বরইতলা যুদ্ধ (কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ)
বরইতলা যুদ্ধ (কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৪ই নভেম্বর। বরইতলা সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর উপজেলার অন্তর্গত গান্ধাইল ইউনিয়নের একটি গ্রাম। কাজিপুর থানা সদর থেকে প্রায় ১০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এ গ্রামটিতে ৩৫০টি পরিবার ছিল। মোজাফফর হোসেন মোজামের নেতৃতে ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ১৪ই নভেম্বর এখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হন। কয়েকদিন আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা শান্তি কমিটি-র সদস্য ইমাম আলী চেয়ারম্যানের পরিত্যক্ত বাড়ি এবং নয়াপাড়া চেয়ারম্যান, মোজাম্মেল হক মাস্টার ও ইব্রাহীম মাস্টারের বাড়িসহ আরো কয়েকটি বাড়িতে অবস্থান নেন। তাঁদের অবস্থানের খবর জানার পর পাকবাহিনী তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়।
১৪ই নভেম্বর ভোররাত। সবাই সেরি খেয়ে ঘুমিয়েছে, কেউবা মসজিদে এতেকাফে বসেছে। ফজরের নামাজের আগে রশিদ মেম্বারের বাড়ির সামনে টহলরত একজন মুক্তিযোদ্ধা অগ্রসরমান পাকসেনাদের ব্যবহৃত আলো দেখতে পেয়ে সঙ্গে-সঙ্গে গুলি চালান। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গুলি করতে-করতে গ্রামে ঢুকে পড়ে এবং নির্বিচারে বাড়িঘর ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে যথেষ্ট প্রস্তুতি না থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে একটু পিছিয়ে যান। পরে প্রস্তুত হয়ে আক্রমণ শুরু করেন। বেলা ১টা পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ চলে। পাকবাহিনীর দেয়া আগুনের শিখা ও ধোঁয়া বহুদূর থেকে দেখা যায়। এর ফলে পার্শ্ববর্তী এলাকার মুক্তিযোদ্ধারাও এসে মোজাম গ্রুপের সঙ্গে যোগ দেন। মুক্তিযোদ্ধারা এবার চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে বাঐখোলার সোরহাব ও কে এম হোসেন আলী হাসানের নেতৃত্বে প্রথম গ্রুপ বরইতলার পূর্বদিকে, আব্দুস ছাত্তার চাকলাদারের নেতৃত্বে দ্বিতীয় গ্রুপ দক্ষিণ দিকে, আবু সাইদ ও শামসুর নেতৃত্বে তৃতীয় গ্রুপ উত্তর-পশ্চিমে এবং দুদুর নেতৃত্বে চতুর্থ গ্রুপ উত্তরে অবস্থান নেয়। কুনকুনিয়ার শামসুল হকের নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জনের একটি দল আবু সাইদ ও শামসুর গ্রুপের সঙ্গে যোগ দেয়। চারদিক থেকে পাকসেনাদের ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধারা আবার যুদ্ধ শুরু করেন। উত্তর-পশ্চিম পার্শ্বের সাইদ-শামসুর গ্রুপের সঙ্গে পাকবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এতে পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদও প্রায় ফুরিয়ে আসে। বেলা ১টার আগে সিরাজগঞ্জ সদর থেকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত অতিরিক্ত পাকসেনাদের একটি দল শুভগাছা হয়ে খামারপাড়া গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমে সোহরাব হাসান গ্রুপকে পেছন থেকে আক্রমণ করে। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ বন্ধ করে উত্তর দিকে সরে যান। এ-যুদ্ধে ৪৯ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- রবিলাল দাস (তারাকান্দি ডোমপাড়া; সোহরাব-হাসান গ্রুপ), সুজাবত আলী (মাথাইল চাপড়; মোজাম গ্রুপ), আব্দুস সামাদ (কাচিহারা; শামসুল হক গ্রুপ) এবং সোহরাব হোসেন (মিরারপাড়া)।
যুদ্ধের পর পাকসেনারা পূর্বদিকে চলে যাওয়ার সময় বরইতলার একটি মসজিদের ভেতরে ঢুকে এতেকাফে বসা মুসল্লিদের হত্যা করে এবং গ্রাম থেকে ধরে আনা ২৭ জন নিরীহ লোককে এক সারিতে বেঁধে গুলি করে। আফসার আলী মেম্বার নামে একজন ছাড়া বাকি সবাই নিহত হন। এদিন বরইতলা গ্রামের দেড় শতাধিক সাধারণ মানুষ পাক হানাদারদের হাতে শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন— আমজাদ আলী (পিতা সাহেব আলী মণ্ডল), পণ্ডিতা সরকার (পিতা সৈয়দ আলী সরকার), আবেদ আলী সরকার (পিতা সৈয়দ আলী সরকার), শামছুল হক (পিতা জমসের আলী সরকার), পন্ডিতা মণ্ডল (পিতা ওমর আলী মণ্ডল), মেহের বক্স (পিতা আজিতুল্লাহ), করিম বক্স (পিতা আজিতুল্লাহ), এজাহার আলী (পিতা মহির উদ্দিন), রিয়াজ উদ্দিন (পিতা আয়ান আকন্দ), ইদ্রিস আলী (পিতা ইউসুফ আলী), মানিক উল্লাহ (পিতা মীর বক্স), আজাহার আলী (পিতা মানিক উল্লাহ), আবুল হোসেন (পিতা ওমর আলী মণ্ডল), আহাম্মদ আলী মণ্ডল (পিতা রমজান আলী মণ্ডল), ছাবেদ আলী আকন্দ (পিতা হোসেন আলী), হাসান আলী জোয়াদ্দার (পিতা শামছুল হক জোয়াদ্দার), শামছুল হক সরকার (পিতা জমসের আলী সরকার), আব্দুল কুদ্দস সরকার (পিতা শামছুল হক সরকার), মোক্তাল হোসেন (পিতা মহির উদ্দিন), আবুল কালাম (পিতা মহির উদ্দিন), আবু সাঈদ আকন্দ (পিতা মৌলভী আব্দুর রহিম), সঈম উদ্দিন খলিফা (পিতা আজিতুল্লাহ), হাবিবুর রহমান (পিতা এশারত আলী সোনারু), আমজাদ হোসেন (পিতা সাকার আলী), সিরাজ উদ্দিন (পিতা ময়েজ উদ্দিন), লোকমান হোসেন (পিতা হাজী ফকির মাহমুদ), গোলজার হোসেন (পিতা হাসান আলী সরকার), করিম বক্স জোয়াদ্দার (পিতা কলিমুদ্দিন জোয়াদ্দার), সফর আলী (পিতা আনা বক্স), আনিছুর রহমান (পিতা জেল হোসেন), জেল হোসেন (পিতা ইজ্জত আলী), আব্দুর রহমান (পিতা নূর মোহাম্মাদ খলিফা), সুজাবত আলী (পিতা মেহের বক্স), দেরাজ উদ্দিন (পিতা কছিম উদ্দিন বৈরাগী), মোজাহার আলী (পিতা খয়ের উল্লাহ), ছাবেদ আলী (পিতা রমজান আলী মণ্ডল), আব্দুল মজিদ (পিতা ইজ্জত আলী), ইসাহাক আলী (পিতা ইব্রাহীম আলী), মোহাম্মাদ আলী (পিতা খবর আলী কর্মকার), আব্দুস সালাম (পিতা ছন্দের আলী), আফজাল হোসেন (পিতা সাদুল্লাহ), নূরুল ইসলাম (পিতা ফাজেল করিম), তেছের আলী (পিতা রহমত উল্লা), মোজাহার আলী (পিতা আজগর আলী আকন্দ), মোহাম্মাদ আলী (পিতা রহমতুল্লাহ), আবেদ আলী (পিতা সৈয়দ আলী), মেহের আলী (পিতা আজিতুল্লাহ), আবেদ আলী (পিতা সমশের আলী), বরকত আলী (পিতা পরশ উল্লা), কোরবান আলী (পিতা সায়েদ আলী), কছির উদ্দিন আকন্দ (পিতা জেল হোসেন আকন্দ), আব্দুল হাকিম (পিতা হাজী মানিক উল্লা), মালেকা খাতুন (পিতা ফাজেল করিম), সুফিয়া খাতুন (পিতা কছির উদ্দিন আকন্দ), কদবানু (পিতা আফজাল হোসেন), জয়গুন বেগম (পিতা আজিত উল্লা ফকির), নইমুদ্দিন আকন্দ (পিতা রহিম উদ্দিন আকন্দ), শামছুল কাদের আকন্দ (পিতা হাজী আহাম্মদ আলী), আব্দুর রহমান আকন্দ (পিতা সাহের আলী আকন্দ), জবান আলী আকন্দ (পিতা সাবান আলী আকন্দ), হযরত আলী আকন্দ (পিতা সাবান আলী আকন্দ), আব্দুল মজিদ (পিতা ইজ্জত আলী আকন্দ), মানিক উল্লা (পিতা মনছব আলী), কোরবান আলী গুট (পিতা ছাবেদ আলী), আজগর আলী (পিতা সুমার আলী), আব্দুল কাদের (পিতা সাহেব আলী আকন্দ), ছন্দের আলী, আজাহার আলী (পিতা নইমুদ্দিন সরকার), বাবু (পিতা আকবর আলী) এবং সন্তোষ আলী। এছাড়া এদিন বিভিন্ন গ্রাম ও পাড়ার আরো চারজনকে হত্যা করা হয়। তাঁরা হলেন- সোলায়মান (পিতা সব্দেল, গান্ধাইল উত্তরপাড়া; দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী), চাঁন মিয়া (পিতা জাবক্স মণ্ডল, খামারপাড়া; ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র), হারুনার রশিদ খা (পিতা হরপ আলী খা, বীর সিংড়াবাড়ি) এবং জমসের আলী নায়েব (পিতা কেফাতুল্লাহ, বীর সিংড়াবাড়ি)।
পাকবাহিনী এদিন ব্যাপক প্রাণহানির পাশাপাশি তিনশতাধিক ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তার মধ্যে রয়েছে গান্ধাইল গ্রামের উত্তরপাড়ার একটি বাড়ি, খামারপাড়া গ্রামের ৮০টি বাড়ি এবং বীরসিংড়াবাড়ি গ্রামের ১০টি ঘরবাড়ি। এর ফলে সেখানে সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। [মো. রেজাউল করিম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড