বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালি পুলিশের আত্মত্যাগ ও গৌরবের ইতিহাস। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ ও নয় মাসের রক্তাক্ত সংগ্রামে পুলিশ সদস্যদের আত্মত্যাগের গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরার লক্ষ্যে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স প্রাঙ্গণে ২৪শে মার্চ ২০১৩ সালে স্থাপিত হয় বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। প্রাথমিকভাবে এ জাদুঘর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অবস্থিত টেলিকম ভবনের নিচতলায় দুটি কক্ষ নিয়ে ছোট্ট পরিসরে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে ২৩শে জানুয়ারি ২০১৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার্ষিক পুলিশ সপ্তাহের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আধুনিক নকশায় নবনির্মিত ভবনে জাদুঘরের শুভ উদ্বোধন করেন।
চমৎকার নির্মাণশৈলী আর স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালে ঘেরা চৌকোণাকৃতির দুইতলা-বিশিষ্ট এ জাদুঘর এক একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অবস্থিত এ জাদুঘরের উত্তর পার্শ্বে সুদৃশ্য ফোয়ারা, দক্ষিণে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ, পূর্বে মূল সড়ক এবং পশ্চিম পার্শ্বে সবুজ ঘাসে ঘেরা মনোরম প্যারেড গ্রাউন্ড। দুইতলা-বিশিষ্ট এ জাদুঘরের ওপরতলা ভূমির ওপরে এবং জাদুঘরের মূল অংশ ভূ-গর্ভে অবস্থিত। জাদুঘরের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করে পাশ্চাত্য ধাঁচে নির্মিত মাঝের দৃষ্টিনন্দন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলে জাদুঘরের সজ্জিত গ্যালারি চোখে পড়ে। এ জাদুঘরের পুরো ছাদ জুড়ে অঙ্কিত রয়েছে লাল-সবুজের পতাকা, যা যেকোনো উঁচু স্থাপনা থেকে সহজেই নজরে পড়ে। জাদুঘরটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ছাদটি এমনভাবে নির্মিত যেন পুরো স্থাপনাটি স্মৃতিসৌধের প্রতি শ্রদ্ধাবনত।
জাদুঘরের ওপরতলা বঙ্গবন্ধু গ্যালারি ও লাইব্রেরি নিয়ে সজ্জিত এবং নিচতলা সাজানো হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের ইতিবৃত্ত ও মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা-সংশ্লিষ্ট ইতিহাস বর্ণনায়। জাদুঘরে প্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গে চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে শুরু করে তাঁর কর্মময় জীবনের উল্লেখযোগ্য নানা দিক, যা ঘূর্ণায়মান বক্সে ছবি, সংক্ষিপ্ত তথ্য ও. কাব্যময় বর্ণনায় উপস্থাপন করা হয়েছে। এরূপ উপস্থাপন সব বয়সী মানুষকে আকর্ষণ করে, বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও তরুণদের। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনের কিছু দুর্লভ ছবি ও চিঠিপত্র এবং সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার, ভাষণ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র রয়েছে জাদুঘরের বঙ্গবন্ধু গ্যালারিতে। এছাড়াও এ গ্যালারিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অঙ্কিত ছবি, তৎকালীন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের কপি, বিভিন্ন তথ্য সংবলিত ছবি, কন্যা শেখ হাসিনার কাছে লেখা চিঠির ছবি ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু গ্যালারির অপর পাশে (পূর্ব পাশে) রয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পুস্তক নিয়ে সাজানো লাইব্রেরি। লাইব্রেরিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট প্রচুর সংখ্যক গ্রন্থ। এছাড়া এ লাইব্রেরিতে ই-লাইব্রেরির সুবিধাসহ দর্শনার্থীদের চমৎকার পরিবেশে বই পড়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। জাদুঘরের মূল অংশে প্রদর্শিত হয়েছে ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের উদ্ভব এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা ও আত্মদানের স্মৃতিস্মারকসমূহ এবং ঐতিহাসিক দলিল-পত্রাদি। গ্যালারির শেষে দক্ষিণ পার্শ্বে রয়েছে ১০০ আসনবিশিষ্ট একটি চমৎকার হলরুম। এ হলরুমে দর্শনার্থীদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তথ্যচিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন পরিচালকসহ মোট ১৮ জন জনবল নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ পুলিশের অধিভুক্ত একটি শাখা হিসেবে ৫ই জুলাই ২০১৭ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন লাভ করে। পরিচালনার নীতিমালা অনুযায়ী ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ এবং বাংলাদেশ পুলিশের সকল এডিশনাল আইজিপি ছাড়াও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিনিধি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও শহীদ পুলিশ পরিবারের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি উপদেষ্টা পর্ষদ রয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালক পদাধিকার বলে পর্ষদের সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
জাদুঘরে সংরক্ষিত গুরত্বপূর্ণ স্মারকসমূহ: ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা পুলিশের বিভিন্ন স্মারক ও ঐতিহাসিক দলিল-পত্র সংরক্ষিত রয়েছে এ জাদুঘরে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে পুলিশের ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত বেতারযন্ত্র, প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে ব্যবহৃত পাগলা ঘণ্টা, মর্টারশেলের আঘাতের চিহ্ন এবং শেলের অংশবিশেষ, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত পুলিশের থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকার-এর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গার্ড অব অনার প্রদানকারী পুলিশ সুপার (অব.) মাহাবুব উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রমএর ব্যবহৃত রিভলবার, আইজিপি আব্দুল খালেকের ভাষণের কপি, পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক রাজারবাগ ব্যারাকে নির্যাতিত স্যুইপার রাবেয়ার ভাষ্যের কপি, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ব্যবহৃত রিভলবার, পাটগ্রাম থানা পরিদর্শন বইয়ে মুজিবনগর সরকার-এর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান-এর মন্তব্যের কপি ইত্যাদি।
পরিদর্শনের সময়সূচি : সর্বসাধারণের জন্য মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন (শনি-মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার) সকাল ১০:০০টা থেকে বিকেল ৬:০০টা এবং অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সকাল ১০:০০টা থেকে বিকেল ৫:০০টা পর্যন্ত জাদুঘর উন্মুক্ত থাকে। বুধবার সাপ্তাহিক বন্ধ এবং শুক্রবার বিকেল ৩:০০টা থেকে বিকেল ৬:০০টা পর্যন্ত জাদুঘর উন্মুক্ত থাকে। এছাড়াও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন জাদুঘর বন্ধ থাকে। তবে ২৬শে মার্চ ও ১৬ই ডিসেম্বর সর্বসাধারণের জন্য নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জাদুঘর উন্মুক্ত রাখা হয়।
জাদুঘরের কার্যাবলি: মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা নতুন প্রজন্মসহ দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কিত তথ্যাদি, মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট স্মৃতিচিহ্ন ও বীর পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্মৃতিস্মারক সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও উপস্থাপন করা; রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সসহ সারা দেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণ এবং পুলিশের প্রথম সাহসী প্রতিরোধের ইতিহাস তুলে ধরা; স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা; বিভিন্ন সময় মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সভা, সেমিনার, সম্মেলন ইত্যাদির আয়োজন করা; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রমে সহায়তা করা ইত্যাদি।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পর প্রতিষ্ঠিত হলেও স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটি সুধী ও বিদগ্ধজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কৌতূহলী জনগোষ্ঠীর সামনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ইতোমধ্যে এ জাদুঘর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা জাতির সামনে তুলে ধরতে চেতনার বাতিঘরে পরিণত হয়েছে। [আবিদা সুলতানা]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড