You dont have javascript enabled! Please enable it!

বরইতলা গণহত্যা (কিশোরগঞ্জ সদর)

বরইতলা গণহত্যা (কিশোরগঞ্জ সদর) সংঘটিত হয় ১৩ই অক্টোবর। এতে ৩৬৫ জন মানুষ প্রাণ হারায়।
১৩ই অক্টোবর বুধবার দুপুরে তিন বগির একটি বিশেষ ট্রেনে চড়ে ১৫-২০ জন কালো পোশাকধারী পাক মিলিশিয়া ও খাকি পোশাকধারী সমসংখ্যক রাজাকার কিশোরগঞ্জ থেকে যশোদল রেলস্টেশন পার হয়ে বরইতলা আসে। তারা ট্রেন থেকে নেমে প্রথমে পার্শ্ববর্তী দামপাড়া গ্রামে ঢোকে। সেখানে হাফেজ আব্দুল তৌহিদের বাড়িসহ অনেক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এ গ্রামের আব্দুল খালেকের পুত্র আব্দুল মান্নান, গুরুদয়াল সরকার, কড়ু নমঃদাস ও ডেঙ্গু নমঃদাসকে তারা হত্যা করে। এরা সবাই ছিল সাধারণ গ্রামবাসী।
পাক মিলিশিয়া ও রাজাকারদের এসব হত্যা ও অগ্নিসংযোগে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দামপাড়া, চিকনীরচর, কালিকাবাড়ি, তিলকনাথপুর ও গোবিন্দপুর গ্রামের ৫ শতাধিক মানুষ কিশোরগঞ্জ আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আজিজুল হকের বাড়ি সংলগ্ন নরসুন্দা নদীর বাঁকে অবস্থিত একটি আঁখক্ষেতে আশ্রয় নেয়। হানাদাররা তাদের বরইতলা সংলগ্ন রেললাইনের পাশে সমবেত করে। স্থানীয় দুজন রাজাকারের ইন্ধনে একজন পাক মিলিশিয়া ও কয়েকজন রাজাকার লুটপাটের উদ্দেশ্যে নিজেদের দল ছেড়ে গ্রামের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং বিভিন্ন বাড়ি থেকে স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা-পয়সা লুট করে কিশোরগঞ্জ শহরে চলে যায়। এদিকে গুজব রটে যে, পার্শ্ববর্তী গ্রামের জনগণ উক্ত মিলিশিয়া সদস্যকে হত্যা করেছে। এতে ক্ষিপ্ত মিলিশিয়া দল বরইতলায় জড়ো হওয়া নিরীহ বাঙালিদের লোহার শাবল দিয়ে পিটিয়ে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং সবশেষে ব্রাশ ফায়ার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিছু মানুষ নামাজ পড়ার নাম করে পার্শ্ববর্তী মসজিদে আশ্রয় নিয়ে জীবন রক্ষা করে।
দামপাড়া গ্রামের ইমান আলীর ছেলে হাফিজ সেদিন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে গিয়েছিল। সেই গুলির আঘাতে তার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটে। এ অবস্থা নিয়ে সে এখনও বেঁচে আছেন। এরূপ মারাত্মকভাবে আহত হয়ে কোনোরকমে বেঁচে ছিল এমন অনেকে পরে মৃত্যুবরণ করে।
১৩ই অক্টোবর হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত ৩৬৫ জনের মধ্যে ১১০ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলো- মো. আব্দুল মন্নান (পিতা মো. আবদুল খালেক, দামপাড়া), মো. আব্দুল মোতালিব (পিতা মো. জনাব আলী, দামপাড়া), মো. আব্দুল কাদির (পিতা মো. আ. আজিজ, দামপাড়া), মো. সিরাজুল ইসলাম (পিতা মো. ফয়েজ উদ্দিন মুন্সী, দামপাড়া), মো. আব্দুল মজিদ (পিতা মো. খুদ সেক, দামপাড়া), মো. ফজর আলী (পিতা মো. আ. রাজ্জাক, দামপাড়া), মো. আসাদ মিয়া (পিতা মো. আবদুস ছাত্তার, দামপাড়া), মো. আব্দুল হাই (পিতা মো. আবিদ সেক, দামপাড়া), মো. তৈয়ব আলী (পিতা আব্দুল সেক, দামপাড়া), মো. হাছেন আলী (পিতা আব্দুল সেক, দামপাড়া), মো. শামসুল হক (পিতা মো. হাছেন আলী, দামপাড়া), মো. জাহেদ আলী (পিতা সৈয়দ আলী, দামপাড়া), মো. আবদুল জলিল (পিতা মো. কলিম সেক, দামপাড়া), মো. হাবিবুর রহমান (পিতা মো. আলী মুন্সী, দামপাড়া), মো. আব্দুর রশিদ (পিতা মো. মামুদ আলী, দামপাড়া), মো. আবু তাহের (পিতা মো. শমশের আলী, দামপাড়া), মো. হাছু মিয়া (পিতা মো. আমজত আলী. দামপাড়া) গুরুদয়াল নমঃদাস (পিতা সামরাম নমঃদাস, দামপাড়া), হাফেজ মো. আবদুল তৌহিদ (পিতা মো. আব্বাছ মুন্সী, দামপাড়া), মো. আ. কাদির (পিতা মো. আছির উদ্দিন, দামপাড়া), মো. মোমতাজ উদ্দিন (পিতা মো. আ. করিম, দামপাড়া), মো. সুরুজ আলী (পিতা মো. আ. হাফিজ মিয়া, দামপাড়া), মো. রমজান আলী (পিতা মো. মামুদ আলী, দামপাড়া), মো. আবদুল জব্বার (পিতা মো. আব্দুল জলিল, দামপাড়া), মো. তৈয়ব আলী (পিতা মো. মাসুম আলী, চিকনীরচর), মো. রইছ আলী (পিতা মো. আইন উল্লাহ, চিকনীরচর), মো. আছর আলী (পিতা মো. নইমুল্লাহ, চিকনীরচর), মো. জহুর আলী (পিতা মো. আইন উল্লাহ, চিকনীরচর), মো. জলিল (পিতা মো. মন্নান, চিকনীরচর), মো. আবদুল হাসিম (পিতা মো. আবেদ আলী, চিকনীরচর), মো. আইয়ুব আলী (পিতা মো. উছেন আলী, চিকনীরচর), মো. আব্দুল বারিক (পিতা মো. একরাম হোসেন, চিকনীরচর), মো. ঈমান আলী (পিতা মো. তৈয়ব আলী, চিকনীরচর), মো. মীর হোসেন (পিতা মো. আছির উদ্দিন, চিকনীরচর), মো. মশ্রব আলী (পিতা মো. রইছ আলী, চিকনীরচর), মো. ইসমাইল (পিতা মো. আছমত আলী, চিকনীরচর), মো. আবদুল হাসিম হাজী (পিতা মো. ইব্রাহিম, চিকনীরচর), মো. মফিজ উদ্দিন (পিতা মো. হাছু মিয়া, চিকনীরচর), মো. কালু মিয়া (পিতা মো. ফজর আলী, চিকনীরচর), মো. কাছম আলী (পিতা মো. ছাবিদ সেক, চিকনীরচর), মো. শুক্কুর আলী (পিতা মো. কিয়ামত আলী, চিকনীরচর), মো. আবদুল হামিদ (পিতা মো. নাছির উদ্দিন, চিকনীরচর), মো. তমিজ উদ্দিন (পিতা মো. আবদুল মজিত, চিকনীরচর), মো. আব্দুল মজিদ সরকার (পিতা আবুল হোসেন সরকার, চিকনীরচর), মো. সৈয়দ হোসেন (পিতা মো. আমীর হোসেন ভূঞা, চিকনীরচর), মো. ইনু ভূঁইয়া (পিতা মো. দরবেশ ভূঁইয়া, চিকনীরচর), মো. মাহতাব উদ্দিন (পিতা মো. শাহনেওয়াজ খান, চিকনীরচর), মো. হাছু মিয়া (পিতা মো. নানু মিয়া, চিকনীরচর), মো. ইন্নছ আলী (পিতা মো. ছুবেদ আলী, চিকনীরচর), মো. হাছু মিয়া (পিতা মো. ডেংগু মিয়া, চিকনীরচর), মো. আ. কুদ্দুছ (পিতা মো. আবদুল হাই ভূঁইয়া, চিকনীরচর), মো. আ. রাশিদ (পিতা কালা চাঁন, চিকনীরচর), মো. আবদুল আমীন ভূঁইয়া (পিতা মো. হামিদ ভূঞা, চিকনীরচর), মো. আবদুল রহিম (পিতা মো. আ. আজিজ, চিকনীরচর), মো. জাহেদ মিয়া (পিতা মো. বুধু মিয়া, চিকনীরচর), মৌ. সানু ভূঁইয়া (পিতা মো. নবী নোয়াজ ভূঞা, চিকনীরচর), মো. মাহতাব উদ্দিন (পিতা মো. শাহনেওয়াজ, চিকনীরচর), মো. আবদুল ওয়াহেদ ভূঁইয়া (পিতা মো. আবদুল জামিদ ভূঞা, চিকনীরচর), মো. আশু (চিকনীরচর), মো. ফতে আলী (পিতা মো. আবু, চিকনীরচর), মো. জয়সাল (পিতা মো. মোহাম্মদ খন্দকার, চিকনীরচর), মো. ঈমাম হোসেন (পিতা মো. মনসুর আলী, গোবিন্দপুর), মো. আতিবুল্লাহ (পিতা মো. ছমেদ আলী, গোবিন্দপুর), মো. রৌশন আলী (পিতা মো. আবুল হোসেন, তিলকনাথপুর), সুকুমার চন্দ্র সূত্রধর (পিতা সতীশ চন্দ্ৰ সূত্রধর, কড়িয়াইল), মো. চাঁন মিয়া (কড়িয়াইল), মো. আবদুল করিম (পিতা মো. আতর আলী, কালিকাবাড়ী), মো. মর্তুজ আলী (পিতা মো. আব্দুছ সাত্তার, কালিকাবাড়ী), মো. আবদুল হাসিম (পিতা হাজী জুম্মন আলী, কালিকাবাড়ী), মো. আবদুল হালিম (পিতা হাজী হাসন, কালিকাবাড়ী), মো. আবদুল মান্নান (পিতা মো. মাহমুদ নবী, কালিকাবাড়ী), মো. আবদুল রশিদ (পিতা মো. আলী হোসেন, ঘাগর), মো. মাহতাব উদ্দিন (পিতা মো. সিরাজুল হক, কামালিয়ারচর), মো. খলিলুর রহমান (পিতা মো. আলী মুন্সী, দামপাড়া), মো. ইমান আলী (পিতা সৈয়দ আলী, দামপাড়া), মো. হাফিজ উদ্দিন (পিতা ইমাম আলী, দামপাড়া), মো. খুর্শিদ উদ্দিন (পিতা মো. আবদুল করিম, দামপাড়া), মো. আবদুর রাজ্জাক (পিতা আবিদ সেক, দামপাড়া), মো. ইমাম হোসেন (পিতা খদু সেক, দামপাড়া), মো. কিতাব আলী (পিতা মদন সেক, দামপাড়া), মো. আবদুল আজিজ (পিতা জনাব আলী, দামপাড়া), মো. সাইকুল ইসলাম (পিতা তৈয়ব আলী, দামপাড়া), মো. আবদুল গফুর নোয়াজ, দামপাড়া), মো. আবদুল আজিজ (পিতা আবদুল করিম, চিকনীরচর), মো. আবদুর রাশিদ (পিতা আবদুল করিম, চিকনীরচর), মো. সমজু ভূঞা (পিতা আবদুল ওয়াহেদ ভূঞা, চিকনীরচর), মো. সিরাজ (পিতা হাছু মিয়া, চিকনীরচর), মো. সাহেব আলী মিয়া (পিতা চাঁন সরকার, আউলিয়াপাড়া), মো. বোরন (পিতা ডেঙ্গু ভূঁইয়া, চিকনীরচর), মো. জমির উদ্দিন (পিতা নাছির উদ্দিন, চিকনীরচর), মো. লাল মিয়া (পিতা ফজর আলী, চিকনীরচর), মো. সরাফত ভূঁইয়া (পিতা ছাদির ভূঞা, চিকনীরচর), মো. আজিজুল হক (পিতা মির্জা আলী, চিকনীরচর), মো. মীর হোসেন (পিতা আমীর হোসেন, চিকনীরচর), মো. ইব্রাহিম (পিতা ইসলাম, চিকনীরচর), মো. মিয়ার বাপ (পিতা তাজুল ইসলাম, চিকনীরচর), মো. সিরাজ ভূঞা (পিতা রবির বাপ, চিকনীরচর), মো. মহারাজ মিয়া (পিতা আবদুল হাই, চিকনীরচর), আহাম্মদ আলী (পিতা হাজী মুক্তার উদ্দিন, চিকনীরচর), মো. আবদুর রশিদ (পিতা আবদুল আজিজ, চিকনীরচর), হাজী ইব্রাহিম (পিতা আবদুল ওয়াদুদ মুন্সী, চিকনীরচর), মো. চান্দু মিয়া (পিতা ফালু ভূঞা, চিকনীরচর), মো. মঞ্জিল মিয়া, (পিতা ফালু ভূঞা, চিকনীরচর), মো. সিরাজ মিয়া (পিতা আতর আলী, দামপাড়া), মো. ইদ্রিছ আলী (পিতা ইন্তাজ আলী, দামপাড়া), মো. সিরাজ উদ্দিন (পিতা মো. আবু, মুসলিম পাড়া), মো. সাহেদ আলী (পিতা মো. রজব আলী, মুসলিম পাড়া), মো. কড়ু (পিতা মো. সোনা, মুসলিম পাড়া), মো. ছুরত আলী (পিতা মো. মামুদ আলী, মুসলিম পাড়া) এবং কডু নমঃদাস (পিতা দারীকা নমঃদাস, দামপাড়া)।
স্বাধীনতার পর এলাকাবাসী এসব শহীদের স্মরণে বরইতলা গ্রামের নাম পাল্টিয়ে ‘শহীদনগর’ রাখে এবং গণহত্যার স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। ১৯৯৯-২০০০ সালে কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধান ও অর্থায়নে এ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। এছাড়া এখানে শহীদদের নাম-ঠিকানা সংবলিত একটি সুউচ্চ নামফলক নির্মিত হয়েছে। গণহত্যার চারপাশে জেলা পরিষদের অর্থায়নে সীমানা প্রাচীরও নির্মাণ করা হয়েছে। [জাহাঙ্গীর আলম জাহান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!