You dont have javascript enabled! Please enable it!

বরগুনা কারাগার গণহত্যা (বরগুনা সদর)

বরগুনা কারাগার গণহত্যা (বরগুনা সদর) সংঘটিত হয় ২৯ ও ৩০শে মে। পাকবাহিনী তাদের দোসর রাজাকার ও শান্তি কমিটির সহযোগিতায় এ গণহত্যা চালায়। এতে ৯১ জন নারী-পুরুষ শহীদ হন।
রাজনৈতিকভাবে সচেতন বরগুনাবাসী ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে। ৩রা মার্চের জাতীয় সংসদ অধিবেশন দুদিন পূর্বে স্থগিত ঘোষণার পরই বরগুনা মহকুমা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর সভাপতি হন আবদুল লতিফ মাস্টার। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ এ সোচ্চার বরগুনাবাসী ২৩শে মার্চ সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে শহরে দুই সহস্রাধিক লোকের বিশাল লাঠি মিছিল বের করে। মিছিল শেষে তারা আবুল হোসেন ঈদগাহ মাঠে সমবেত হয়। সেখানে পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ- সময় তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে শপথ গ্রহণ করে, যে কারণে বরগুনা পাকবাহিনীর বিশেষ টার্গেটে পরিণত হয়। ১৪ই মে বরগুনা শান্তি কমিটির সভাপতি আব্দুল আজিজ মাস্টার, রাজাকার আব্দুল মোতালেব মাস্টার (কেওড়াবুনিয়া), তার ভাই হোসেন মাস্টার এবং মাওলানা আবদুর রশিদ, আজিজ কেরানি (চরকগাছিয়া), মতি মোক্তার, শের আলী মাস্টার (বেতাগী), পাথরঘাটার শান্তি কমিটির নেতা আহের উদ্দীন হাওলাদার ও খলিল চেয়ারম্যান পটুয়াখালী গিয়ে পাকবাহিনীকে পথ চিনিয়ে বরগুনায় নিয়ে আসে। এ-সময় বরগুনার মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের অভাবে তাদের বাধা না দিয়ে পরবর্তী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান। এ সুযোগে পাকবাহিনী বরগুনা শহরে তাণ্ডব লীলা চালায় এবং হিন্দুদের কিছু বলা হবে না-এ ঘোষণা দিয়ে তারা পটুয়াখালী চলে যায়। পাকবাহিনীর ঘোষণায় আশ্বস্ত হয়ে হিন্দু ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকরা বরগুনা শহরে ফিরে আসে।
২৬শে মে মঙ্গলবার বিকেলে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সাফায়েত ৪ জন সহযোগী নিয়ে স্পিডবোটে বরগুনা শহরে উপস্থিত হয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ আনোয়ার হোসেন, মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ, রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির লোকজনের সঙ্গে বৈঠক করে। পরদিন শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে বেছে বেছে হিন্দু, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী ও আওয়ামীপন্থীদের ধরে এনে বরগুনা কারাগারে আটক করে। দুপুরে বৃষ্টি হলে সেই ফাঁকে অনেকে শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। বিকেলে তারা নাথপট্টি, কর্মকারপট্টি, কলেজ রোড, পৌর মার্কেটসহ বরগুনা শহরের বিভিন্ন স্থান ঘেরাও করে ৫০০ থেকে ৬০০ নারী-পুরুষকে বন্দি করে কারাগারে নিয়ে যায়। এ-সময় কয়েকজন নারী পালানোর চেষ্টা করলে রাজাকার চাঁন মিয়া সিকদার (শ্যামলী সিনেমা হলের মালিক) ও তার সহযোগীরা তাদের ধরে এনে শ্যামলী সিনেমা হলের ভেতর নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করে এবং স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা- পয়সা ছিনিয়ে নেয়। অনেক নারীকে তারা পাকসেনাদের সিএন্ডবি ডাকবাংলো ক্যাম্পে নিয়ে আসে। রাতে ঐ সকল বন্দি নারীদের ওপর পাকসেনারা গণধর্ষণ চালায় এবং সকালে তাদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।
২৮শে মে পটুয়াখালী জেলা সামরিক আইন প্রশাসক মেজর নাদের পারভেজ বরগুনায় আসে এবং ২৯শে মে বরগুনা কারাগারের অভ্যন্তরে আদালত বসিয়ে প্রহসনমূলক বিচারকার্য শুরু করে। বিচার শেষে লাইনে দাঁড় করিয়ে ঐদিন (২৯শে মে) পাকবাহিনী ৫৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে। দ্বিতীয় দিন (৩০শে মে) তারা আরো ৩৬ জনকে হত্যা করে। সেদিন অসহায় বন্দিদের রক্তে রঞ্জিত হয় কারাগারের সবুজ চত্বর। তাদের আর্তচিৎকার ও গুলির শব্দে বরগুনা শহর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। হত্যা শেষে লাশগুলো খোলা আকাশের নিচে ফেলে রেখে পাকবাহিনী চলে যায়। রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা লাশগুলো হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কারাগারের দক্ষিণ পাশে ৪টি গর্ত করে মাটিচাপা দেয়। অনেককে অর্ধমৃত অবস্থায় টেনে- হিঁচরে একই সঙ্গে মাটিচাপা দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর ঐসব গর্ত থেকে লাশগুলো তুলে গণকবর দেয়া হয়। বর্তমানে স্থানটি বরগুনার ‘গণকবর’ নামে পরিচিত।
এই গণহত্যার সময় পাকসেনারা ফারুকুল ইসলাম ভ্যান্ডার (পিতা আবুল হাসেম মুন্সী, মাইঠা)-এর শরীরে ৫টি গুলি করে, কিন্তু কোনো গুলিই তার শরীরে তদ্রূপ বিদ্ধ হয়নি। এতে ক্যাপ্টেন নাদের পারভেজ বিস্মিত হয়ে তাকে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয়। তিনি আজো সেই ভয়ার্ত স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন। তবে তার দুই সহোদর নাসির উদ্দিন ও সানু গণহত্যার শিকার হন। কারাগারে গণহত্যার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন ডা. কৃষ্ণকান্ত কর্মকার (কেষ্ট ডাক্তার)। হামাগুড়ি দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাস্তা পাড় হয়ে ভারাণী খাল সাতরে পালিয়ে যাবার সময় লবন গোলার রাজাকার রাঙ্গা মাসুম তাকে ধরে কোদালের বাট দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যা করে।
বরগুনা কারাগার গণহত্যায় শহীদদের মধ্যে যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন- সিদ্দিকুর রহমান ওরফে পনু চেয়ারম্যান (পিতা আব্দুল ওয়াহেদ হাওলাদার, দক্ষিণ বরগুনা), আব্দুর রশিদ মাজেদ (পিতা ডা. আব্দুল হাসেম, পূর্ব কেওড়াবুনিয়া), ধৈর্যধর দেবনাথ (পিতা বিপেন বিহারী নাথ, আমতলার পাড়), মজিবর রহমান কনক (পিতা মুন্সী আমজাদ আলী ওরফে খেদু মিয়া, রায়হানপুর, পাথরঘাটা), শাহজাহান মাস্টার (বরগুনা সদর), মীর মোশারেফ হোসেন (পিতা মীর মনসুর আলী, আমতলার পাড়), দেলোয়ার হোসেন ননী (পিতা মজিবর রহমান মনু, বরগুনা সদর), অজিত কর্মকার (পিতা ডা. কৃষ্ণকান্ত কর্মকার ওরফে কেষ্ট ডাক্তার, কলেজ রোড), ডা. কৃষ্ণকান্ত কর্মকার ওরফে কেষ্ট ডাক্তার (পিতা রমণী মোহন কর্মকার, কলেজ রোড), কামিনী চন্দ্ৰ দে (পিতা মহিন চন্দ্র দে, বরগুনা সদর), নির্মল চন্দ্ৰ নাথ নিমাই (পিতা ক্ষেত্র মোহন নাথ, বরগুনা সদর), গোরাচাঁদ শীল (পিতা ক্ষীরদ চন্দ্র শীল, বরগুনা সদর), মধু শীল (পিতা বালক শীল, লাকুরতলা), বিনোদ কান্ত পোদ্দার (পিতা বরদা কান্ত পোদ্দার, বরগুনা সদর), সুকুমার দাস (বরগুনা সদর), কানাই চন্দ্র দাস (পিতা শিশির দাস, কলেজ রোড), রবীন চন্দ্র দাস (পিতা শিশির দাস, বরগুনা সদর), কৃষ্ণ কান্ত শীল (পিতা রজনী কান্ত শীল, আমতলার পাড়), চিন্তা হরণ নাথ (বরগুনা সদর), সুনীল বণিক (পিতা মহেন্দ্রলাল বণিক, কলেজ রোড), কানাই লাল নাথ (পিতা কালি মোহন নাথ, নাথপট্টি), বলরাম বণিক (পিতা গৌরঙ্গ বণিক, মুক্তিযোদ্ধা পল্লী), হরনাথ কর্মকার (পিতা শ্রীনাথ কর্মকার, পৌরমার্কেট), বাদল কৃষ্ণ পাল (পিতা রাধারমণ পাল, আখরাবাড়ি), সুবাস চন্দ্র নাথ (বরগুনা সদর), বলরাম সরকার বলাই (পিতা সূর্য সরকার, বরগুনা সদর), সুকুমার কর্মকার (পিতা গোপাল কর্মকার, মুক্তিযোদ্ধা পল্লী), সুনীল নাথ (কলেজ রোড), অমূল্য কর্মকার (পিতা অক্ষয় কর্মকার, কর্মকারপট্টি), সুনীল কর্মকার (পিতা অনাথ কর্মকার, পৌরমার্কেট), মদন মোহন নাথ (বরগুনা সদর), মধুসূদন নাথ (পিতা চিন্তাহরণ নাথ, নাথপট্টি), সতীশ চন্দ্র দেবনাথ (পিতা তিনকড়ি দেবনাথ, শেরে বাংলা রোড), নগেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ (পিতা হরিচরণ দেবনাথ, বরগুনা সদর), বৈদ্যনাথ সাহা (পিতা প্রহ্লাদ সাহা, বালিকা বিদ্যালয় রোড), নিশিকান্ত মিস্ত্রী (পিতা চন্দ্র মোহন মিস্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা পল্লী), শংকর কর্মকার (পিতা অনন্ত কর্মকার, কর্মকারপট্টি), নগেন্দ্ৰ নাথ কর্মকার (পিতা ত্রৈলোক্য কর্মকার, কর্মকারপট্টি), অক্ষয় কর্মকার (পিতা মণিমোহন কর্মকার, নাথপট্টি), মাণিক চন্দ্ৰ মালী (পিতা জিতেন চন্দ্র মালী, বরগুনা সদর), যুবরাজ সাহা (বরগুনা সদর), জগদীশ শীল আমতলার পাড়), রজনীকান্ত শীল (পিতা আনন্দ শীল, আমতলার পাড়), গৌরাঙ্গ চন্দ্র নাথ (পিতা হরেকৃষ্ণ নাথ, নাথপট্টি), কৃষ্ণ তালুকদার (পিতা গৌর গোপাল তালুকদার), ব্রজবল্লভ দেবনাথ (পিতা নন্দ দেবনাথ, নাথপট্টি), নিরঞ্জন শীল (পিতা লক্ষণ শীল, বরগুনা সদর), মাণিক কর্মকার (পিতা অমূল্য কর্মকার, কর্মকারপট্টি), নরেশ চন্দ্র ব্রহ্মচারী (বরগুনা সদর), লেহাজ উদ্দীন (পিতা জামিল উদ্দিন, ফুলজুড়ি, বরগুণা), আবু তাহের (পিতা উরফত আলী চৌকিদার, মুক্তিযোদ্ধা পল্লী), ফজলুল হক (বরগুনা সদর), নাসির উদ্দীন (পিতা আবুল হাসেম মুন্সী, মাইঠা), কাঞ্চন মাঝি (পিতা লালু চৌকিদার, গোলবুনিয়া), আবদুল কাদের (বরগুনা সদর), মোশারেফ হোসেন সানু (পিতা আবুল হাসেম মুন্সী, মাইঠা), কালীকান্ত হালদার (পিতা হরিচরণ পাগল, কুমারখালী, বরগুনা সদর), নিখিল চন্দ্র গুহ (পিতা মহেন্দ্ৰ চন্দ্র গুহ, খেজুরতলা, বরগুনা সদর), বলাই মল্লিক (বরগুনা সদর), আজিজ সিকদার (পিতা ইউসুফ আলী, গৌরীচন্না), আফছের আলী মুছুল্লী (বরগুনা সদর), মো. ইসমাইল (পিতা হজরত আলী, কালাইমুড়া), আশরাফ আলী (গুদিঘাটা), মীর ইদ্রিস (খাজুরতলা আশ্রয়ণ), মুজাহার আলী খাঁ (লতাবাড়িয়া), হরেন্দ্র কুমার (বরগুনা সদর), ছত্তার খাঁ (বরগুনা সদর), তৈয়ব আলী (কালিরতবক), ইপিআর সদস্য আবদুল হামিদ মোল্লা (আদাবাড়িয়া), আফজাল আলী (ঘটবাড়িয়া), নিখিল রঞ্জন গুহ (খাজুরতলা), মজিবুর রহমান (বরগুনা সদর), সোবহান তালুকদার (মুক্তিযোদ্ধা পল্লী), সোবহান মৃধা (পিতা আজহার মৃধা, হেউলিবুনিয়া), চাঁদ মিয়া (পিতা হামেদ উদ্দিন, কালির তবক), আবদুর রশিদ (বাইনসমর্ত), মোহাম্মদ হানিফ (ইটবাড়িয়া), তাজেম আলী (মুক্তিযোদ্ধা পল্লী), কালু শীল অমল (পিতা হেমন্ত কুমার শীল), বেচু (বরগুনা সদর), খগেন্দ্র চন্দ্র কর্মকার (পিতা ত্রৈলোক্য কর্মকার, বরগুনা সদর) ও কালীকান্ত গোস্বামী (পিতা গঙ্গাচরণ কীৰ্ত্তনীয়া, বেহালা, তালতলী)। ১৯৯৬ সালে চিপ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং এডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এমপি-র সহযোগিতায় বরগুনা কারাগার গণহত্যার শিকার শহীদদের স্মরণে নামফলকসহ ‘জয় বাংলা’ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [এম এ হালিম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!