বল্লা গণহত্যা (কালিহাতী, টাঙ্গাইল)
বল্লা গণহত্যা (কালিহাতী, টাঙ্গাইল) সংঘটিত হয় ১২ই মে। এতে ১১ জন গ্রামবাসী নির্মম গণহত্যার শিকার হন। টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্বে তাঁত শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ একটি গ্রাম বল্লা। এ গ্রামে বাস করত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসর কুখ্যাত দালাল আবদুর রাজ্জাক আনসারী।
কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম- ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে ১২ই মে ঐ দালালকে ধরার জন্য তার বাড়িতে যান। কিন্তু তাকে বাড়িতে না পেয়ে তার একটি ঘর পুড়িয়ে দিয়ে নাগবাড়িতে চলে আসেন। এ সংবাদ পেয়ে দালাল আবদুর রাজ্জাক আনসারী ও তার চাচাতো ভাই দালাল আবু তালেব আনসারী টাঙ্গাইল হানাদার ক্যাম্পে যায় এবং ঐদিনই হানাদার বাহিনীর একটি বিশাল গ্রুপকে সঙ্গে নিয়ে তারা বল্লা গ্রামে চলে আসে। এদিন তারা গ্রামটিতে লুটপাট শেষে অধিকাংশ ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং নির্মম গণহত্যা চালিয়ে ১১ জন মানুষকে হত্যা করে বল্লা বাজারের নদীর ঘাটে এসে আক্রমণের অপেক্ষায় থাকেন। বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারাও আক্রমণের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকেন।
পাকহানাদাররা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সতর্কতার সঙ্গে বল্লার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১০ জনের একটি অগ্রবর্তী দল গুলিবর্ষণ করতে-করতে এগুতে থাকে। তাদের সন্দেহ মুক্তিবাহিনী হয়তো কোথাও ঝোঁপ-জঙ্গলে অথবা পল্লির কুটিরে আত্মগোপন করে আছে। কয়েক মিনিট চারদিকে লক্ষ করে হানাদার বাহিনী বল্লার দিকে বেপরোয়া গুলি চালাতে শুরু করে। পেছনের মূল দল থেকেও ২৫-৩০টি মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা একেবারে নীরব, নিঃশব্দ। এতে হানাদারদের ধারণা হয়, মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আগমনের খবর পেয়ে ভয়ে পালিয়েছে। তাই কোনোরূপ প্রতিরোধের সম্মুখীন না হয়ে হানাদাররা নিরাপদে বল্লা নদীর ঘাটে এসে পৌঁছায় এবং নদী পার হওয়ার জন্য দুটি নৌকা নিয়ে গুলিবর্ষণ করতে-করতে অগ্রসর হয়। নৌকা দুটি নদীর মাঝখানে আসা পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো গুলির শব্দ না আসায় তারা নিশ্চিন্তে পারের কাছাকাছি চলে আসে। অমনি গর্জে ওঠে অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকীর হালকা মেশিন গান (এলএমজি)। সঙ্গে-সঙ্গে নৌকাদুটি ডুবে যায় এবং কয়েকজন পাকসেনা নদীতে ডুবে মারা যায়। কাদের সিদ্দিকী এলএমজি দিয়ে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন, আর কিছু দূরে গাছের আড়ালে থেকে আলম ও কাশেম নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা অবজার্ভেশন পোস্ট থেকে সঙ্কেত দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নৌকা ডুবে কয়েকজন এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে ৪ জন পাকসেনার মৃত্যু হলে পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। অবস্থা প্রতিকূল দেখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকসেনাদের লাশ উদ্ধারের জন্য তরুণ গেরিলা সবুর খান ও আব্দুল মালেক নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লে পাকসেনারা তাঁদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের রক্ষা করার জন্য কভারিং ফায়ার শুরু করেন। গুলিবর্ষণ ও পাল্টা গুলিবর্ষণের মধ্যে সবুর ও মালেক সাঁতরিয়ে পারে গিয়ে লাশের দিকে অগ্রসর হলে পাকসেনারা আতঙ্কিত হয়ে পিছু হটে। লাশগুলো উন্মুক্ত প্রান্তরে মুক্তিবাহিনীর এত কাছে ছিল যে তা উদ্ধার করা হানাদারদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে পাকবাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পলায়ন করে। শত্রুপক্ষের ৫টি চাইনিজ রাইফেল, প্রায় ৬০০ গুলি, ১০টি গ্রেনেড ও ৪টি দুই ইঞ্চি মর্টার শেল মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। এ-যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে যাঁরা অংশগ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে লাবিবুর রহমান, হুমায়ুন, খোরশেদ আলম (আরও), সাইদুর রহমান, আফসার উদ্দিন, সবুর খান, আব্দুল মালেক, আব্দুল হাকিম, রফিক, নিতাই পাল, বাবুল সাহা ও আমজাদ (কুমিরাবাড়ি)- এর নাম উল্লেখযোগ্য।
বল্লার প্রথম যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর চার নম্বর কোম্পানি বল্লা বাজারের ঘাঁটি রক্ষা করার জন্য সেখানে অবস্থান নেয়। এই ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য হানাদার বাহিনী বিরাট এক সৈন্যদল ও শতাধিক রাজাকার নিয়ে নৌকাযোগে কালিহাতী থেকে বল্লা অভিমুখে যাত্রা করে। এ খবর পেয়ে কাদের সিদ্দিকী রণকৌশল হিসেবে চার নম্বর কোম্পানিকে বল্লা বাজার ছেড়ে গ্রামের ভেতরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে হানাদারদের মরণফাঁদ তৈরি করেন। হানাদাররা পথিমধ্যে কোথাও বাধার সম্মুখীন না হওয়ায় নিশ্চিন্তে বল্লা বাজারে ঘাঁটি স্থাপন করে। এদিকে রাতের অন্ধকারে কাদের সিদ্দিকী বল্লা গ্রামের চারদিকে শক্ত অবরোধ গড়ে তোলেন। এছাড়া ঘোনাবাড়িতে ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিসেনা অবস্থান নেয়। পাশের দুটি গ্রামে অবস্থান নেয় মুনির ও মোস্তফার নেতৃত্বাধীন একটি দল। ফলে হানাদার বাহিনী সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বল্লা বাজারের চারদিকে পানি, আর গ্রামগুলোতে মুক্তিবাহিনী। এরূপ পরিস্থিতিতে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন ইনাম তাদের অবরুদ্ধ হওয়া এবং রেশন ও অস্ত্রশস্ত্র পাঠানোর যে সংকেত বার্তা টাঙ্গাইলে পাঠায়, তা মুক্তিবাহিনীর বেতারে ধরা পড়ে। কাদের সিদ্দিকী অবিলম্বে চারদিক থেকে হামলা চালিয়ে হানাদারদের নির্মূল করার জন্য ক্যাপ্টেন ফজলুর রহমানকে ঘোনাবাড়ির দিক থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। পাশের দুটি গ্রামে অবস্থানরত মুনীর ও মোস্তফাকেও অনুরূপ নির্দেশ দেন। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। যুদ্ধের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী নৌকায় করে বল্লা ছেড়ে কালিহাতীর দিকে পালাতে শুরু করে। এ-সময় হানাদাররা চারান গ্রামে অবস্থানরত কাদের সিদ্দিকীর মেশিনগানের আওতায় আসামাত্র কাদের সিদ্দিকী আক্রমণ শুরু করেন। এতে ৩০ জন হানাদার নিহত ও কয়েকজন আহত হয়, বাকিরা বল্লা বাজারে ফিরে যায়। এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী তিনটি চাইনিজ এলএমজি উদ্ধার করে।
১৭ই জুলাই একটি হেলিকপ্টারে করে বল্লা বাজারে অবস্থানরত পাকসেনাদের জন্য গোলাগুলি ও খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হয়। এতে তারা মনোবল ফিরে পেয়ে আবার কালিহাতীর দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। অন্যদিকে বল্লায় আটকে পড়া সেনাদের উদ্ধারের জন্য কালিহাতী থেকে একদল সৈন্য চারানের দিকে যাত্রা করে। এ-সময় ফজলুর রহমান, মোস্তফা ও মুনীর তাঁদের দল নিয়ে দ্রুত পেছন থেকে আক্রমণ করলে যুদ্ধ শুরু হয়। দিনব্যাপী এ যুদ্ধে ১৭ জন পাকসেনা নিহত ও ২৮ জন আহত হয় এবং ৭ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। মুক্তিবাহিনীর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ২১শে আগস্ট পর্যন্ত পাকসেনারা বল্লা বাজারে অবরুদ্ধ থাকার পর সেখান থেকে পালিয়ে যায়। [মো. হাবিবউল্লাহ্ বাহার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড