You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাউসী ব্রিজ যুদ্ধ (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

বাউসী ব্রিজ যুদ্ধ (সরিষাবাড়ী, জামালপুর) সংঘটিত হয় ১০ই অক্টোবর। এতে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৫ জন গুরুতর আহত হন।
সরিষাবাড়ী উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটার উত্তরে ঝিনাই নদীর ওপর বাউসী ব্রিজের অবস্থান। ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের কিছু অংশ এবং দক্ষিণের খুলনা ও বাগেরহাটের সরাসরি রেল যোগাযোগের একমাত্র ব্যবস্থা ছিল ঢাকা- সরিষাবাড়ী রেলপথ। ঢাকার সঙ্গে সরিষাবাড়ী এবং উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণের জেলাসমূহের সরাসরি রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে বাউসী ব্রিজ ধ্বংস করার কোনো বিকল্প ছিল না। যুদ্ধের শুরু থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এ ব্রিজ ধ্বংস করার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। এজন্য বিভিন্ন সময় এ এলাকা রেকিও করা হয়। অপরদিকে বাউসী ব্রিজের গুরুত্ব উপলব্ধি করে পাকহানাদার বাহিনী ও রাজাকার আলবদররা ব্রিজ এলাকায় দুর্ভেদ্য পাহারার ব্যবস্থা করে। তারা ব্রিজের উভয় পাড়ে বাংকার তৈরি করে সেখানে প্রচুর গোলাবারুদসহ ভারী অস্ত্র মজুদ করে। তারা বুঝতে পেরেছিল ব্রিজের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হলে ঢাকার সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবে এবং সরিষাবাড়ীতে তাদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠবে। ফলে পাকবাহিনী একটি শক্তিশালী মিলিশিয়া দল এবং প্রচুর রাজাকার ও আলবদর এখানে নিযুক্ত করে। তারা ব্রিজ রক্ষায় সর্বক্ষণ তৎপর থাকত। এক মুহূর্তের জন্যও ব্রিজের পাহারা এতটুকু শিথিল হতে দিত না।
মুক্তিযোদ্ধারা ৯ই অক্টোবর রঘুনাথপুরে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের সভায় বাউসী ব্রিজ ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩টি কোম্পানির ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা রঘুনাথপুর থেকে পায়ে হেঁটে বাউসী ব্রিজের দিকে রওনা দেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আনিস কোম্পানিকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে থাকা পাকসেনাদের ক্যাম্প আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়, যাতে এখান থেকে হানাদাররা সরষাবাড়ী হয়ে বাউসী ব্রিজ রক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারে। মুক্তিযোদ্ধারা মাদারগঞ্জ উপজেলার শ্যামগঞ্জ বাজারে ৩ দলে বিভক্ত হয়ে রাত ২টায় বাউসী ব্রিজের কাছে পৌঁছেন। সুজাত কোম্পানি বাউসী বাজারের উত্তরে অবস্থিত একটি রেলসেতু ধ্বংস করে এসে বাউসী ব্রিজ আক্রমণে অংশ নেয়। লুৎফর রহমান লোদা কোম্পানি ব্রিজের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থান গ্রহণ করে। সুজাত কোম্পানি ব্রিজের উত্তর-পশ্চিম দিকে এবং ফজলু কোম্পানি নদীর উত্তর পাড়ে অবস্থান নেয়। ব্রিজের দক্ষিণ-পূর্ব দিকসহ পুরো দক্ষিণ পাড় তখন মিলিশিয়া ও রাজাকারআলবদরদের দখলে।
১০ই অক্টোবর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা তিনদিক থেকে একযোগে আক্রমণ করেন। মিলিশিয়া ও রাজাকারআলবদররা পাল্টা আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়। মিলিশিয়া ও রাজাকারআলবদররা ভারী অস্ত্রের তীব্র আক্রমণ করতে থাকে। ব্রিজের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থান নেয়া ফজলু কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের এলএমজি অকেজো হয়ে গেলে তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হন। তাঁদের পিছু হটে যাওয়া সম্পর্কে অন্য কোম্পানি জানতে না পারায় ব্রিজের উত্তর-পূর্ব দিক অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এ সুযোগে মিলিশিয়া ও রাজাকারআলবদররা বাউসী বাজারে ঢুকে ব্রিজের উত্তর- পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণরত সুজাত কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। ঘন কুয়াশা এবং প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে শত্রুসেনাদের অবস্থান বোঝা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ সময় ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলে শহীদ এবং ৫ জন মারাত্মকভাবে আহত হন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র ও অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা প্লাটুন কমান্ডার রফিকুজ্জামান বিএসসি পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। মিলিশিয়ারা রফিকুজ্জামানের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। তাঁর কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানসহ বিভিন্ন তথ্য জানার চেষ্টা করে। কিন্তু রফিকুজ্জামান চরম নির্যাতন সহ্য করেও সহযোদ্ধাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি। তাঁর প্রবল দেশপ্রেম ও অসীম সাহস মিলিশিয়া বাহিনীর প্রধানকে মুগ্ধ করে। এক পর্যায়ে সে রফিকুজ্জামানকে শর্ত দেয় যে, শুধু একবার ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বললে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হবে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তিনি সে প্রস্তাব প্রচণ্ড ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে তার মুখে থুতু ছুড়ে মারেন এবং প্রচণ্ড জোরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেন। এরপর মিলিশিয়ারা তাঁর ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। গুরুতর আহত অবস্থায় জামালপুর পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নির্মমভাবে হত্যার পর মিলিশিয়ারা তাঁর লাশ গুম করে ফেলে।
ঘটনাস্থলে শহীদ ৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকহানাদার বাহিনী ও রাজাকারআলবদররা পায়ে রশি বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে সরিষাবাড়ী রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ফেলে রাখে। রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতের আধারে তাঁর কয়েকজন স্টাফের সহযোগিতায় স্টেশনের পশ্চিম দিকে যমুনা নদীর পাড়ে একই গর্তে সবাইকে কবর দেন।
বাউসী ব্রিজ যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. রফিকুজ্জামান বিএসসি (দৌলতপুর), মো. আবুল কালাম আজাদ (বিরবালিয়া), মো. জালাল উদ্দিন (কাওয়ামারা), মো. আব্দুল মজিদ (চরপোগলদিঘা) এবং মো. আব্দুস সামাদ (কুমিল্লা, নৌসেনা)। গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মো. আব্দুস সামাদ (চরসরিষাবাড়ী), মো. নূরুল ইসলাম (চরহাটবাড়ী), মো. আব্দুল মজিদ (শিমুলতাইর), মো. শাহজাহান (গোয়ালবাথান) এবং প্লাটুন কমান্ডার আ. হামিদ। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি অম্লান রাখার জন্য তাঁদের সমাধিস্থলকে সরিষাবাড়ীর কেন্দ্রীয় শহীদ স্মৃতিকেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সেখানে বহুতল বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন গড়ে উঠেছে। [এ এইচ এম মাছুদুর রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!