You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বাকেরগঞ্জ উপজেলা (বরিশাল)

বাকেরগঞ্জ উপজেলা (বরিশাল) ১৮৭৪ সালে থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৩ সালে এটি উপজেলায় উন্নীত হয়। স্থানীয় জমিদার আগাবাকের খানের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। তের ঘর জমিদারদের চারণভূমি হিসেবে পরিচিত বাকেরগঞ্জ উপজেলার উত্তরে বরিশাল সদর ও নলছিটি, দক্ষিণে বাউফল, মীর্জাগঞ্জ ও দুমকী উপজেলা, পূর্বে ভোলা ও বাউফল এবং পশ্চিমে কাঁঠালিয়া ও রাজাপুর উপজেলা। এ উপজেলায় ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা রয়েছে। নিজেদের অধিকার আদায়ে বাংলাদেশের সকল জেলা ও উপজেলার মতো বাকেরগঞ্জ উপজেলাও মহান মুক্তিযুদ্ধে এক গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টি করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ – সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানিদের চক্রান্ত প্রতিহত করার জন্য বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন-এর ঘোষণা দেন। তাঁর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ অনুধাবন করে বাকেরগঞ্জে আবদুল মান্নান হাওলাদার এমএনএ এবং মোজাম্মেল হোসেন সিকদার এমপিএ-এর নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এর পূর্বে বরিশাল জেলা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। বাকেরগঞ্জ সংগ্রাম কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- আওয়ামী লীগের সভাপতি মানিক লাল চক্রবর্তী (পরবর্তীতে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ), শওকত সন্নামত (ফরিদপুর ইউনিয়ন), ইউসুফ হাওলাদার (নেয়ামতি), বাবু মিয়া (দাড়িয়াল), আলাউদ্দিন মাস্টার (পাদ্রী শিবপুর), গিয়াস মোল্লা (রঙ্গশ্রী), আলতাফ উদ্দিন খান (গারুড়ীয়া), আবদুর রাজ্জাক, মনু তালুকদার (কলসকাঠী), ফকরুদ্দীন ডাকুয়া (ভরপাশা), সাত্তার মাস্টার (রঙ্গশ্রী), খান আলতাফ হোসেন ভুলু (দুধল), মানিক হোসেন মোল্লা (ভরপাশা), মজিবর তালুকদার (দুর্গাপাশা) প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ সমস্ত উপজেলায় জনসংযোগ করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী কথাগুলো ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ মানুষের মধ্যে প্রচার করেন।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার তারবার্তাটি বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম মঞ্জুর কাছে পৌঁছলে তিনি তার অনুলিপি তাৎক্ষণিকভাবে ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরে পাঠিয়ে দেন। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের ছাত্রলীগ – নেতা খান আলতাফ হোসেন ভুলু এবং এমএনএ ও এমপিএ-দের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাকেরগঞ্জ উপজেলায় পৌঁছে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে বাকেরগঞ্জের ছাত্র-যুবক ও সাধারণ মানুষ দেশকে হানাদারমুক্ত করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর ২৫শে মার্চের গণহত্যা ও ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর বরিশাল শহরে দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে একটি ছায়া সরকার গঠন করা হয়। বরিশালের আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএ-দের নিয়ে স্বাধীন বাংলার প্রথম সচিবালয় গঠিত হয়। জেলার সকল প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড এ সচিবালয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বরিশাল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে সচিবালয়ের হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন করা হয়। এখানকার নির্দেশে বাকেরগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাকেরগঞ্জে পৌঁছলে থানা ও সরকারি অফিস-আদালতসহ সকল দপ্তর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। বরিশাল পুলিশ লাইন্স থেকে সংগৃহীত অস্ত্র (১টি বেটাগান, ১টি ৩/৮ রিভালবর, ১ ব্যাগ গুলি ও ২টি গ্রেনেড) নিয়ে খান আলতাফ হোসেন ভুলু এবং এডভোকেট হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ বাকেরগঞ্জে এসে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেন। ইতোমধ্যে ১৪টি ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন এবং দেশীয় বন্দুক ও বাঁশের লাঠি দিয়ে নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি কমিটির সদস্যরা হলেন (ইউনিয়ন ভিত্তিক)— খান আলতাফ হোসেন ভুলু (দুধল), শওকত হোসেন সন্নামত (ফরিদপুর), ইউসুফ হাওলাদার (নেয়ামতি), বাবু মিয়া ওরফে বকর মাস্টার (দাড়িয়াল), আলাউদ্দিন মাস্টার (পাদ্রী শিবপুর), লাল মাহমুদ মজুমদার (চরামুদ্দি), আবেদ মোল্লা (রঙ্গশ্রী), লরেন্স সুশীল সরকার (পাদ্রী শিবপুর), মানিক হোসেন মোল্লা (ভরপাশা), আলতাফ উদ্দীন খান (গারুড়ীয়া), মজিবর তালুকদার (দুর্গাপাশা), জমিদার নাটু দাস (রঙ্গশ্রী), ঝন্টু দাস (কালিগঞ্জ), রফিকুল ইসলাম বাদশা (দুর্গাপাশা), সাহাবুদ্দিন আহমেদ সাবু (নলুয়া), ইউনুস মল্লিক (চরাদি), রাজ্জাক তালুকদার (কলসকাঠি) ও আলী হোসেন তালুকদার সোনা (কবাই)। কমিটির সদস্যরা প্রতিটি ইউনিয়নের বাজার ও স্কুল মাঠে মানুষ জড়ো করে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো ওয়ারলেস বার্তাটি প্রচার করতে থাকেন। খান আলতাফ হোসেন ভুলু, বাবু মিয়া, লাল মাহমুদ মজুমদার, ক্যাপ্টেন নাসির, বজলুর রহমান (সামরিক বাহিনী) ও শহীদুল ইসলাম মিরন গ্রাম থেকে সিভিল গান সংগ্রহ করে গোমা কৃষ্ণকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১২ই মে একটি সভা করেন। পরবর্তীতে জুনের মাঝামাঝি সময় সর্বদলীয়ভাবে মজিবর রহমান তালুকদারের সভাপতিত্বে দুধলের ডি কে পি স্কুলে মিটিং করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সুবোধ ঘোষাল, আলতাফ হোসেন অরুণ, আলতাফ হোসেন ভুলু, নওশের জাহান, শাহজাহান জমাদার, দিলীপ চক্রবর্তী, রামচন্দ্র, আক্কেল আহমেদ, রাজ্জাক মেম্বর, গিয়াস মোল্লা, এনায়েত সিকদার, সত্তার মাস্টার, আবেদ মোল্লা, শহীদুল ইসলাম মিরন, কমল ব্যানার্জী, রফিকুল ইসলাম জাফর, আবদুল কাদের হাওলাদার, শাহজাহান মুন্সি প্রমুখ। সভায় সিদ্ধান্ত হয়-
গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে সামরিক, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা;
গাছ কেটে রাস্তা বন্ধ করে ব্রিজ ও কালভার্ট ভেঙ্গে দিয়ে স্থলপথে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করা এবং নৌপথে প্রবেশের জায়গায় অবস্থান নিয়ে গানবোট লক্ষ করে গুলি ছোড়া এবং মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করা।
জুন মাসে মোজাম্মেল হোসেন সিকদার এমপিএ, ছাত্রনেতা খান আলতাফ হোসেন ভুলু, শওকত হোসেন সন্নামত ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ-, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন- কর্মীদের নিয়ে খয়রাবাদ হাইস্কুলে অনুষ্ঠিত এক সভায় পাদ্রী শিবপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে আবদুস সালাম মাসুমের নেতৃত্বে মাহাবুব, খসরু, চন্দ্রশেখর, কালিগঞ্জের মুহিব্বরসহ ১৫ জন যুবক সেন্ট আলফ্রেড স্কুলে উপস্থিত হয়ে ৩ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী যথা- মোহসীন উল ইসলাম হাবুল, ফরিদ খা ও কবির শরীফসহ মোট ১৮ জন মিলে পাদ্রী শিবপুর দাতব্য চিকিৎসালয়ের পাশে ব্রিজ পার হয়ে শ্রীমন্ত নদীর অপর পাড়ে সমিতির ঘরে ক্যাম্প স্থাপন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স থেকে অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে আসা একজন পুলিশ এবং একজন সেনাসদস্য তাঁদের অস্ত্র নিয়ে এখানে যোগ দেন। ক্যাম্পে শতাধিক প্রশিক্ষণার্থী ছিল। স্থানীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের সহযোগিতা করে। এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা পাদ্রী শিবপুর, নেয়ামতি, ভরপাশা ও রঙ্গশ্রী অঞ্চলে শক্তিশালী বাহিনী তৈরি করেন। এ ক্যাম্পে সব সময় মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা থাকত। বাকেরগঞ্জ থানা আক্রমণের জন্য সমিতির ক্যাম্পে মহসিন উল ইসলাম হাবুল, শেখরসহ কয়েকজন মিলে ককটেল, বোমা ও নানা ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য প্রস্তুত করেন। পরবর্তীতে থানা আক্রমণে এসব বোমা ও মলোটভ ককটেল ব্যবহার করা হয়। বাকেরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মানিক লাল চক্রবর্তী ও সাধারণ সম্পাদক আলাল গাজীর নেতৃত্বে ছুটিতে আসা সেনা, ইপিআর ও পুলিশ সদস্যদের নিয়ে গারুড়ীয়া হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
৬নং ফরিদপুর ইউনিয়নের কাকরধা হাইস্কুলে রফিকুল ইসলাম জাফর, সুবেদার মেজর মোসলেম উদ্দীন হাওলাদার, হাবিলদার আবদুল কাদের, মজিবর রহমান, মনু তালুকদার, ফ্লাইট সার্জেন্ট শামসুল হক চৌধুরী, নেভি অফিসার আউয়াল, সুবেদার আবদুর রউফ ও আবদুল কাদের শতাধিক সদস্য নিয়ে জুন মাসের প্রথম দিকে একটি ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন সুবেদার মোসলেম মিয়া। পরবর্তীতে দাড়িয়াল ইউনিয়নের দক্ষিণ কাজলাকাঠীর উকিল বাড়িতে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প করা হয়। স্থানীয় শাহজাহান মাতুব্বর, আলী আকবর উকিল এবং মতিউর রহমান মাস্টারসহ আরো অনেকে এ ক্যাম্পে যোগ দেন। এক সপ্তাহ পর কামারখালী হাইস্কুলে স্থানীয় মোক্তার হাওলাদার, আবদুর রাজ্জাক, ছাত্রলীগের আবদুর রশীদ হাওলাদার, বিমল দত্ত, মতি মাস্টারসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। সংগঠকগণ এখান থেকে আজিমপুর গিয়ে এলাকার লোকদের সংগঠিত করে চারদিন ধরে সকলকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে এবং যে-কোনো সময় শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এরপর জুনের মাঝামাঝি ১নং চরামুদ্দি ইউনিয়নের বাদলপাড়া গাজী বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। তাঁরা এখানে তিনদিন অবস্থান করে চরাদি ইউনিয়নের বলইকাঠী গ্রামের আতাহার আলী হাওলাদারের বাড়ির (বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুল আলম চুন্নুর বাড়ি) কাচারিতে অস্থায়ী ক্যাম্প করেন। সাত সপ্তাহ ধরে অবস্থান করে দলটি গারুড়ীয়া ইউনিয়নের গাভীখালা গ্রামে আফসার হাওলাদারের বাড়িতে অপর একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর তাঁরা কলসকাঠীর বাগদিয়া স্কুলে ক্যাম্প করেন। খান আলতাফ হোসেন ভুলু ও বাবু মিয়ার নেতৃত্বে চরাদি বোর্ড স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। তাঁরা নেয়ামতি ইউনিয়নের মহেশপুরেও ক্যাম্প স্থাপন করেন। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের এ গ্রুপটি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করে।
পাদ্রি শীবপুরের খ্রিস্টান চার্চের ফাদার জার্মান এর ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন করতে দেন। ফাদার জার্মান বিদেশ থেকে সাহায্য এনে মুক্তিযোদ্ধাদের জনপ্রতি ১০০/২৫০ টাকা ভাতা প্রদান করেন। তিনি বিবিসিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের এনে জনসভা করে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত পাদ্রী শিবপুর গীর্জা ছিল বাকেরগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি। ৯নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর এখানে এসে অবস্থান নিতেন।
রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের জমিদার নাটু বাবু, ঝন্টু দাস, আবেদ মোল্লা, সত্তার মাস্টার ও সেনাসদস্য সত্তার হাওলাদার শ্যামপুর হাইস্কুলে বাকেরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলীয় সবচেয়ে বড় ক্যাম্প স্থাপন করেন। হাবিলদার দলিল উদ্দীন আহমেদ (~আগরতলা মামলার ৯নং আসামি) অস্ত্র নিয়ে শ্যামপুর ক্যাম্পে আসেন। অপরদিকে সত্তার হাওলাদার ক্যান্টনমেন্ট থেকে অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে এলে ক্যাপ্টেন নাসিরের নেতৃত্বে তাঁরা এ ক্যাম্পটিকে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন। এখানকার বাহিনীতে ছিলেন আবদুল করিম ভূঁইয়া, আশ্রাব আলী,মজিবর রহমান চাঁন খা, মনসুর আলী, আজিজ মোল্লা, সাহেব আলী গাজী, আলতাফ হোসেন, নজরুল বিশ্বাস, দলিল উদ্দীন, বাদশা খান, মো. হায়দার, সুলতান হাওলাদার, মোস্তফাসহ আরো অনেকে। তাঁরা বাঁশের লাঠি এবং দেশীয় অস্ত্র দিয়ে শ্যামপুর স্কুল মাঠে সকাল-বিকাল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য শতাধিক জনকে প্রস্তুত করা হয়। সকল প্রশিক্ষণার্থীর খাবার সরবরাহ করেন জমিদার নাটু দাস।
উপজেলার অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত সংগ্রাম কমিটির খান আলতাফ হোসেন ভুলু, শওকত সন্নামত, লাল মাহমুদ, গিয়াস মোল্লা, এনায়েত সিং, সত্তার মাস্টার, আবেদ মোল্লা, সেকেন্দার গাজী, আলাল গাজী, ইউসুফ হাওলাদার ও ফকরুদ্দিন ডাকুয়ার ওপর। এঁরা উপজেলার সকল ইউনিয়নে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন। নভেম্বরের শেষদিকে সিরাজ খানের বাহিনী ভারতে বিএলএফ প্রশিক্ষণ নিয়ে দুর্গাপাশার জিরাইলে ক্যাম্প স্থাপন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাকেরগঞ্জে দুটি স্থানীয় বাহিনী সক্রিয় ছিল। জুন মাসের শেষে ছাত্রলীগ নেতা খান আলতাফ হোসেন ভুলু এবং বাবু মিয়ার সহায়তায় সেনা, নৌ ও ইপিআর বাহিনীর পালিয়ে আসা সদস্য ও অন্যদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন নাসির উদ্দিন এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন বজলুর রহমান খান। এর সদস্য ছিল ৪৫০-৫০০ জনের মতো। এ বাহিনী ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থিত। অপরটি বামপন্থী আদর্শের অনুসারী মো. রফিকুল ইসলাম জাফর, মজিবর তালুকদার, নওশের জাহান, কাদের হাওলাদার, সুবোধ ঘোষাল, কমল ব্যানার্জী, রাজ্জাক তালুকদার মনু, সুবেদার মোসলেমসহ আরো কয়েকজন সদস্য নিয়ে গঠিত, যা জাফর বাহিনী নামে পরিচিত। মো. রফিকুল ইসলাম জাফর (পিতা ইসমাইল সিকদার, নীলগঞ্জ, গারুড়িয়া) মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলনা বি এল কলেজের ছাত্র এবং বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বরিশাল বি এম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। সিরাজ সিকদারের রাজনীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রথমে আবদুস সালাম মাসুমের নেতৃত্বে মাসুম বাহিনী গঠিত হয়। মাসুম বাহিনী পাদ্রী শিবপুরে অবস্থান করত। অক্টোবর মাসে অন্তঃকলহের কারণে মাসুম ও শেখর নামে অপর একজন নিহত হলে দলের অন্য সদস্যরা জাফর বাহিনীতে যোগ দেয়। ভারতে বিএলএফ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিরাজ খানের নেতৃত্বে সিরাজ বাহিনী নামে অপর একটি বাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনী দুর্গাপাশার জিরাইলে অবস্থান নেয়।
বাকেরগঞ্জ উপজেলার চারদিক নদীবেষ্টিত এবং নদী দ্বারা সকল ইউনিয়ন বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে সব ইউনিয়নেই মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করেন। যেসব স্থান দিয়ে নদী ও স্থল পথে বাকেরগঞ্জে প্রবেশ করা যায়, সে-সকল স্থানে, নদীর মুখে, রাস্তার পাশে বাংকার করে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুকে প্রতিহত করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তাঁরা বরিশাল সদর থেকে বাকেরগঞ্জ আসার সড়ক পথে বড়বড় গাছ কেটে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
২৯শে এপ্রিল বাকেরগঞ্জের দাড়িয়াল ইউনিয়নের বারজীবী পাড়ায় (বাড়ৈ নগর) পাকবাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ করে। বজলুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা চরাদি ইউনিয়নের রানীরহাটে তাদের প্রতিরোধ করেন। বরিশাল থেকে পাকিস্তানি বাহিনী গানবোটে বাকেরগঞ্জের দিকে প্রবেশ করতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি তাদের প্রতি গুলি ছুড়তে থাকে। প্রবেশপথে বাঁধা পেয়ে হানাদার বাহিনী বরিশাল ফিরে যায়।
দাড়িয়াল ইউনিয়নে বাবু মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য অগ্রসর হলেও ভারী অস্ত্রের মুখে তাঁরা পিছু হটেন। খয়রাবাদ, গারুড়িয়া ও কলসকাঠীতে পাকিস্তানি বাহিনী -রাজাকারদের সহযোগিতায় গোপনে এসে অতর্কিতে আক্রমণ করে। তারা গানবোটের মেশিন বন্ধ করে নিঃশব্দে কাছাকাছি এসে আক্রমণ করলে বাকেরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মানিক লাল চক্রবর্তী তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে শহীদ হন। ১৭ই নভেম্বর নাসির বাহিনীর নেতৃত্বে খান আলতাফ হোসেন ভুলু, গিয়াস মোল্লা, এনায়েত সিং, সত্তার মাস্টার, আবেদ মোল্লা, সেকান্দার গাজী, ইউসুফ হাওলাদার, আজিজ মোল্লা, সাহেব আলী গাজী, আবদুল করিম ভূঁইয়া, বাদশা খানসহ প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের শ্যামপুরে পাকবাহিনীর প্রবেশমুখে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন।
বাকেরগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ নবম সেক্টরের অধীনে পরিচালিত হয়। এ অঞ্চলের সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর। পরবর্তী সময়ে বরিশাল জেলার প্রত্যেক থানায় একজন করে, কোথাও একাধিক বেইজ কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। বাকেরগঞ্জে বেইজ কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ নাসির উদ্দীন (পিতা খাদেম আলী হাওলাদার, চরামদ্দি)। এছাড়া আবদুল মান্নান এমএনএ, মোজাম্মেল সিকদার এমপিএ, আওয়ামী লীগ সভাপতি মানিক লাল চক্রবর্তী, শওকত সন্নামত, ইউসুফ হাওলাদার, বাবু মিয়া, আলাউদ্দিন মাস্টার, গিয়াস মোল্লা, আলতাফ উদ্দিন খান, আবদুর রাজ্জাক মনু তালুকদার, ফকরুদ্দীন ডাকুয়া, সাত্তার মাস্টার, খান আলতাফ হোসেন ভুলু, মানিক হোসেন মোল্লা, মজিবর তালুকদার, সিরাজ খান প্রমুখ এখানকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী বাকেরগঞ্জ উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। থানায় ক্যাম্প স্থাপন করলেও তারা স্থায়ীভাবে থাকত না; এখানে তাদের দোসর রাজাকার ও পুলিশ বাহিনী অবস্থান করত। থানার দারোগা আবদুল মালেক পাকবাহিনীর দোসর ছিল। পাকবাহিনী বরিশাল থেকে গানবোট যোগে থানায় এসে বিভিন্ন ইউনিয়নে হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন করে বরিশালে ফিরে যেত। বাকেরগঞ্জে পাকবাহিনীর নেতৃত্ব দেয় পাকিস্তানি সেনাসদস্য ক্যাপ্টেন হামিদ।
পাকিস্তানি বাহিনী বাকেরগঞ্জ থানায় অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের পর তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। পাকবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য তাদের দোসরদের সহায়তায় গরিব লোকদের লোভ দেখিয়ে, চাকরির কথা বলে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস – বাহিনীতে যোগ দেওয়ায়।
বাকেরগঞ্জ থানার কনভেনশন মুসলিম লীগ দলীয় এমএনএ মজিবর মোল্লার (খয়রাবাদ) নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। তার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ-এর সদস্য ও সমর্থক এবং বিভিন্ন ইউনিয়ন কাউন্সিল মেম্বররা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করে। শান্তি কমিটির অন্য সদস্যরা হলো- হাফেজ খোরশেদ আলম (দেওকাঠী, রঙ্গশ্রী), তার পুত্র কালাম, নওরোজ মিয়া (পাদ্রী শিবপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান), হাশেম চেয়ারম্যান (রঙ্গশ্রী), নুর হোসেন (চরাদি), অধ্যাপক এসহাক (কলসকাঠী), বারেক মোল্লা (কলসকাঠী), সাদের হাওলাদার (চেয়ারম্যান, দুধল) প্রমুখ। হাফেজ খোরশেদ আলম মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য হানাদার বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিত এবং তার পুত্র কালাম সব সময় থানায় অবস্থান করত। এরা বাকেরগঞ্জে শান্তি কমিটির সংগঠক এবং সক্রিয় সদস্য হিসেবে এখানকার সকল গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। এরা পাকবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত। এভাবে পাকিস্তানি বাহিনী বাকেরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা, নির্যাতন ও লুণ্ঠন চালায়।
শান্তি কমিটির সহায়তায় বাকেরগঞ্জে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। এলাকার কুখ্যাত রাজাকাররা হলো- আবদুর রহমান ফরাজী (দুধল ও ভরপাশা ইউনিয়নের রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার), পাদ্রী শিবপুরের শাহু রাজাকার, তার ভাই কুট্টি, রঙ্গশ্রীর গণি মৃধা, নন্দপাড়ার হাশেম খা, মন্নান হাওলাদার প্রমুখ। রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের বক্স বাড়ির সকলেই রাজাকার ছিল। থানার দারোগা আবদুল মালেকের ছত্রছায়ায় বাকেরগঞ্জের রাজাকার এবং শান্তি কমিটির অনেক সদস্য থানায় অবস্থান করত এবং উপজেলায় পাকবাহিনীর গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ নানা কর্মকাণ্ডে সহায়তা করত। তারা যুদ্ধের চেয়ে বাকেরগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নে ব্যক্তিগত শত্রু খতম ও লুটতরাজে অধিক উৎসাহী হয়ে ওঠে। এছাড়া তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও দোকানপাট লুট, নারীধর্ষণ এসব কাজে লিপ্ত ছিল। বাকেরগঞ্জ থানা সব সময় রাজাকাররা পাহারা দিত। দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র উপজেলা বাকেরগঞ্জকে রাজাকারদের দখল থেকে মুক্ত করতে সাব-সেক্টর কমান্ডার শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনদিন যুদ্ধ করতে হয়েছে।
পাকিস্তানি বাহিনী ২৫শে এপ্রিল বরিশাল শহরে অনুপ্রবেশ করেই দক্ষিণাঞ্চলে গণহত্যা ও নির্যাতনের সূচনা করে। তারা ২৯শে এপ্রিল বরিশাল থেকে গানবোটে বাকেরগঞ্জ উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম বারজীবী পাড়ায় প্রবেশ করে অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও গণহত্যা চালায়। দাড়িয়াল গণহত্যায় অনেক সাধারণ মানুষ নিহত হয়। এ গণহত্যায় তাদের হাতে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ এবং মানসিক প্রতিবন্ধীও রক্ষা পায়নি।
১৪ই মে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ক্যাপ্টেন হামিদের নেতৃত্বে এবং স্থানীয় রাজাকার বারেক মোল্লা ও ইসহাক হাওলাদারের সহায়তায় কলসকাঠী জমিদার বাড়ি এবং আশপাশে গণহত্যা চালায়। কলসকাঠী গণহত্যায় কলসকাঠী বি এম একাডেমির ১১ জন মেধাবী ছাত্রসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক মানুষ শহীদ হন। বিভিন্ন অঞ্চলের হিন্দুরা এসে জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নেয়ায় সকল শহীদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। এ গণহত্যায় ৪২ জন শহীদের পরিচয় জানা গেছে।
একই দিন পাকবাহিনী গারুড়ীয়া ইউনিয়নের তুলাতলী নদীর পাড়ে হেলেঞ্চা নামক স্থানে নৃশংস গণহত্যা চালায়। হেলেঞ্চা গণহত্যায় ৩০ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। হত্যার পর তারা শহীদদের মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী ১৪ই মে গারুড়ীয়া বাজারে রাজাকারদের সহযোগিতায় প্রবেশ করে বাজারে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। পাকবাহিনীর আক্রমণে অধিকাংশ লোক নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেও অতিশয় বৃদ্ধ গারুড়ীয়ার মতিলাল গাঙ্গুলী (৭০), শরৎ চন্দ্র চক্রবর্তী (৬৫) ও বৃদ্ধানন্দ হালদার (৭০) হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
শান্তি কমিটির সভাপতি মজিবর রহমান মোল্লার নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী মে মাসের শেষে খয়রাবাদ গ্রাম আক্রমণ করে হত্যাকাণ্ড চালায়। এতে বাকেরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনিক লাল চক্রবর্তী এবং তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়া বি এম কলেজের মেধাবী ছাত্র সাগর ও লতিফ শহীদ হন।
