বাংলাদেশ পত্রিকা (বরিশাল সদর)
বাংলাদেশ পত্রিকা (বরিশাল সদর) স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিকের একটি সংবাদপত্র। বাংলাদেশের সংবাদপত্র- সাময়িকীর পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী বরিশাল থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ পত্রিকাটিকে বাংলাদেশের শুরুর দিকের অন্যতম সংবাদপত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পত্রিকাটির প্রকাশকাল ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল। অর্ধসাপ্তাহিকী হিসেবে এর প্রথম সংখ্যা আত্মপ্রকাশ করে। তবে, দ্বিতীয় সংখ্যাটি ছাপার পূর্ব মুহূর্তে বরিশালে পাকিস্তানি বিমান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হলে পত্রিকাটির ম্যাটার ভেঙ্গে ফেলা হয়। পরবর্তীকালে বরিশাল হানাদার বাহিনীর কবলে চলে যাওয়ায় এর আর কোনো সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধকালে এ পত্রিকাটির একটি সংখ্যা বের হলেও এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য কোনো অংশে কম নয়।
বাংলাদেশ পত্রিকাটির জন্ম-ইতিহাস এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে গণ্য। ২৫শে মার্চ নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরু ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে-সঙ্গে সমগ্র বাংলাদেশে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বরিশাল তখনো শত্রুমুক্ত। বিভিন্ন স্থানে চলছে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। বরিশাল যুব সংঘের কর্মীরা স্থানীয় ধর্মরক্ষিণীতে সংগ্রাম কমিটির নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিস্ফোরক দ্বারা হাতিয়ার তৈরিতে ব্যস্ত। রসদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বেশি দূর তাঁরা অগ্রসর হতে পারেননি। অগ্নেয়াস্ত্রের স্বল্পতাতো ছিলই। এমতাবস্থায়ও তাঁরা নিশ্চুপ বসে থাকেননি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনের খবর বরিশালে এসে পৌছায়। মানুষ দিনদিন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ১৬ই এপ্রিল যুবসংঘের কর্মীরা বরিশাল সদর রোডের হাবিব প্রেসে বসে করণীয় নিয়ে আলাপ করতে থাকেন। আলাপের মধ্যেই তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি পত্রিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পত্রিকাটি হবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের মনোবল জাগ্রত করার হাতিয়ার। পত্রিকার নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ। এস এম ইকবাল, হেলালউদ্দিন আহমেদ, মিন্টু বসু প্রমুখকে নিয়ে সম্পাদক মণ্ডলী গঠিত হয়। হারেচ আহমেদ খান, এনায়েত হোসেন মিলন, মুকুল দাস প্রমুখ প্রকাশনার দায়িত্বে থাকেন। আকাশবাণী, বিবিসি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- এবং লোকমুখের সংবাদের ওপর ভিত্তি করে একদিনের মধ্যে পত্রিকার সংবাদ ও নিবন্ধ তৈরি হয়ে যায়। হাবিব প্রেসের ম্যানেজার প্রফুল্ল মুখার্জী এক রাতের মধ্যে পত্রিকাটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। অরুণ গাঙ্গুলী পত্রিকার জন্য বিনামূল্যে কাগজ দেন। দুপাতার পত্রিকার মূল্য ধার্য করা হয় ১৫ পয়সা। প্রথম সংখ্যা ১০ হাজার কপি ছাপা হয়। গোপনীয়তা রক্ষায় পত্রিকায় প্রেসের নামের স্থানে হাবিব প্রেসের নাম দেয়া হয়নি। ১৭ই এপ্রিল ভোরে পত্রিকাটি বাজারে ছাড়া হয়। দীর্ঘদিন বরিশালে দৈনিক বা অন্য কোনো পত্রিকা না আসায় মানুষজন এটিকে লুফে নেয়। উল্লেখ্য, তখনো বরিশাল শহর শত্রুমুক্ত।
পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সংবাদ শিরোনাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর বেতার ভাষণ দিয়ে করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে তার নিচে ‘শোন একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে…’ গানটি সংযোজন করা হয়। এছাড়া প্রথম পাতায় রণাঙ্গনের খবর, রণাঙ্গনের দায়িত্বভার, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মন্তব্য স্থান পায়।
১৭ই এপ্রিল বরিশাল বেলস্ পার্ক (বর্তমান বঙ্গবন্ধু উদ্যান)- এ সংগ্রাম কমিটির নির্দেশে একজন পাকিস্তানি দালালকে প্রায় ২৫ হাজার লোকের উপস্থিতিতে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সুবাদে পত্রিকার সবগুলো কপি ঐদিনই বিক্রি হয়ে যায়। এদিন বরিশালের বাইরের জন্য কয়েক হাজার কপি ছাপানোর অর্ডার দেয়া হয়। ১৮ই এপ্রিল দুপুরের দিকে পরবর্তী সংখ্যা ছাপার জন্য কম্পোজ ও মেকাপ প্রায় শেষ পর্যায়ে। হঠাৎ বরিশাল শহরের ওপর পাকিস্তানি বিমান হামলায় পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। প্রেসের ম্যানেজার প্রফুল্ল মুখার্জী মেশিন কক্ষে গিয়ে পত্রিকার ম্যাটার ভেঙ্গে ফেলেন। প্রেসের সকলে তখন আত্মগোপনে চলে যান। পরে প্রেস থেকে লেখাগুলো সংগ্রহ করে পুনরায় পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু প্রেসের কোনো কর্মীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এদিকে ২৫শে এপ্রিল হানাদারদের হাতে বরিশাল শহরের পতন ঘটে। এর পূর্বে ১৮ই এপ্রিল বরিশাল শহরে বিমান হামলা হলে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড