You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.20 | বন্দর গণহত্যা (আনোয়ারা, চট্টগ্রাম) - সংগ্রামের নোটবুক

বন্দর গণহত্যা (আনোয়ারা, চট্টগ্রাম)

বন্দর গণহত্যা (আনোয়ারা, চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় ২০শে মে। এতে ২১২ জন মানুষ নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী কর্ণফুলী নদীর মোহনা সংলগ্ন দেয়াঙ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বন্দর গ্রাম অবস্থিত। ২০শে মে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা অতর্কিতে এ গ্রামে হামলা করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা ও হালিশহর থেকে প্রাণভয়ে শতশত নারী-পুরুষ নিরাপদ ভেবে কর্ণফুলীর অপর পাড়ে বন্দর গ্রামে আশ্রয় নেয়। তখন জলপথ ছাড়া এ অঞ্চলের সঙ্গে কোনো প্রকারের সড়ক যোগাযোগ ছিল না। নদীর এপাড় নিরাপদ হলেও আশ্রিতদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় এ গ্রামের উত্তর পাশে অবস্থিত চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি। এখানে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল। তাদের কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন আনোয়ার। পাকবাহিনীর স্থানীয় দোসররা চট্টগ্রাম জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নবী চৌধুরীর মাধ্যমে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের কাছে সংবাদ দেয় যে, শহর থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিপুল সংখ্যক লোক এ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে এবং স্থানীয় যুবকরা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে। ক্যাপ্টেন আনোয়ার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেকে এ খবর জানায়। ফলে চট্টগ্রামস্থ পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন বন্দর গ্রামের প্রতি কড়া নজর রাখে। স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে তারা তথ্য সংগ্রহ করে স্বাধীনতার পক্ষের শতাধিক লোকের একটি তালিকা পাকবাহিনীর কাছে প্রেরণ করে। পাকবাহিনী বন্দর গ্রামে হামলা চালাবে এ খবর জানতে পেরে স্থানীয় যুবকরা সংগঠিত হয়ে গ্রাম পাহারার ব্যবস্থা করে। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য লাঠিসোঁটা, কিরিচ, সেল ও বল্লম তৈরি করে শক্তি সঞ্চয় করে। যুবকদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন জগদীশ চন্দ্র সিংহ, লিয়াকত আলী চৌধুরী, ক্ষুদিরাম সিংহ, আব্দুল জব্বার, সৈয়দ আহমদ, সৈয়দ নুর চৌধুরী, জাফর উল্লাহ প্রমুখ।
২০শে মে রাত ৩টার দিকে মেরিন একাডেমির ঘাটে তিনটি নৌবহর ভেড়ে। বহরে ছিল লেফটেন্যান্ট কামরুদ্দিন ও রহমানের নেতৃত্বে তিন শতাধিক নৌসেনা। ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও স্থানীয় দোসররা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। একাডেমির দারোয়ান জ্ঞান আলীকে সঙ্গে নিয়ে পাকসেনারা রাত ৪টার দিকে বন্দর গ্রামে প্রবেশ করে। তারা প্রথমে তাদের তালিকা অনুযায়ী স্বাধীনতার পক্ষের লোক বাদশা মিয়াকে খুঁজতে মহালখা বাজারে যায় এবং চা দোকানি চুনি লাল সিংহ বাদশা মিয়া সম্পর্কে তথ্য দিতে দোদুল্যমানতা প্রকাশ করায় তার পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে তাকে হত্যা করে। পাকসেনারা রামচন্দ্র সিংহকে আটক করে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে তার হাত ভেঙ্গে দেয়। মনমোহন সিংহের বাড়িতে আশ্রিত পতেঙ্গার জনৈক ডাক্তারের মাথায় রাইফেল দিয়ে আঘাত করলে তার মা তাকে জড়িয়ে ধরেন। পাকসেনাদের রাইফেলের আঘাতে তার পাজর ভেঙ্গে যায়। এরপর তারা বাদশা মিয়াসহ গোয়ালপাড়া থেকে ৩৪ জনকে আটক করে বাদশা মিয়ার বাড়ির সামনে জড়ো করে। ফজরের আজান পড়ার পরপর পাঁচ শতাধিক পাকসেনা ও তাদের স্থানীয় দালালরা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে হিন্দুপাড়া থেকে যাকে পেয়েছে তাকেই ধরে নিয়ে কমিউনিটি সেন্টারের সামনে জড়ো করে। চলে ব্যাপক হারে ধরপাকড়, নারীনির্যাতন ও লুটপাট। পাকসেনারা চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মচারী রুহিনী সেনকে ধরে গুলি করে হত্যা করে। তারা সতীশ মহাজনের বাড়ি তল্লাশি করে ৯ জনকে আটক করে। তাদের বাঁধার জন্য রশি না থাকায় বাড়ির সামনেই মেশিনগানের গুলিতে তাদের হত্যা করে। এভাবে ভোর রাত থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে তাণ্ডব চালিয়ে আরো ১৫৭ জনকে ধরে বন্দর কমিউনিটি সেন্টারের নিকট পাহাড়ের টিলার নিচে সমতল ভূমিতে জড়ো করা হয়। এরপর তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করলে ১৫৬ জন নিহত হয়। ঘটনাক্রমে বেঁচে যায় লালমোহন সিংহের ৩ বছরের শিশু কালু সিংহ। যারা মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল পাকহানাদরারা তাদের পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। একই সময়ে গোয়ালপাড়ায় জড়ো করা ৩৪ জনকেও একইভাবে হত্যা করা হয়। এদিন এ গ্রামে মোট ২১২ জন গ্রামবাসী ও আশ্রিত মানুষকে হত্যা করে পাকহানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসররা।
বন্দর গণহত্যায় অংশ নেয়া পাকবাহিনীর দোসরদের মধ্যে ছিল মুসলিম লীগ নেতা রাজাকার কমান্ডার জালাল চৌধুরী জৌল্যা, আলি আহমদ, হাফেজ মকবুল, জাফর খান, আবদুল মন্নান, মোহাম্মদ খান, আবুল কাশেম, আহামদ মিয়া (যুদ্ধকালে নিহত), নুরুল ইসলাম, বদিউর রহমান, আলমচ রহমান (যুদ্ধকালে নিহত), কালামিয়া (যুদ্ধকালে নিহত), ছবির আহামদ (পলাতক), মৌলভী আবুল খায়ের (নেজামি ইসলামী নেতা), মওলানা আবু তাহের (মাদ্রাসার ছাত্র, ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর নেতা), মওলানা আ ন ম মুনির আহামদ (মইন্যা রাজাকার) ও তালা মলুই।
বন্দর গ্রামে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পর কয়েকজনের মৃতদেহ মাটিচাপা দেয়া হলেও কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন এলাকায় ১৫৬ জনের লাশ পড়ে ছিল। নিহতদের স্বজনরা সেগুলো মাটিচাপা দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এলাকাটিকে বন্দর বধ্যভূমি নামকরণ করে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। বন্দর গণহত্যায় বন্দর গ্রামের নিহত যাদের নাম জানা গেছে, তারা হলেন- গোবিন্দ চন্দ্ৰ সিংহ (কবিয়াল), হরিমমোহন সিংহ (চৌকিদার, ইউপি), চুনিলাল সিংহ (ব্যবসায়ী), কেন্তল বাহাদুর সিংহ (বাদ্যকর), বীরেন্দ্রলাল সিংহ (কৃষিজীবী), নিরঞ্জন সিংহ (কৃষিজীবী), অক্ষয় কুমার সিংহ (কৃষিজীবী), রামচন্দ্র সিংহ (মহুরি), অক্ষয় কুমার সিংহ (কৃষিজীবী), লালমোহন সিংহ (চাকরিজীবী), মনমোহন সিংহ (কৃষিজীবী), ভুলু রানী সিংহ (গৃহিণী), তুলসী প্রভা সিংহ (শিশু), কর্ণ মজুমদার (ব্যবসায়ী), সুনীল চক্রবর্তী (শিক্ষক), মোহন বাঁশী গুপ্ত (ইউপি মেম্বার), পুরঞ্জন দাশ (ব্যবসায়ী), রাখাল চন্দ্র আইচ (চাকরিজীবী), রুহিণী সেন (বন্দর ভবনের কর্মচারী), মধু সূদন গুপ্ত (কৃষিজীবী), হরি সাধন দাশ (চাকরি), যতীন্দ্র দাশ (ব্যবসায়ী), সাধন সেন (কৃষিজীবী), উপেন্দ্র সেন (ব্যবসায়ী), বামা চরণ জলদাস (মৎস্যজীবী), সর্বানন্দ জলদাস (মৎস্যজীবী), বাচা লাল জলদাস (মৎস্যজীবী), সুরেশ জলদাস (মৎস্যজীবী), অরবিন্দু জলদাস (মৎস্যজীবী), নাথুরাম জলদাস (মৎস্যজীবী), কুমদবন্ধু জলদাস (মৎস্যজীবী), ভগীরথ জলদাস (বন্দর ভবনের কর্মচারী), সর্বা জলদাস (মৎস্যজীবী), নিরঞ্জন জলদাস (মৎস্যজীবী), ভক্তি রঞ্জন জলদাস (মৎস্যজীবী), প্রাণহরি জলদাস (মৎস্যজীবী), বাসুরাম জলদাস-১ (মৎস্যজীবী), বাসুরাম জলদাস-২ (মৎস্যজীবী), বোচাই জলদাস (মৎস্যজীবী), মণীন্দ্র জলদাস (মৎস্যজীবী), ধনেশ্বর জলদাস (মৎস্যজীবী), সতীশ জলদাস (মৎস্যজীবী), সাছি রাম জলদাস (মৎস্যজীবী), হরিধন জলদাস (মৎস্যজীবী), কার্তিক জলদাস (মৎস্যজীবী), ধারাকৃষ্ণ জলদাস (মৎস্যজীবী), মেচারঞ্জন জলদাস (মৎস্যজীবী), আজলা জলদাস (মৎস্যজীবী), এয়ার আলী (কৃষিজীবী), বাদশা মিয়া (ব্যবসায়ী), শাহ আলম (কৃষিজীবী), ইমাম শরীফ (কৃষিজীবী), মো. সৈয়দ (কৃষিজীবী) ও মনি নাথ (বারশত)। উত্তর পতেঙ্গা ও কাঠগড় এলাকা থেকে সেদিন বন্দর গ্রামে আশ্রিত যারা নিহত হন, তারা হলেন— যীশু চৌধুরী (ইপিআর ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরত ছিলেন), সুজিত মজুমদার (ব্যবসায়ী), মানিক চৌধুরী (পেশাজীবী), মন্টু চৌধুরী (পেশাজীবী), প্রফুল্ল মজুমদার (পেশাজীবী) ও বাবুল ভৌমিক (পেশাজীবী)। বন্দর গণহত্যার স্থানে শহীদদের স্মরণে এটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [জামাল উদ্দিন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড