You dont have javascript enabled! Please enable it!

বরকামতা যুদ্ধ (দেবীদ্বার, কুমিল্লা)

বরকামতা যুদ্ধ (দেবীদ্বার, কুমিল্লা) সংঘটিত হয় ১৪ই ও ২৮শে এপ্রিল। এতে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে দুজন প্রতিরোধযোদ্ধা আহত হন।
বরকামতা কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার থানার একটি ছোট গ্রাম। গ্রামটি ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে মাত্র ১২ কিমি পশ্চিমে বর্তমান চান্দিনা থানার নিকট ঢাকা-চট্টগাম মহাসড়ক সংলগ্ন স্থানে অবস্থিত। সমগ্র চান্দিনা এলাকা যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত বরকামতা নামে পরিচিত ছিল। গ্রামটি ঢাকা-চট্টগাম মহাসড়কের নিকটবর্তী এবং হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়।
১৪ই এপ্রিল পাকসেনারা বরকামতা গ্রামে হানা দেবে এ সংবাদ পেয়ে সিপিবি নেতা কমরেড আব্দুল হাফেজ এবং আব্দুল হালিম (পুলিশ)-এর নেতৃত্বে স্থানীয় প্রায় ৫ হাজার জনতা একত্র হয়। ঐদিন বিকেল ৪টায় এক প্লাটুন পাকসেনা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দেবীদ্বার উপজেলার বরকামতা কাঠেরপুল এলাকায় নেমে পায়ে হেঁটে বরকামতার দিকে এগুবার প্রস্তুতি নিলে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তার পাশে, পানের বরজের আড়ালে এবং ঝোপঝাড়ে লাঠি হাতে ওঁৎ পেতে থাকা প্রায় ৫ হাজার জনতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জনতার পক্ষে দুটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ছিল। তা থেকে গুলি ছুড়লে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বাকিরা ভয়ে পিছু হটে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যায়। ঐদিন সন্ধ্যায় গ্রামের সকল মানুষ আতঙ্কে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এদিকে পাকসেনারা ঐদিন রাতেই ব্যাপক শক্তি নিয়ে পুনরায় বরকামতা গ্রামে ফিরে এসে পুরো গ্রামটি ঘিরে ফেলে। তারা লুটপাট এবং কমরেড পরেশ করের বাড়িসহ বরকামতা গ্রামের সকল বাড়িঘর জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়।
বরকামতা এলাকায় যখন জনতা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তখনো এখানে মুক্তিবাহিনী সাংগঠনিক পূর্ণতা লাভ করেনি। বাঘমারা গ্রামের বি এ মুসলিম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. মনির মাস্টার এলাকার যুবকদের সংগঠিত করেন। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি ভারতের মতিনগরে যান এবং মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর নেতৃত্বেই এলাকাবাসী ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের সহায়তায় প্রাথমিক প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নেয়৷
২০শে এপ্রিল সকাল ১০টায় দ্বিতীয়বার পাকিস্তানিরা চান্দিনা বাজারে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং বরকামতার দুর্গাবাড়িতে আগুন দেয়। গ্রামবাসী লাঠিসোঁটা, বর্শা ও বল্লম নিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। এ প্রতিরোধের খবর মতিনগরে এসে পৌঁছলে ২৬শে এপ্রিল হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে ১২ জনের একটি দল ছোটনা এসে পৌঁছায়। ২৭শে এপ্রিল তাঁরা আমিন উদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়িতে অবস্থান নেন। হাবিলদার গিয়াস ২৮শে এপ্রিল শত্রু কর্তৃক বরকামতা আক্রমণের সংবাদ পান। তিনি তাঁর দলকে দুই গ্রুপে ভাগ করেন। এক গ্রুপ তাঁর অধীনে এবং অপর গ্রুপ নায়েক তাহেরের অধীনে থাকে। এদিন সকাল ৮টায় পাকিস্তানিরা ৪-৫টি ট্রাকে করে এসে চান্দিনা থানার সামনে দিয়ে বরকামতা গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুদের ওপর ফায়ার করেন। পাকবাহিনীও এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। বিকেল ৫টা পর্যন্ত গুলি বিনিময় চলে। এ-যুদ্ধে অধিনায়ক নায়েক তাহের ও সিপাহি কালু মিয়া গুলিবিদ্ধ হন। ক্রমাগত পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় হাবিলদার গিয়াস অবস্থান ত্যাগ করেন। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপস্থিতি বুঝতে পেরে বরকামতা গ্রামে প্রবেশ করে বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন করে।
বরকামতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যাঁদের নাম জানা গেছে, তাঁরা হলেন- মনির মাস্টার, নায়েব সুবেদার আফজাল, হাবিলদার গিয়াস, মো. আব্দুর রব, মো. সাইদ, নায়েব তাহের, সিপাহি কালু মিয়া, হাবিলদার বাদশা মিয়া, সিপাহি বিল্লাল, সিপাহি তাহের, সিপাহি মো. খোরশেদ আলম ও আব্দুল বারেক। [নাহিদ মিয়া]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!