বসন্তপুর ক্যাম্প অপারেশন (কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা)
বসন্তপুর ক্যাম্প অপারেশন (কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা) পরিচালিত হয় ১২ই জুন ক্যাপ্টেন এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে। এ অঞ্চলের প্রথম ও সফল এ অপারেশনে ২০ জন পাকসেনা হতাহত এবং বেশকিছু অস্ত্র ও গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী নদী ইছামতী ও কালিন্দীর সংযোগস্থলে বসন্তপুর গ্রাম। বসন্তপুর বিওপি সংলগ্ন চন্দ্রদের দোতলা বাড়িতে পাকসেনারা ঘাঁটি তৈরি করেছিল। এটি ছিল তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ঘাঁটি। অবস্থানগত কারণে এ জায়গাটি তাদের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর বিপরীত পাড়েই ছিল ভারতের দক্ষিণ ২৪-পরগণার হিঙ্গলগঞ্জ থানা, বাজার ও বিএসএফ ক্যাম্প। এখানেই কালীগঞ্জের অধিকাংশ শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এ ঘাঁটিটি ছিল প্রধান প্রতিবন্ধক। তাই তাঁরা বসন্তপুরের এ ঘাঁটিতে অপারেশনের পরিকল্পনা করেন।
ঘটনার দিন রাতে ক্যাপ্টেন এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ভারতের হিঙ্গলগঞ্জ থেকে নৌকাযোগে ইছামতী-কালিন্দী পার হয়ে নদীতীরে হাড়দ্দহর কলঘরের কাছে উঠে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (তৎকালীন ওয়াপদা) বেড়িবাঁধের নিচ দিয়ে ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছে অতর্কিতে আক্রমণ করেন। শত্রুপক্ষ থেকেও পাল্টা জবাব আসে, কিন্তু তারা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। এ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন— লে. মাহফুজ আলম বেগ, মেজর লিয়াকত আলী, হাবিলদার সোবহান, নায়েক সুবেদার গফুর, আবদুল হাকিম, ইপিআর আবদুল হাকিম, শেখ ওয়াহেদুজ্জামান, শেখ নাসির উদ্দীন, আতাহার রহমান ওরফে আতাউর, আকবর হোসেন, আব্দুল বারেক, আলাউদ্দীন প্রমুখ। অপারেশনে শত্রুপক্ষের ২০ জন পাকসেনা হতাহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা ৬০টি রাইফেল, ২টি এলএমজি ও বেশকিছু গুলি হস্তগত করতে সক্ষম হন। অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বসন্তপুর অপারেশনের এ সাফল্য মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী বিভিন্ন যুদ্ধে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী করে তোলে। ১২ই জুন বসন্তপুর অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা সাফল্য লাভ করলেও পাকবাহিনীকে হঠাতে পারেননি। ফলে ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, ভারতীয় বাহিনীর লে. সেন শর্মা, ক্যাপ্টেন এম নূরুল হুদা, লে. মাহফুজ আলম বেগ, শেখ ওয়াহেদুজ্জামান, শেখ নাসির উদ্দীন প্রমুখ ভারতের হিঙ্গলগঞ্জ ক্যাম্পে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, যেহেতু বসন্তপুর ক্যাম্পটি মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের জন্য বিশেষ প্রতিবন্ধক, তাই পুনরায় ক্যাম্পটি আক্রমণ করে পাকসেনাদের সেখানে থেকে হঠাতে হবে। পরিকল্পনা মোতাবেক ১০ই জুলাই ৯৫ জন মুক্তিযোদ্ধা রাত সাড়ে ১১টার দিকে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ৬টি উপদলে বিভক্ত হয়ে কালিন্দী নদী পার হয়ে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করেন। ‘ক’ উপদলের নেতৃত্ব দেন শেখ নাসির উদ্দীন ও মো. আব্দুল হাকিমসহ ৯ জন। এঁদের কাজ ছিল মাত্র পাঁচ মিনিট ক্যাম্পের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালানো এবং অবস্থা দেখে ইছামতী নদী পার হয়ে মেজর জলিলের নিকট রিপোর্ট করা। ‘খ’ উপদলের নেতৃত্ব দেন আব্দুল বারেক ও লিয়াকতসহ ৯ জন। ‘গ’ উপদলের নেতৃত্ব দেন ইপিআর আব্দুল হকসহ ১১ জন। ‘ঘ’ উপদলের নেতৃত্ব দেন স্বয়ং ক্যাপ্টেন এম নূরুল হুদা ও আকাম উদ্দীনসহ ২২ জন। ‘ঙ’ উপদলের ২২ জনের নেতৃত্ব দেন শেখ ওয়াহেদুজ্জামান। ‘চ’ উপদলের ২২ জনের নেতৃত্ব দেন লে. মাহফুজ আলম বেগ। মূল আক্রমণকারী দল ছিল ‘ঘ’, ‘ঙ’ ও ‘চ’। এ দলগুলো বীর বিক্রমে আক্রমণ চালায়। লে. মাহফুজ আলম বেগ ও ওয়াহিদুজ্জামান ক্যাম্পের পেছন দিক দিয়ে অর্থাৎ দক্ষিণ দিক দিয়ে এবং ক্যাপ্টেন এম নূরুল হুদা ইছামতী নদীর দিক থেকে একযোগে আক্রমণ করেন। এছাড়া সীমান্তের ওপার থেকে ভারী গোলা বর্ষণ করেন অন্য মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু শত্রুপক্ষ থেকে প্রবল প্রতিরোধ আর পাল্টা আক্রমণের কারণে রাতভর প্রাণপণ যুদ্ধ করেও মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। এ-যুদ্ধে হাবিলদার ইউসুফ ও শহীদুল ইসলাম নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা সামান্য আহত হন। শত্রুপক্ষের হতাহতের খবর জানা যায়নি। [এম এম নজমুল হক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড