মুক্তিযুদ্ধে বাউফল উপজেলা (পটুয়াখালী)
বাউফল উপজেলা (পটুয়াখালী) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ ১লা মার্চ স্থগিত ঘোষণা করলে তার প্রতিবাদে সারাদেশে দাবানলের মতো বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বাউফল উপজেলা এর ধারাবাহিকতায় ২রা মার্চ বাউফল কলেজ মাঠ থেকে প্রায় ৪-৫ হাজার লোকের এক বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে স্থানীয় পাবলিক মাঠে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সমাবেশে পাকিস্তনের পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে সকলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্ৰাম কমিটি গঠিত হয়৷ সংগ্ৰাম কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল আজিজ খন্দকার এমপিএ, বাউফল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এম এ গফুর মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ মিঞা, এডভোকেট হাফিজুর রহমান ওরফে ফোরকান মিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা গিয়াস মৃধা, ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম খান প্রমুখ। এছাড়া বাউফল থানা মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম কমিটি নামে আরেকটি কমিটিও গঠিত হয়।
এই দুই কমিটির তত্ত্বাবধানে বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মান্নান দারোগার নেতৃত্বে বাউফল পাবলিক মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এতে ছাত্র-যুবকসহ সর্বস্তরের জনতা বাঁশের লাঠি ও ৭-৮টি বন্দুক নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করে। পর্যায়ক্রমে ইন্দ্রকুল, বীরপাশা, কেশবপুর, ধুলিয়া ও কালিশুরি স্কুল মাঠেও প্রশিক্ষণ চলে। এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন স্থানীয় পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। পরবর্তীকালে উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গ বাউফল উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন সুবেদার গাজী পঞ্চম আলী (পি আলী) (থানা কমান্ডার) এবং হাবিলদার মুকিম আলী (ডেপুটি কমান্ডার)।
২৬শে এপ্রিল পাকবাহিনী হেলিকপ্টারে পটুয়াখালী শহরে প্রবেশ করে এবং ৫ই মে সেখান থেকে গানবোটে করে বাউফল থানায় এসে ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকবাহিনী পটুয়াখালীতে প্রবেশ করার পর কর্নেল আতিকের পরামর্শে জেলার সকল থানায় শান্তি কমিটি আলবদর ও -রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। বাউফল থানায় মেজর নাদের পারভেজের তত্ত্বাবধানে এসব বাহিনী গঠিত হয়। শান্তি কমিটির নেতৃত্বে ছিল লুৎফর রহমান আনসারী (কাঞ্চন মিয়া), হাচান দালাল, রাজ্জাক খলিফা, কলকাশেম ও ওয়াজেদ সুফি। রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল দাশপাড়ার বেলায়েত কমান্ডার, নয়া মিয়া এবং নাজিরপুরের আবদুল আলী। নাদের পারভেজের তত্ত্বাবধানে এ তিন বাহিনীর সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ চলে।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিবাহিনী, সংখ্যালঘু ও সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের নামের তালিকা পাওয়ার জন্য পাকসেনারা বাউফল থানার ওসি আবদুল মান্নানকে পটুয়াখালী শহরের সামরিক ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালায় এবং তালিকা আদায় করে। সেই তালিকা অনুযায়ী পাকবাহিনী আলবদর ও রাজাকারদের নিয়ে মদনপুরা, কালিশুরি বাজার, কনকদিয়া বাজার, বাউফল ও বগা ইউনিয়নে নির্বিচার হত্যা ও লুণ্ঠন চালায় এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে।
পাকবাহিনী রাজাকার ও আলবদরদের সহযোগিতায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু লোককে পটুয়াখালী ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করে। অনেককে গুলি করে হত্যা করে। এ-কারণে অনেক সংখ্যালঘু পরিবার ঘরবাড়ি ও ধনসম্পদ ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায় এবং এ সুযোগে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাদের ধনসম্পদ লুটে নেয়। বাউফল বন্দরে সাহাপাড়া গ্রামের স্বর্ণব্যবসায়ীদের দোকান ভেঙ্গে সোনা-রুপা সব লুট করে নিয়ে যায়। বাউফল হানাদারমুক্ত হওয়ার পর লুণ্ঠিত স্বর্ণ-রৌপ্য মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করে সরকারি কোষাগারে জমা দেন।
৬ই জুন ধুলিয়া গণহত্যা সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্বারা সংঘটিত এ গণহত্যায় ১৯ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। ১৮ই সেপ্টেম্বর চন্দ্রপাড়া গণহত্যা সংঘটিত হয়। এতে অর্ধশতাধিক গ্রামবাসী শহীদ হন। এদিন হানাদাররা শতাধিক ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। পাকবাহিনী বগা বন্দর আক্রমণ করবে এ খবর জানতে পেরে মুক্তিযোদ্ধারা বগা বন্দরের ব্রিজটি ভেঙ্গে ফেলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হানাদার বাহিনী পার্শ্ববর্তী কনকদিয়া গ্রামের পালপাড়ায় গিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালায়। এতে অনন্ত পাল ও অনুকূল পাল নামে দুজন শহীদ হন।
পাকবাহিনী বাউফল থানার পাশের মাদ্রাসার একটি কক্ষ নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করত। এছাড়া রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সংখ্যালঘুদের ধরে এনে পটুয়াখালীতে নিয়ে নির্যাতন করত, আবার কাউকে-কাউকে গুলি করে মেরে ফেলত।
বাউফলে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা-কর্মীদের নিয়ে একটি গেরিলা ইউনিট গঠন করা হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের ছাত্রনেতা আবু জাফর। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত স্থানীয় এ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
বাউফলে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি যুদ্ধ হয়। প্রথম যুদ্ধ হয় ২৩শে মে ধুলিয়া ইউনিয়নের আলুকী-চাঁদকাঠী নদীর তীরে। পাকবাহিনী কর্তৃক বাউফলের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, লুণ্ঠন ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের খবর পেয়ে সুবেদার গাজী পঞ্চম আলী ও হাবিলদার আবদুল বারেকের নেতৃত্বে ২৫- ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা এখানে তাদের প্রতিরোধ করেন। ফলে উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে ৪-৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় ১১ই সেপ্টেম্বর। এদিন কালিশুরিতে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। কালিশুরি যুদ্ধ-এ ৫-৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। এরপর কালিশুরি ও ধুলিয়াতে আরেকটি যুদ্ধ হয়, যাতে ৩-৪ জন পাকসেনা নিহত হয়।
জাফর বাহিনী ও পঞ্চম আলীর বাহিনীর হাতে এই এলাকার কুখ্যাত রাজাকার সত্তার মাওলানা নিহত হলে পাকবাহিনী আর অপারেশনে নামেনি। এক পর্যায়ে তারা বাউফল থানা ছেড়ে চলে যায়। ফলে ২৯শে নভেম্বর বাউফল হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- শামসুল আলম, বীর উত্তম~ (পিতা আব্দুল ওয়াহিদ তালুকদার, ইন্দ্রপুর)। তিনি বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন ছিলেন।
বাউফলের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- জালাল আহমেদ (পিতা ওয়াজেদ আলী, ছত্রকান্দা; ২৬শে মার্চ খুলনার মিলগেটে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শ্রমিকদের প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ) এবং বদরুদ্দোজা তালুকদার (তাঁতেরকাঠি)। বাউফলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে উপজেলা পরিষদ চত্বরে ‘বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল’ এবং ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ ও মুক্তিযুদ্ধা মঞ্চ’ স্থাপন করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জালাল আহমেদের নামে তাঁর জন্মস্থান ছত্রকান্দা গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আলম, বীর উত্তম-এর নামে কাতরাইল-মালিবাগ সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [আমিরুল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড