বাওড়া রেলওয়ে ব্রিজ বধ্যভূমি ও গণকবর (লালপুর, নাটোর)
বাওড়া রেলওয়ে ব্রিজ বধ্যভূমি ও গণকবর (লালপুর, নাটোর) বাঁশবাড়িয়ার নিকটবর্তী বাওড়া ৩নং চংধুপইল ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডে (বর্তমান আজিমনগর ও আব্দুলপুর রেলওয়ে জংশনের মাঝামাঝি স্থানে) বাওড়া রেলওয়ে ব্রিজ অবস্থিত। এ ব্রিজে কত লোক পাকহানাদারদের হাতে প্রাণ দিয়েছে, তার পরিসংখ্যান কারো জানা নেই। প্রায় প্রতিরাতেই একটি শাটল ট্রেন এসে রাত ১১-১২টার দিকে ব্রিজের ওপর থামত। এরপর লোকজনকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। আগস্ট থেকে পুরো নভেম্বর মাস পর্যন্ত এমন একটি রাত ছিল না যে-রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা এ ব্রিজে মানুষ হত্যা করেনি। রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, নাটোর, সৈয়দপুর, রংপুর, দিনাজপুর, পার্বতীপুর, বগুড়া প্রভৃতি স্থান থেকে বাঙালিদের ট্রেনে করে ধরে নিয়ে এসে এখানে গভীর রাতে হত্যা করত। এলাকাবাসী প্রায়ই গুলির শব্দ শুনতে পেত এবং সমস্ত রাত্রি লোকজন আতঙ্কগ্রস্ত থাকত।
বর্ষায় নদী থেকে উপচে পড়া জল প্রবল বেগে এ ব্রিজের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। লোকবসতি থেকে এ ব্রিজ কিছুটা দূরে এবং নির্জন পরিবেশে অবস্থিত। চারদিকে ফসলের বিস্তীর্ণ সবুজ ক্ষেত। ক্ষেতের ওপারে গ্রাম। ব্রিজ থেকে কোনো গ্রামের দূরত্ব সিকি কিলোমিটার, কোনোটার দূরত্ব তার চেয়ে কিছুটা বেশি। ব্রিজের কাছাকাছি কোনো বসতি নেই। ব্রিজের নিকটবর্তী গ্রামগুলো হচ্ছে- বাওড়া, বাঁশবেড়িয়া, পাকন্দা ও ইসলামপুর। বাওড়া গ্রামের নামানুসারে এ ব্রিজের নামকরণ হয়েছে। পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এ ব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে হত্যা করে নিচ দিয়ে প্রবল বেগে প্রবাহিত স্রোতে নিক্ষেপ করত। ধৃত বাঙালিদের আহাজারিতে রাতের স্তব্ধ আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যেত। হানাদাররা সাধারণত গুলি করে তাদের হত্যা করত না— হয় জবাই, নয় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করত। কেউ তখনি মারা যেত, কেউ অর্ধমৃতাবস্থায় স্রোতে ভেসে যেত। নদীর পাড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় একটি যুবককে দেখতে পান ইসলামপুর গ্রামের ডা. আমান উল্লা, যিনি নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে চিকিৎসা বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তিনি যুবকটিকে কাঁধে করে নিজ গ্রামে নিয়ে যান এবং চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করে তোলেন। বর্তমানে ঐ যুবক রাজশাহী শহরে একজন বড় কাপড় ব্যবসায়ী। আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ চার মাসে কত বাঙালিকে এ ব্রিজে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তার হিসাব কোনোদিন জানা যাবে না। প্রত্যেক রাতে অসংখ্য বাঙালি মায়ের বুক খালি হতো। দিনের বেলায়ও ভয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দারা ঐ ব্রিজে যাওয়ার সাহস পেত না। দু- একজন যারা সাহস করে গিয়েছে, তারা সেখানে দেখতে পেয়েছে বাঙালির রক্তে রঞ্জিত ঘাস ও মাটি। নিহতদের মধ্যে যাদের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, গ্রামবাসী তাদের বাওড়া ব্রিজ সংলগ্ন স্থানে গণকবর দেয়। বাওড়া ব্রিজটি মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী, হয়ে আছে। [সুমা কর্মকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড