বীর প্রতীক বদরুজ্জামান মিয়া
বদরুজ্জামান মিয়া, বীর প্রতীক (১৯৪৪-২০১২) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৪ সালের ১লা জানুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নজিরুজ্জামান মিয়া (বিএবিটি), মাতার নাম রোকেয়া জামান। তাঁর পিতা নজিরুজ্জামান মিয়া ফুলবাড়ি জছিমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এ স্কুলে বদরুজ্জামান মিয়া কিছুদিন শিক্ষকতা করেন।
১৯৭১ সালে বদরুজ্জামান মিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের ছাত্র ছিলেন এবং জহুরুল হক (সাবেক ইকবাল হল) হলে অবস্থান করতেন। মার্চের প্রথম দিকে তিনিসহ এ হলের ছাত্ররা জিন্নাহর ছবি ভেঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। একজন সচেতন ছাত্র হিসেবে বদরুজ্জামান মিয়া ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের জনসভায় উপস্থিত থেকে ভাষণ শোনেন। ৯ই মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি নিজবাড়ি কুড়িগ্রাম চলে যান। ১২ই মার্চ স্থানীয় বালারহাট বাজারে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় ঢাকার সাম্প্রতিক সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বক্তৃতা করেন। এ জনসভায় তিনি হানাদার বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কা প্রকাশ করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য গণবাহিনী গঠনের কথা বলেন। জনসভা শেষে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে তদস্থলে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরপর বদরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে নাওডাঙ্গা ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় এবং তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। একই সময় ফুলবাড়ি উপজেলায় বদরুজ্জামান মিয়া এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে একটি ইয়ুথ ক্যাম্প স্থাপিত হয়। ২৬শে মার্চ তিনি ফুলবাড়ির ইদ্রিস মেকারকে নিয়ে হানাদার বাহিনীর গণহত্যা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার খবর এলাকার জনগণের মধ্যে প্রচার করতে থাকেন। ২৮শে মার্চ তাঁর নেতৃত্বে লালমনিরহাটে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করা হয়। এ প্রতিরোধযুদ্ধে কয়েকজন অবাঙালি ইপিআর সদস্য নিহত হয় এবং ইপিআর সদস্য মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান (নোয়াখালী) শহীদ হন। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনের সঙ্গে বাঙালি ইপিআর, পুলিশ ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যসহ ছাত্র- যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধকালে প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যান বদরুজ্জামান মিয়া। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তিনি মোগলহাটে অবস্থান নেন। পাটেশ্বরী পর্যন্ত ফ্রন্টলাইন নিয়ন্ত্রণ করে ৯ মাস তা মুক্ত রাখেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে তিনি ৬নং সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন। ১২ই নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে পাটেশ্বরী হানাদার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এর একটি উপদলের নেতৃত্ব দেন বদরুজ্জামান মিয়া। পাটেশ্বরী দখলের পর তাঁরা ১৩ই নভেম্বর ভুরুঙ্গামারী আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের এ-যুদ্ধ ১৪ই নভেম্বর পর্যন্ত চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি আক্রমণে হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এ-যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ৪০-৪৫ জন সদস্য নিহত এবং ভুরুঙ্গামারী হানাদারমুক্ত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার বদরুজ্জামান মিয়া-কে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বদরুজ্জামান মিয়া সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। এক পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোশেনের সচিব পদে উন্নীত হন এবং ২০০২ সালের ১লা নভেম্বর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ২০০১ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম নূর মহল বেগম। বদরুজ্জামান মিয়া ১ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক। তিনি ২০১২ সালের মে মাসে মৃত্যুবরণ করেন। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড