বরগুনা সদর উপজেলা
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, তা সারাদেশের মানুষের মতো বরগুনাবাসীও পরের দিন ৮ই মার্চ রেডিওর মাধ্যমে শুনতে পায়। সেদিন হাজার-হাজার মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে বরগুনা শহরের শেরে বংলা সড়কে জড়ো হয়। রেডিওতে মাইক লাগিয়ে শোনানো হয় সেই ভাষণ। ভাষণ শোনার পর ছাত্র-জনতার মিছিলে মুখরিত হয়ে ওঠে সমগ্র শহর। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বরগুনা মহকুমার ছাত্র-জনতা মাঠে নেমে আসে; ‘যার যা-কিছু আছে তাই দিয়ে দুর্গ’ গড়ার আহ্বানে শতশত তরুণ সমবেত হয়। আসমত আলী সিকদার এমএনএ এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল লতিফ মাস্টারের নেতৃত্বে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের সভাপতি ছিলেন আব্দুল লতিফ মাস্টার, সহ-সভাপতি আসমত আলী সিকদার এমএনএ, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নুরুল ইসলাম সিকদার এবং সদস্য ছিলেন রোসমত আলী খান (সাবেক এমএলএ), জয়নাল আবেদীন খান (ন্যাপ- সভাপতি), মোসলেম আলী শরীফ, জ্ঞানরঞ্জন ঘোষ, আব্দুল লতিফ ফরাজী, ইউনুস শরীফ, আজাহার মাস্টার, জহিরুল হাসান, কালু মোল্লা, আব্দুল খবির মাতুব্বর, সিদ্দিকুর রহমান পনু (বরগুনা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান), আব্দুল মন্নান মিয়া, পরেশ তালুকদার, আব্দুল হামিদ মিয়া এবং সাউথ ভাসানি (কাকচিড়ার)। পরিষদের নেতৃত্বে বরগুনায় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।
বরগুনা থানার ওসি আনোয়ার হোসেন এবং আমতলীর সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) আতাহার আলী বিশ্বাস প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। তাঁরা স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ করে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ এবং তাদের ভারতে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা করেন। এজন্য তাঁরা সরকারি তহবিলের ১২ লাখ টাকা স্থানীয় নেতৃবৃন্দের হাতে তুলে দেন। সর্বদলীয় সংগ্রাম
পরিষদের তত্ত্বাবধানে স্থানীয়ভাবেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ওসি আনোয়ার হোসেন, সামরিক বাহিনীর সদস্য আবুল কাশেম, টিএসআই আসাদুজ্জামান খান আজাদ, ন্যাশনাল ব্যাংকের গার্ড পিএমআই আজাদুর রহমান এবং আনসার এডজুট্যান্ট ও সিআই-এর রিডার ফজলুর রহমান খাচকারী ময়দান, বন্দর মাঠ ও পশু হাসপাতাল প্রাঙ্গণে তাদের প্রশিক্ষণ দেন। উল্লেখ্য যে, প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের তখন ভাতা দেয়া হতো।
২৩শে মার্চ ২নং গৌরীচন্না এবং ৩নং ফুলঝুড়ী ইউনিয়ন থেকে মো. রুসমত আলী খান এমপিএ-র নেতৃত্বে সহস্রাধিক লোকের এক লাঠিমিছিল বরগুনায় আসে। মিছিলটি ঈদগাহ মাঠে পৌঁছলে ছাত্রনেতা সিদ্দিকুর রহমান পাকিস্তানি পতাকায় আগুন ধরিয়ে দেন এবং বরগুনা ক্লাবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।
২৫শে মার্চের পর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ নিরাপত্তার স্বার্থে আত্মগোপনে গেলে বরগুনার মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা প্রকাশ্যে আসে। আবদুল আজিজ মাস্টার (প্রাক্তন এমএলএ) ও তাহের উদ্দিন হাওলাদার (পাথরঘাটা) ১৪ই মে পটুয়াখালী থেকে পাকবাহিনীকে বরগুনায় নিয়ে আসে। পাকবাহিনী এসে থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
উপজেলায় প্রধানত মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়। এজন্য আব্দুল আজিজ মাস্টারকে সভাপতি, মোতালিব মাস্টারকে সেক্রেটারি এবং আহের উদ্দিন হাওলাদার, খলিলুর রহমান চেয়ারম্যান, মতি মোক্তার, আজিজ কেরানি, হোসেন মাস্টার প্রমুখকে সদস্য করে একটি কমিটি গঠিত হয়। এদের তত্ত্বাবধানে -রাজাকার বাহিনী গঠিত হয় এবং তার কমান্ডার ছিল আব্দুল ছত্তার চদ্রি এবং সদস্য ছিল ইদ্রিস ধনকার, মজিবর মাস্টার, গনি খলিফা, চাঁন মিয়া, মানিক গাজী প্রমুখ।
পাকবাহিনী বরগুনা কারাগারে একটি গণহত্যা চালায়, যা বরগুনা কারাগার গণহত্যা নামে পরিচতি। ২৯ ও ৩০শে মে পটুয়াখালীর সামরিক আইন প্রশাসক মেজর নাদের পারভেজ কারাগারে সামরিক ট্রাইব্যুনালের নামে তথাকথিত আদালত বসিয়ে কারাগারে আটকদের নির্বিচারে গুলি করার নির্দেশ দেয়। এতে ৯১ জন বন্দি নিহত হন। পরবর্তীতে পাকবাহিনী বরগুনা শহরের আশেপাশে আরো অনেককে হত্যা করে।
বরগুনা সদর উপজেলায় কারাগার ও গণপূর্ত ডাকবাংলো ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। এ-দুটি স্থানে সাধারণ মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন এবং নারীদের ধর্ষণ করা হতো।
বরগুনা কারাগার গণহত্যায় শহীদদের কারাগারের পাশে গণকবর দেয়া হয়। কবরটি বর্তমানে বরগুনা কারাগার গণকবর নামে পরিচিত।
নবম সেক্টরের বুকাবুনিয়া সাব-সেক্টরের অধীন আবদুস সত্তার খান (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র)-এর নেতৃত্বে ২রা ডিসেম্বর ২১ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নৌকাযোগে বরগুনার খাকদোন নদীর পোটকাখালী স্থানে অবস্থান নেয়। এর আগে তাঁরা বরগুনা শহরকে কারাগার, ওয়াপদা কলোনি, জেলা স্কুল, সদর থানা, ওয়ারলেস স্টেশন ও এসডিওর বাসা – এই ছয়টি ভাগে ভাগ করেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ৩রা ডিসেম্বর সকালে ফজরের আজান শুরু হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে একযোগে তাঁরা ফায়ার শুরু করেন। এতে হানাদারদের মধ্যে প্রচণ্ড আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় দফা ফায়ারের পর পাকসেনারা থানা ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা জেলখানায় অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকারদের বন্দি করেন। ফলে এদিনই বরগুনা সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
বরগুনা কারাগার গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে কারাগার গণকবরের স্থানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। [জয়দেব রায়]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড