বাউশগাড়ি-রূপশি গণহত্যা (সাঁথিয়া, পাবনা)
বাউশগাড়ি-রূপশি গণহত্যা (সাঁথিয়া, পাবনা) সংঘটিত হয় ১৪ই মে। এতে প্রায় ৬০০ নিরীহ মানুষ শহীদ হন। দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বড়াল নদীর তীরবর্তী বাউশগাড়ি, রূপশি এবং পার্শ্ববর্তী ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা গ্রামকে নিরাপদ মনে করে বিভিন্ন এলাকার হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের বহু মানুষ এখানে আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন ব্যবসায়ী এবং অবস্থাসম্পন্ন মানুষ। মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী-র লোকেরা পাকসেনাদের কাছে এ খবর পৌঁছে দেয়। তাদের মধ্যে একজন ছিল বেড়া বাজারের আসাদ আলী দর্জি (দেশ স্বাধীনের পর ক্ষুব্ধ জনতা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে)।
ঘটনার দিন পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা তিনটি গ্রামের ওপর হামলা চালায়। তারা হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ ও নারীধর্ষণের মতো পৈশাচিক অপকর্মে মেতে ওঠে। গ্রামবাসী যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, তখন রাত ৪টার দিকে দুশতাধিক পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসররা তিনটি গ্রাম ঘিরে ফেলে নির্বিচারে গুলি চালায়। ঘুমন্ত গ্রামবাসীরা গুলির আওয়াজে জেগে উঠে দিশেহারার মতো চতুর্দিকে ছুটতে থাকে। হানাদাররা গ্রাম তিনটির প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিলে অসহায় মানুষগুলো ফসলের জমি ও জঙ্গলে লুকিয়ে জীবন রক্ষার চেষ্টা করে। বাউশগাড়ি গ্রামের পশ্চিম দিকের বিশাল বাঁশঝাড়ের কয়েকটি গর্তের মধ্যে জীবন রক্ষার্থে লুকিয়ে ছিল প্রায় চার- পাঁচশ মানুষ। পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের লক্ষ করে ব্রাশ ফায়ার করে। এদিন প্রায় ৬০০ মানুষ নিহত হয়। তাদের মধ্যে যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন- ইউসুফ প্রামাণিক (পিতা হারান প্রামাণিক, নাগডেমরা, সাঁথিয়া), নীলমণি পাল (পিতা নিবারণ পাল, ভাঙ্গাদহ, সাঁথিয়া), শশিভূষণ কর্মকার (পিতা বিহারী কর্মকার, ডেমরা, ফরিদপুর, পাবনা), দেবেন্দ্রনাথ পাল (পিতা নিতাই চন্দ্র পাল, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ), মণীন্দ্রনাথ কর্মকার (পিতা তাপস কর্মকার, বেড়া, পাবনা), কছিম উদ্দিন খাঁ (পিতা কানু খাঁ, রূপশি, সাঁথিয়া), কালাচাঁদ চক্রবর্তী (পিতা ফণীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রূপশি, সাঁথিয়া), কালু খান, কোরবান প্রামাণিক, কোরবান আলী, জাফর প্রামাণিক, মঞ্জু রায়, নিরেন্দ্রনাথ মালী, বরুণ দাস, ঠাকুর দাস, নীলমণি তলাপাত্র, অমলেন্দ্র নাথ রায়, প্রবোধ কুমার মজুমদার, বিমল চন্দ্র রায়, নির্মল রায়, নারায়ণ রায়, প্রদীপ হালদার, জ্ঞানেন্দ্রনাথ হালদার, যতীন্দ্রনাথ হালদার, তাফাল কুণ্ডু, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, সতত চন্দ্র ঘোষ, ফকিরচাঁদ ঘোষ, বৃন্দাবন সূত্রধর, সতীন্দ্রনাথ বড়কে, অনিল লাল, রবীন্দ্রনাথ শীল, গণেশ শীল, বুলু প্রামাণিক, লালবিহারী পাল, ধীরেন্দ্রনাথ পাল, যামিনী মোহন পাল, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ, মংলা কুণ্ডু, আজিমুদ্দিন ওরফে আজু পাগল, আহেজ ফকির, হোসেন আলী, জাবেদ ফকির, ইবাদ ফকির, অফির ফকির, ওফাজ আলী খান, জামাল উদ্দীন, আজাহার আলী, আজগর আলী, ইসমাইল হোসেন, নারু পাল, আজরা আটনি, নিমাই পাটনি, অধির কুণ্ডু পাগল, মোকছেদ আলী, আবদুল জব্বার, আবুল হোসেন, যীতেন রায়, নীরন দাস, মঞ্জু মোল্লা, হোসেন মোল্লা, হীরালাল দাস, কুসুম উদ্দিন, কোরবান আলী, আবদুল জলিল, খরিব প্রামাণিক, খোরশেদ প্রামাণিক, আবেদ আলী, অমলেন্দ্র নাথ রায়, নীমেল চন্দ্র নাথরায়, মঞ্জু ফকির, হারুনার রশিদ, শুটকা সরদার, অনীলচন্দ্র সরদার, সতীশ শীল, সুধীলাল ঘোষ, বৈদ্যনাথ দাস, দেবেন্দ্রনাথ পাল, ছবি রানী পাল, মণীন্দ্রনাথ কর্মকার, জগদীশ কুণ্ডু (পিতা যোগেন কুণ্ডু, ডেমরা, ফরিদপুর, পাবনা), নেপাল কুণ্ডু (ঐ), ঋষিকেশ কুণ্ডু (পিতা যোগেশ কুণ্ডু, ঐ), গোরা দাশ (পিতা নারায়ণ দাশ, ঐ), নিমাই দাশ (ঐ), ফটিক ঘোষ (পিতা অভয় ঘোষ, ঐ), গোবিন্দ ঘোষ (পিতা অনীল ঘোষ, ঐ), খোরশেদ আলী প্রামাণিক (পিতা জমির উদ্দিন প্রামাণিক, ঐ), খবির উদ্দিন প্রামাণিক (ঐ), ইউসুফ আলী (পিতা হারান প্রামাণিক, ঐ), আলম সেখ (পিতা মহিন সেখ, ঐ), মলম সেখ (পিতা মহিন সেখ, ঐ), মহিন সেখ (পিতা পচা সেখ, ঐ), যদু মোল্লা (পিতা গাতু মোল্লা, ঐ), হোসেন মোল্লা (পিতা যদু মোল্লা, ঐ), কানু খাঁ (পিতা নূরু খাঁ, ঐ), কসিম উদ্দিন খাঁ (পিতা কানু খাঁ, ঐ), মঞ্জু খান (পিতা সিরাজ খান, ঐ), ধীরেন সূত্রধর (পিতা সুরেন্দ্রনাথ সূত্রধর, ঐ), তপন সূত্রধর (পিতা বীরেন সূত্রধর, ঐ), জীবেন্দ্রনাথ রায় (পিতা বৈকুণ্ঠ রায়, ঐ), নীরেন্দ্র নাথ দাশ (পিতা শিবনাথ দাশ, ঐ), হীরালাল দাস (পিতা সুরেন্দ্রনাথ দাস, ঐ), বরুণ দাস (পিতা হীরালাল দাস, ঐ), বাদল ঘোষ (পিতা মণীন্দ্রনাথ ঘোষ, ঐ), রবীন্দ্রনাথ ঘোষ (পিতা বিশ্বনাথ ঘোষ, ঐ), মণীন্দ্রনাথ হালদার (পিতা যোগী হালদার, ঐ), লক্ষ্মী হালদার (পিতা মাখন হালদার, ঐ), কালীপদ হালদার (ঐ), বীরেন ঘোষ (পিতা অভয় ঘোষ, ঐ), স্বপন তাম্বলী (পিতা জিতেন্দ্র তাম্বলী, ঐ), তিনকড়ি পাল (পিতা রসিক পাল, ঐ), বনলতা পাল (স্বামী তিনকড়ি পাল, ঐ), দুলাল কর্মকার (পিতা হারান কর্মকার, ঐ), মতিলাল কর্মকার (পিতা বিজয় কর্মকার, ঐ), ভাদু কর্মকার (পিতা হারান কর্মকার, ঐ), মন্টু লাল শীল (পিতা মণি শীল, ঐ), বাসনা ঘোষ (পিতা মণীন্দ্রনাথ ঘোষ, ঐ), সুরীল পাল (পিতা মহেশ পাল, ভাঙাদহ, ফরিদপুর, পাবনা), শশধর পাল (পিতা সুরীল পাল, ঐ), রবি পাল (ঐ), কমলা রানী পাল (স্বামী সুরীল পাল, ঐ), ক্ষীরোদ পাল (পিতা মহেশ পাল, ঐ), জ্যোৎস্না রানী পাল (স্বামী দুলাল পাল, ঐ), দুর্গাচরণ পাল (পিতা যোগেশ্বর পাল, ঐ), যতীশ পাল (পিতা দুর্গাচরণ পাল, ঐ), হীরু পাল (পিতা বেণীমাধব পাল, ঐ), বীরু পাল (ঐ), যতীশ পাল (পিতা বীরু পাল, ঐ), মণি পাল (পিতা বীরু পাল, ঐ), অভয় পাল (পিতা বল্লভ পাল, ঐ), ফনি পাল (পিতা বেরুম্ব পাল, ঐ), মণীন্দ্রনাথ নন্দী (পিতা সুরেন্দ্রনাথ নন্দী, রূপসী, নাগডেমরা, সাঁথিয়া, পাবনা), দিলীপ কুমার রায় (পিতা ক্ষুদু বাবু, ঐ), তারাপদ পাল (পিতা নারায়ণ পাল, ভাঙাদহ, ডেমরা, ফরিদপুর, পাবনা), সুনীল পাল (ঐ), বৃন্দাবন পাল (ঐ), গণেশ চন্দ্র পাল (পিতা যোগী পাল, ঐ), বিশ্বনাথ পাল (পিতা ননীগোপাল পাল, ঐ), সুখলাল পাল (পিতা গিরিলাল পাল, ঐ), সাধুচরণ পাল 1 (পিতা নরোত্তম পাল, ঐ), জ্ঞানেন্দ্র নাথ পাল (পিতা মহাদেব পাল, ঐ), বৈদ্যনাথ দাস (পিতা হলধর দাস, ডেমরা, ফরিদপুর, পাবনা), সুধীর পাল (পিতা যুবেন পাল, ঐ), স্বপন। কুণ্ডু (পিতা জ্ঞানেন্দ্ৰ কুণ্ডু (ঐ) এবং নীলমণি পাল (পিতা নিবারণ পাল, ভাঙাদহ, ডেমরা, ফরিদপুর, পাবনা)। এদিন প্রাণে বেঁচে যান খলিলুর রহমান, মুজিবুর রহমান, আবদুল গফুর ও মোকছেদ আলী। এসব ব্যক্তির বয়স এখন ৭০-৭২ বছর। এদের কাছ থেকে জানা যায় যে, পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা যুবতী নারীদের ধর্ষণ করে। হিন্দু পুরুষদের বস্ত্রহীন করে পরীক্ষা করা হয় তারা হিন্দু না। মুসলমান। মুসলিম যুবক ও পৌঢ়দের জিজ্ঞেস করা হয় তারা মুক্তিযোদ্ধা কি-না। এভাবে হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক জায়গায় এক একবার বহুজনকে জড়ো করে ব্রাশ ফায়ার করা হয়। অধিকাংশই সঙ্গে-সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে। কেউ-কেউ পার্শ্ববর্তী বড়াল নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণরক্ষার চেষ্টা করে। কিন্তু হানাদাররা গুলি চালিয়ে তাদেরও নির্মমভাবে হত্যা করে। [মো. আবদুল মজিদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড