমদ বুড্ডা (বৈলছড়ি) প্রমুখের নেতৃত্বে এসব বাহিনী গঠিত হয়। এদের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর দোসররা নানারকম অপকর্ম করে। তারা বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে অপপ্রচার চালায়। চট্টগ্রাম শহর থেকে আশ্রয়ের জন্য আসা লোকজন ও তাদের আশ্রয়তাদাদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও নির্যাতন করে। তারা পাকবাহিনীকে বাঁশখালীতে পথ দেখিয়ে করে নিয়ে আসে। হিন্দুপাড়া, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও নারীনির্যাতনে পাকসেনাদের সহযোগিতা করে। পাকবাহিনীর দোসর রাজাকার আলবদররা এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে ঐ ক্যাম্পে স্থানীয় লোকদের ডেকে এনে ভয়-ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করে।
এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা বাঁশখালীর পুর্বাঞ্চলের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা বানীগ্রাম, সাধনপুর, কোকদন্ডী, পালেগ্রাম, কালীপুর, জলদী ও চাম্বল নাপোড়ায় লুণ্ঠন ও নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটায়। ১৯শে মে সকালে তারা বানীগ্রাম থেকে জলদী পর্যন্ত পাঁচ হাজারের মতো বাড়িঘর গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। তারা ব্যাপকহারে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ও মূল্যবান আসবাবপত্র লুট করে ঐদিন সন্ধ্যায় বাঁশখালী ত্যাগ করে।
৭ই সেপ্টেম্বর পাকবাহিনী জলদী, শীলকূপ, চাম্বল, শেখেরখীল ও নাপোড়ার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার অসংখ্য ন বাড়িঘর গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে তারা লুটপাট, নারীনির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকসেনারা – বানীগ্রামে ২২ জন, সাধনপুরে ১০ জন, কোকদন্ডীতে ২২ জন, কালীপুর পালেগ্রামে ১৩ জন, জলদীতে ৪ জন, নাপোড়ায় ১৭ জন এবং জলদী-শেখেরখীলে ৭ জনকে হত্যা করে। আহমদ শফি ও তার সহযোগীরা মুক্তিযোদ্ধা মুরিদুল আলমকে হত্যা করে। এ উপজেলায় ৬টি গণহত্যা সংঘটিত হয়- বানীগ্রাম গণহত্যা, সাধনপুর গণহত্যা, কোকদন্ডী গণহত্যা, কালীপুর পালেগ্রাম গণহত্যা, নাপোড়া গণহত্যা এবং জলদী-শেখেরখীল গণহত্যা। গুনাগুরি সেনা ও মিলিশিয়া ক্যাম্প এবং বৈলগাঁও সিরাজ মিয়ার বাড়ির রাজাকার ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। এখানে ১৯শে মে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা এক গণহত্যা সংঘটিত করে। বানীগ্রামের ক্ষীরোধ চন্দ্র দাশের পুকুরপাড়ে ১৮ জনের গণকবর রয়েছে, যা বানীগ্রাম গণকবর- নামে পরিচিত। বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজের পাহাড়ে ১৩ জনের গণকবর রয়েছে (স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অনেকের মৃতদেহ তুলে নেয়া হয়), যা বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ গণহত্যা ও গণকবর- হিসেবে পরিচিত।
৬ই অক্টোবর পাকবাহিনীর একটি গ্রুপ বানীগ্রামের পূর্বদিকে গভীর অরণ্যে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে অগ্রসর হয়। এ খবর পেয়ে মোহাম্মদ হাসেম ও খন্দকার ছমিউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি গ্রুপ পাহাড়ি ঝোপের আড়াল থেকে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলির পর পাকসেনারা তাদের ৩ জন আহত সৈনিক নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এটি বানীগ্রাম যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ১৭ই নভেম্বর ভোর ৪টার দিকে সার্জেন্ট মহিউল আলমের নেতৃতে মুক্তিযোদ্ধারা সাধনপুর ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ অপারেশনে একজন রাজাকার নিহত হয়। সাধনপুর রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন-এ মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট মহিউল আলম শহীদ হন (তাঁর বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ, তিনি ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের অপারেশন কমান্ডার)। ১১ই ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা গুনাগুরি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা যুদ্ধের পর ১২ই ডিসেম্বর দুপুরে এ ক্যাম্পের পতন ঘটে। – গুনাগুরি রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন-এর মধ্য দিয়ে বাঁশখালী শত্রুমুক্ত হয় এবং ঐদিন ডা. ইউসুফের নেতৃত্বে গুনাগুরি ওয়াপদা অফিসে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা বাঁশখালীতে স্থানীয়ভাবে বেশকিছু অপারেশন করেন। তারা গুনাগুরি, খানখানাবাদ ও বানীগ্রাম তহশীল অফিস আক্রমণ করে নথিপত্র নষ্ট করে দেন, যাতে পাকিস্তানি সরকার জনগণের কাছ থেকে খাজনা-ট্যাক্স আদায় করতে না পারে। চুড়ামনি বন অফিসে অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে অস্ত্র উদ্ধার করেন। জলদীর সিও রেভিনিউ অফিস এবং টেলিফোন অফিস ধ্বংস করে দেন। মুক্তিযোদ্ধারা পুঁইছড়ি ও চাম্বল রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন করেন, তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তাঁরা চাঁনপুর খাদ্যগুদাম আক্রমণ করে পাহারাদারদের অস্ত্র নিয়ে নেন এবং মজুতকৃত খাদ্যশস্য জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দেন। বানীগ্রাম বন অফিস আক্রমণ করে ১২ বোরের বন্দুক উদ্ধার করেন। সাতকানিয়া ও বাঁশখালীর সংযোগস্থলে গিরিপথ সদৃশ্য রাস্তায় শত্রুবাহিনীর প্রবেশ ও আক্রমণ ঠেকানোর জন্য শক্তিশালী গ্রেনেড নিয়ে এম্বুশ করেন। বাঁশখালী থানা আক্রমণ করে তাঁরা পুলিশ বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। পুঁইছড়ির রাজাকার কমান্ডার আহমদ শফির বাড়ি আক্রমণ করেন এবং এতে শফি নিহত হয়। গন্ডামারার রাজাকার কমান্ডার মৌ. হোসাইনের বাড়ি আক্রমণ করেন এবং এ অপারেশনে হোসাইন নিহত হয়। পাকিস্তান সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী লাইসেন্সধারী বন্দুক মালিকরা বন্দুক জমা দিতে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছ থেকে ৫টি বন্ধুক নিয়ে নেন। তাঁরা শান্তি কমিটির সদস্য কোটপাড়ার বদরুল হক চৌধুরীকে হত্যা করেন।
২৭শে জুন মুক্তিযোদ্ধারা বানীগ্রাম বাজারে বৈলগাঁওএর রাজাকার কমান্ডার ইউনুচের ঔষধের দোকানে স্বাধীনতাবিরোধীদের আড্ডাখানায় অভিযান চালিয়ে তা ধ্বংস করে দেন। ৩০শে জুলাই তাঁরা পাহাড়ে আশ্রিত কয়েক হাজার গ্রামবাসীর নিরাপত্তায় কারফিউ জারির পোস্টার লাগান এবং প্রশিক্ষণের মহড়া দেন।
১৬ই সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করেন। এ অপারেশনে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ২৫শে সেপ্টেম্বর বানীগ্রাম বাজারের লুটের মাল নিয়ে বৈলাগাঁও বাজারে প্রতিষ্ঠিত নতুন মুদির দোকানে স্বাধীনতাবিরোধীরা আড্ডা দিচ্ছিল। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঐ আড্ডাখানায় অভিযান চালিয়ে তা জ্বালিয়ে দেন। ২৭শে সেপ্টেম্বর তারা বৈলগাঁও- এর রাজাকার কমান্ডার ইউনুচের বাড়ি আক্রমণ করেন। এ অপারেশনে ইউনুচের বাবা ফারুক আহমেদ নিহত হয়। ৩০শে সেপ্টেম্বর চুরি, ডাকাতি ও লুটপাট বন্ধে মুক্তিবাহিনী গ্রামে-গ্রামে কারফিউ জারি করে এবং কারফিউ ভঙ্গের শাস্তি প্রদানের ঘোষণা দেয়। ১লা অক্টোবর মুক্তিবাহিনী পাহাড়ে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং কয়েক হাজার মানুষকে পাকবাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য ট্রেন্স খনন করে।
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে বাঁশখালীতে সংগঠিত মাওবাদী বামপন্থীরা ‘বিপ্লবী বাহিনী’ নামে একটি বাহিনী গঠন করে। তারা একদিকে পাকিস্তান সরকার এবং অপরদিকে ভারত সরকারবিরোধী প্রচারণা চালালে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাদের মতানৈক্য ঘটে। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষ মারমুখী অবস্থান নেয় এবং একদিন মুক্তিবাহিনীর আতর্কিত আক্রমণে বামনেতা প্রাণ কুমার ভট্টাচার্য ও কৃষকনেতা আবু ছাদেকসহ ১৪ জন নিহত হয়। পরে দলের বাকি দুজনও পাকবাহিনী ও বদরবাহিনীর হাতে নিহত হয়।
বাঁশখালী উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মুরিদুল আলম (আওয়ামী লীগ নেতা, চন্দনাইশ; পুঁইছড়িতে শহীদ), ফরিদুল আলম (চন্দনাইশ, পুঁইছড়িতে শহীদ), সার্জেন্ট মহিউল আলম (মেহেন্দীগঞ্জ, বরিশাল; সাধনপুরে শহীদ), বিজয় কুমার দেব (পুঁইছড়িতে শহীদ), মোহাম্মদ ফরহাদ চৌধুরী (বৈলছড়ি, কক্সবাজারে শহীদ), সমরেন্দ্র লাল দে (জলদী; ইপিআর সদস্য, চট্টগ্রাম), আবু সাইদ (বুরুমচরা, পার্বতীপুরে শহীদ), মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন (গুনাগুরি, খুলনায় শহীদ), রুহুল আমিন (প্রেমাসিয়া, চট্টগ্রামের নতুনপাড়ায় শহীদ), মোহাম্মদ ইলিয়াছ (কালিপুর; ঢাকার ওয়ারীতে শহীদ), ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রহমান (বরইতলী; চট্টগ্রাম শহরে সেনা অস্ত্র কারখানায় শহীদ) এবং মৌলভী আবদুল কাদের (চাপাছড়ি; চট্টগ্রাম বন্দর অফিসে কর্মরত অবস্থায় শহীদ)।
এখানকার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আবু মোহাম্মদ ছরওয়ার হোসাইন (রায়ছটা), মো. শহীদুল্লাহ (ছনুয়া), আবদুল কাদের (ডোংরা) ও শফিকুল ইসলাম (পুকুরিয়া)। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ সংলগ্ন বধ্যভূমিটি চিহ্নিত রয়েছে। এ গণকবর সংলগ্ন স্থান ও বানীগ্রাম বধ্যভূমিতে যথাক্রমে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিনের নামে গুনাগুরিতে একটি এবং সার্জেন্ট মহিউল আলমের নামে বানীগ্রামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!