বাকেরগঞ্জ সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরবর্তী নন্দপাড়া গ্রামে জুন মাসের শেষের দিকে স্থানীয় রাজাকার আবুল হাসেম ও আবদুল মান্নানের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে। এ-সময় তাদের হাতে পাদ্রী শিবপুর হাইস্কুলের শিক্ষক রাধেশ্যাম বিএসসি এবং ফটিক শহীদ হন।
২৭শে আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনী বরিশাল থেকে গানবোটে বাকেরগঞ্জ বাজারে আসে এবং বাজারে প্রবেশ করেই তারা লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ করে। আতঙ্কে বাজারের লোকজন জীবন রক্ষার্থে পালানোর জন্য ছুটোছুটি করতে থাকে। তখন পাকিস্তানিরা এলোপাতাড়ি গুলি করে। এ-সময় বাকেরগঞ্জ বাজারের কৃষ্ণকান্ত সাহা, রাখাল দেবনাথ এবং পাদ্রী শিবপুরের রাধিকা মোহন দেবনাথ শহীদ হন।
পাকবাহিনী স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা হাশেম চেয়ারম্যান এবং রাজাকারদের সহযোগিতায় ১৬ই নভেম্বর রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের দাওকাঠী গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে এবং হত্যাকাণ্ড চালায়। এ-সময় দাওকাঠী গ্রামের বাদশা খান (পিতা আফতাবউদ্দিন খান), হায়দার মীর (পিতা বন্দে আলী মীর ও এলেম উদ্দিন (পিতা সফের উদ্দিন) পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। একই দিন পাকবাহিনী রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামে জমিদার নাটু বাবুর বাড়ির সামনে শ্যামপুর স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থাকায় রাজাকার আবুল হাসেম হাওলাদারের দেখানো পথে শ্যামপুর বাজারে প্রবেশ করে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও গণহত্যা চালায়। শ্যামপুর গণহত্যায় ৩৫ জন মানুষ শহীদ হন, যাদের মধ্যে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৯ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে।
পাকিস্তানি বাহিনীর বাকেরগঞ্জ থানা ক্যাম্প ছিল তাদের নির্যাতনকেন্দ্র। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল মালেকের নেতৃত্বে পুলিশ ও রাজাকার বাহিনী বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন করে।
কলসকাঠী চাউলা পট্টির ঘাটলা বধ্যভূমি – বাকেরগঞ্জ উপজেলার বৃহৎ বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। এখানে শতাধিক মানুষকে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। তুলাতলী নদীর পাড়ে হেলেঞ্চা ব্রিক ফিল্ড বধ্যভূমি হিসেবে পরিচত। বেবাজ, ডিঙ্গারহাট ও হেলেঞ্চা থেকে মানুষ ধরে এনে গুলি করে ও বেয়নেট চার্জ করে এ বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামে জমিদার নাটু বাবুর বাড়ির পাশে শ্যামপুর বধ্যভূমি অবস্থিত। এখানে রাজাকারদের সহযোগিতায় রঙ্গশ্রী, দাওকাঠী, কালিগঞ্জ ও শ্যামপুরের লোকজন হত্যা করা হয়।
বাকেরগঞ্জে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে শ্যামপুর যুদ্ধ – এবং বাকেরগঞ্জ থানা আক্রমণ- উল্লেখযোগ্য। ১৭ই নভেম্বর শ্যামপুর যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে টমাস আশীষ বেপারী সহ ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৪ঠা ডিসেম্বর রাতে বাকেরগঞ্জের নাসির বাহিনী ও জাফর বাহিনীর সদস্যরা এবং সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর পাদ্রী শিবপুরে অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন ওমরের নির্দেশ অনুযায়ী বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিজাম বাহিনী (গৌরনদী), ওহাব খান বাহিনী (বাবুগঞ্জ), কুদ্দুস মোল্লা বাহিনী (মুলাদী), রতন শরীফ বাহিনী (বাবুগঞ্জ) ও ওয়াদুদ বাহিনী (উজিরপুর)-র সদস্যরা পাদ্রী শিবপুর স্কুল মাঠে অবস্থান নেয়। ৫ই ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা বাকেরগঞ্জকে হানাদারমুক্ত করার দুর্জয় সংকল্প নিয়ে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা থানা আক্রমণ করেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কুখ্যাত আবদুল মালেকের (টেডা মালেক হিসেবে পরিচিত) নেতৃত্বে মিলিশিয়া ও রাজাকাররা ভারী অস্ত্র ও কামানসহ ছাদের ওপর বাংকার তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ করে। তিনদিন পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলতে থাকে। ৭ই ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধারা ওসির বাসার বাংকার লক্ষ করে আক্রমণ করেন। এতে দারোগা মালেকসহ তার দোসরা দুর্বল হয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা থানার মধ্যে প্রবেশ করলে পুলিশ ও রাজাকার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বাকেরগঞ্জ থানা আক্রমণের যুদ্ধে মীর মোস্তাক হোসেন সেন্টু, গৌরনদীর শাহজাহানসহ ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বাকেরগঞ্জের শতশত নিরীহ মানুষকে পাকবাহিনী হত্যা করার অপরাধে দারোগা মালেক ও শাহু রাজাকারকে জল্লাদ গৌরঙ্গ কালিগঞ্জ ব্রিজের ওপর জবাই করে শ্রীমন্ত নদীতে ভাসিয়ে দেয়। ৭ই ডিসেম্বর বাকেরগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- সুবেদার ফজলুর রহমান খন্দকার, বীর উত্তম- (পিতা খন্দকার আবুল হোসেন, বার আউলিয়া), আতাহার আলী মল্লিক, বীর বিক্রম (পিতা কাঞ্চন আলী মল্লিক, চরাদি), মো. কামরুল হাসান সেলিম, বীর প্রতীক (পিতা ডা. মোতাহার সিকদার, চরাদি), গাজী আব্দুল ওয়াহিদ, বীর প্রতীক (পিতা আসমত আলী গাজী, মঙ্গলসি), ইপিআর হাবিলদার আব্দুল হামিদ খান, বীর প্রতীক (পিতা আরফিন খান, দক্ষিণ কবাই), সুবেদার করম আলী হাওলাদার, বীর প্রতীক – (পিতা গোলাম আলী হাওলাদার, বড়পাশা), নায়েক সুবাদার আবদুল লতিফ, বীর প্রতীক (পিতা তোলফে আলী মজুমদার, জিরাইল, দুর্গাপাশা), ইপিআর নায়েক দেলোয়ার হোসেন, বীর প্রতীক (পিতা আমীর হোসেন খন্দকার, কাজলাকাঠী), ইপিআর সদস্য আয়েজ উদ্দীন আহমেদ, বীর প্রতীক (কৃষ্ণকাঠী), রফিকুল আহসান, বীর প্রতীক (পিতা আসমত আলী, দুর্গাপাশা)। বাকেরগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আতাহার আলী মল্লিক, বীর বিক্রম (২রা এপ্রিল তিস্তা ব্রিজ যুদ্ধে শহীদ), লেফটেন্যান্ট মোহাম্মাদ কামরুল ইসলাম সেলিম, বীর প্রতীক (পিতা ডাক্তার মোতাহার সিকদার, চরাদি), শহীদুল ইসলাম খোকন (পিতা কে এল রহমান, বাকেরগঞ্জ), আবদুল কাদের আকন্দ (পিতা আবদুল গফুর আকন্দ, পাদ্রী শিবপুর), সৈয়দ আলতাফ হোসেন (পিতা সৈয়দ সেকান্দার আলী, ফলাঘর, কালিগঞ্জ), আবদুল হালিম (পিতা আবদুল করিম জমাদার, ফলাঘর, কালিগঞ্জ), আবদুর রহমান মজুমদার (পিতা সেরাজউদ্দিন মজুমদার, জিরাইল), আবদুর রশিদ (দাড়িয়াল), সেনাসদস্য জেন্নাত আলী সিকদার (পিতা রইস উদ্দীন সিকদার, শ্যামপুর, রঙ্গশ্রী), মো. মোতালেব (দাড়িয়াল), শাহজাহান (ফরিদপুর), মো. সেন্টু (দাড়িয়াল), ইপিআর সদস্য মনসুর আলী (হানুয়া), সেনাসদস্য ইউনুস আলী সিকদার (শ্যামপুর, রঙ্গশ্রী), সেনাসদস্য আবদুর রহমান, আকরাম আলী খান (দুধল), আবদুল খালেক খান (রঘুনাথপুর), সনাতন ঘটক (চাচৈরপাশা), ধীরেন চন্দ্র (লক্ষ্মীপাশা), লক্ষ্মীচরণ শীল (কাফিলা), সোহরাব হোসেন (উত্তর লোচনাবাদ), রাসবিহারী দাস (সাহেবগঞ্জ), নারায়ণ চন্দ্র মণ্ডল (চরামদ্দি), শাহজাহান আলী আকন (রাতাসপুর) ও হরকুমার ধোপা (খয়রাবাদ)।
বাকেরগঞ্জ উপজেলায় শহীদদের স্মরণে কলসকাঠী ইউনিয়নের জমিদার রাজ্যেশ্বর রায় চৌধুরীর বাড়ির সম্মুখে শহীদদের নাম সম্বলিত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। কলসকাঠী ইউনিয়নের বি এম একাডেমির বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র (এসএসসি পরীক্ষার্থী) শহীদ অমৃত হালদারের নামে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শহীদ অমৃত স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্যামপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধা (অব. এসপি) মতিউর রহমানের নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মতিউর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। [লুলু আল মারজান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!