বদলপুর যুদ্ধ (আজমিরীগঞ্জ, হবিগঞ্জ)
বদলপুর যুদ্ধ (আজমিরীগঞ্জ, হবিগঞ্জ) সংঘটিত হয় ১৬ই নভেম্বর। এতে ৮ জন রাজাকার নিহত হয়। অপরদিকে জগৎজ্যোতি দাস, বীর বিক্রম শহীদ এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
বদলপুর ইউনিয়ন আজমিরীগঞ্জ থানা সদর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র হবিগঞ্জ জেলা ৩নং সেক্টরের অধীন ছিল। তবে যোগাযোগ সমস্যার কারণে ৩নং সেক্টর থেকে অপারেশন পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য ছিল বিধায় এ অঞ্চলে ৩নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা কম আসতেন। অপরদিকে নৌ যোগাযোগের সুবিধা ও এ অঞ্চলের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ৫নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধরত থাকায় উক্ত সেক্টরের টেকেরঘাট সাব-সেক্টর থেকে এ এলাকায় অনেকগুলো যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে।
আজমিরীগঞ্জ থানার জলসুখা গ্রামের সন্তান জগৎজ্যোতি দাস ছিলেন ৫নং সেক্টরের অধীন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি এ এলাকার মানুষ হিসেবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে অনেকগুলো সফল অভিযান পরিচালনা করেন। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে তাঁর অনেকগুলো সফল অভিযানের কারণে এ অঞ্চলে তিনি পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের কাছে ত্রাস হিসেবে গণ্য হতেন। এক সময় ভাটি এলাকায় তাঁর নেতৃত্বাধীন মুক্তিয়োদ্ধা দলটি দাস পার্টি হিসেবে খ্যাত হয়ে পড়ে। দাস পার্টির প্রতি সেক্টর কমান্ডারের আস্থা সৃষ্টি হওয়ার পর তাঁর নেতৃত্বে ভাটি অঞ্চলে বৃহৎ অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়। সে মোতাবেক ১৫ই নভেম্বর জগৎজ্যোতির অধীনে টেকেরঘাট সাব-সেক্টর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ভাটি অঞ্চলে অভিযানের একটি বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে যাত্রা করে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী হবিগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বানিয়াচঙ্গ হানাদারমুক্ত করে তার আশপাশের থানাগুলোতে পর্যায়ক্রমে অভিযান চালানোর কথা। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে যে পরিমাণ যুদ্ধ-রসদ প্রয়োজন, তা ইন্ডিয়ার সেক্টর কমান্ডার মেজর জি এস বাট্ট সরবরাহ করেন। উক্ত রসদ সামগ্রীর মধ্যে ছিল ৪টি জিএফ – রাইফেল, জাহাজবিধ্বংসী অস্ত্র, রকেট লাঞ্চার, ৪টি ২ ইঞ্চি মর্টার, ৫টি লাইট মেশিনগান, ১০টি এসএমজি এবং বাকি অর্ধেক ছিল রাইফেল ও এসএলআর। এসব অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের বাক্স দুটি নৌকায় বোঝাই করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা বহনকারীসহ মোট নৌকা ছিল ১০টি। টেকেরঘাট তাহিরপুর থানাধীন হওয়ায় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে থানা সদর অতিক্রম করতে হয়। ১০টি নৌকার বহর একযোগে রাত ২টায় শাল্লার শিবপুর গ্রামে পৌঁছলে সেখানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা সুকুমার শাল্লা থানা অপারেশন করে বানিয়াচঙ্গ অপারেশন করতে পরামর্শ দেন। জগৎজ্যোতি তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হয়ে সুকুমারের দুজন লোককে জেলের ছদ্মবেশে রেকি করতে পাঠান। তাঁদের ফিরতে দেরি হওয়ায় জগৎজ্যোতি তাঁর কোম্পানিসহ বানিয়াচঙ্গের উদ্দেশে রওনা হন। তখন মধ্য-নভেম্বর হওয়ায় নদীপাড়ের অনেক জায়গা শুকিয়ে যায়। ফলে শিবপুর থেকে ৪ মাইল দক্ষিণে কান্দিরগাঁও গ্রামের লোকজন মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে পেয়ে অনেক উৎসাহ দেয় এবং সাহায্য-সহযোগিতা করে।
জগৎজ্যোতিসহ দাস পার্টির এগিয়ে যাওয়ার সংবাদ সম্পর্কে ঘুঙ্গিয়ারগাঁও-এ অবস্থানরত হানাদাররা তাদের অগ্রবর্তী দলকে ওয়ারলেস মারফত নিশ্চিত করলে পাকসেনারা সেখানে শক্তি বৃদ্ধি করে। দাস পার্টিকে ফাঁদে ফেলার জন্য সেখানে পাকবাহিনীর ৩টি টিম প্রস্তুত ছিল। দাস পার্টির কোনো সদস্যই তা টের পাননি।
১৬ই নভেম্বর পাকসেনাদের পাতানো ফাঁদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। ঘড়ির কাঁটায় যখন সকাল পৌনে ৮টা, ঠিক সে-সময় জগৎজ্যোতিদের নৌকার বহর ভেড়ামোহনা নদীতে পৌঁছে যায়। বদলপুর পৌঁছার পর মুক্তিযোদ্ধারা সংবাদ পান বদলপুর ইউপি অফিসের ঘাটে কয়েক জন রাজাকার ব্যবসায়ীদের নৌকা আটক করে চাঁদা আদায় করছে। এ অবস্থায় জগৎজ্যোতি ক্ষুব্ধ হয়ে রাজাকারদের ধাওয়া করতে নির্দেশ দেন। তাঁর কথা অনুযায়ী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হালকা অস্ত্র নিয়ে অগ্রসর হন। রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে পালাতে শুরু করে। অধিকাংশ রাজাকার নদীর তীর দিয়ে পিটুয়াকান্দি গ্রাম ও কইয়ার বিলের মাঝ দিয়ে জলসুখার দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। তন্মধ্যে ৫ জন রাজাকার নৌকাযোগে কৈয়ার বিলের মাঝ দিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। জগৎজ্যোতি তাদের জীবিত ধরে আনতে নির্দেশ দিলে মতিউর রহমান, নিলু ও কাজল অন্য একটি নৌকা নিয়ে তাদের ধাওয়া করেন। রাজাকারদের নৌকা লক্ষ করে তাঁরা গুলি চালালে প্রাণ বাঁচাতে রাজাকাররা নৌকা থেকে লাফিয়ে পানিতে পড়ে। তাদের জীবিত রাখা নিরাপদ নয় ভেবে নিলু ৫ জন রাজাকারকে গুলি করে পানিতে ডুবিয়ে দেন।
অপরদিকে একই সময়ে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের ধরে আনার জন্য পিটুয়াকান্দির দিকে যান। তাঁরা সে গ্রামে বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে কাউকে না পেয়ে ফিরে আসেন। তখন সকাল ৯টা। এ-সময় জলসুখার দিকে গুলির আওয়াজ শোনা যায়। পালিয়ে যাওয়া রাজাকারদের ধরে আনতে জ্যোতি তখন মো. আলী মমিন, বিনোদ বৈষ্ণব, মজিদ, সুনীল বর্মণ, নীপেন্দ্র ঘোষ, আইয়ুব আলী, নীলু প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সঙ্গে গুলি বিনিময়কালে এক পর্যায়ে এলএমজি-র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে জগৎজ্যোতির কাছে সংবাদ প্রেরণ করলে তিনি গোপেশ চন্দ্ৰ দাস, ইলিয়াস চৌধুরী, মতিউর রহমান, আইয়ুব আলী, আব্দুল মজিদ, নিত্যানন্দ, বিজয় দাস, ইদ্রিস আলী, আবু সুফিয়ান, সুবল চন্দ্র চৌধুরী প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হন। তিনি তাঁদের একটি মর্টার শেল এবং একটি এসএমজি ও দুটি মেশিনগান সঙ্গে নেয়ার নির্দেশ দেন। এ-সময় ইলিয়াস পুরো শক্তি সঙ্গে নেবার পরামর্শ দিলেও জগৎজ্যোতি তাতে কর্ণপাত না করে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে থাকার নির্দেশ দিয়ে অগ্রসর হন।
ইতোমধ্যে রাজাকাররা নোয়াগাঁও দিয়ে নদী সাঁতরে জলসুখা চলে যায়। নোয়াগাঁও ও জলসুখার মাঝখানে একটি নদী। নদীর পাড়ে নোয়াগাঁও আসতেই জগৎজ্যোতির মনে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। তিনি অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। সেখানে মূল নদীর সঙ্গে একটি শাখা নদীর সংযোগ ছিল। কিছুদূর এগোবার পর তা হাওরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ঐ শাখা নদীতে পূর্ব থেকে রাজাকারদের নৌকা রাখা ছিল। তারা সেখান থেকে নৌকা নিয়ে পালাতে চাইলে তাদের ওপর ব্রাশ ফায়ার করা হয়। এতে ৩ জন মারা যায়। সেখান থেকে ২ জন রাজাকার লাফিয়ে পড়ে গ্রামে গিয়ে অবস্থান নিলে তাদের ওপর মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। নিক্ষিপ্ত শেলটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তবে পাকহানাদার ও রাজাকাররা দাস পার্টির অবস্থান সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে সক্ষম হয়। মর্টার শেলটি যখন নিক্ষেপ করা হয় তখন মুক্তিযোদ্ধারা বিলের মাঝামাঝি স্থানে চলে আসেন। পিটুয়াকান্দি পিরোজপুর ও কৈয়া গোপীতে অবস্থান নেয়া হানাদার ও রাজাকাররা এ-সময় তিনদিক থেকে আক্রমণ করে।
জগৎজ্যোতি বিলে যাওয়ার আগে নদীতে রেখে যাওয়া দলকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যে, সমস্যা হলে তাঁরা যেন ব্যাকআপ দেন। কিন্তু হানাদাররা ব্লক সৃষ্টি করার কারণে তাঁদের অবস্থানস্থল থেকে বেশি দূর এগোতে পারেননি সহযোদ্ধারা। গ্রামগুলো পাশাপাশি হওয়ায় তিন দিকের আক্রমণে পড়ে যান দাস পার্টির সদস্যরা। পেছন দিক থেকে কিছুটা ব্যাকআপ পাওয়া গেলেও যতটা দূরত্বে থেকে তাদের আক্রমণ করা আবশ্যক, তার চেয়ে অনেক বেশি পেছন থেকে আক্রমণ করায় তার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। অনেক সামনে থেকে হানাদাররা জগৎজ্যোতিদের উদ্দেশে গুলি নিক্ষেপ করায় অনেকটা ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়ে যান জগৎজ্যোতিসহ তাঁর দল। মুক্তিযোদ্ধাদের অপর দলটিকে হানাদারদের অন্য একটি দল ব্লক সৃষ্টি করে বিলের দিকে এগিয়ে আসতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে সে দলটিও মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ অবস্থায় শত্রুপক্ষের ৪০-৫০ জনের একটি দল বিলের মধ্যে থাকা দাস পার্টির সদস্যদের বিপরীতে গুলি বিনিময় অব্যাহত রেখে এগোতে থাকে। জগৎজ্যোতি তাঁর সঙ্গের মাত্র কয়েকজন সহযোদ্ধা নিয়ে একেবারে শত্রুব্যূহের মধ্যে পড়ে যান। এক পর্যায়ে তাঁদের প্রয়োজনীয় গুলি সরবরাহের পথও বন্ধ হয়ে যায়। অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুদ কমে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়ে যায় দাস পার্টি। অন্যদিকে আক্রমণের তীব্রতায় ব্যাকআপ পার্টিও পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় দলের মাত্র ১২ জন যোদ্ধাকে নিয়েই যুদ্ধ চালিয়ে যান বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি। এক পর্যায়ে মাত্র একশ গজ দূরত্বে চলে আসে শত্রুবাহিনী।
বিকেল ৩টার দিকে দুটি বিমান উড়ে যায় দাস পার্টির মাথার ওপর দিয়ে। এর কিছুক্ষণ পরই একটি গুলি এসে লাগে মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব আলীর শরীরে। গুলিবিদ্ধ আইয়ুব আলী ছটফট করতে থাকেন। তাঁকে নিয়ে হালকা ব্রাশ ফায়ার করতে-করতে পিছু হটেন ২ জন মুক্তিযোদ্ধা। এ-সময় আরো একজন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হন। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ইলিয়াসের বাম পাঁজরে একটি গুলি লাগে। জগৎজ্যোতি তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। রক্তের ধারা বন্ধের জন্য নিজের মাথার গামছা খুলে ক্ষতস্থানে শক্ত করে বাঁধেন। গুরুতর আহত ইলিয়াস ‘আমরা তোমাদের ব্যাকআপ দিচ্ছি’ বলে সহযোদ্ধাদের আত্মরক্ষার পথ অবলম্বনের নির্দেশ দেন।
একে-একে সবাই চলে যান। যুদ্ধস্থলে কেবল ইলিয়াস আর জগৎজ্যোতি। চারদিক থেকে ঝাঁকে-ঝাঁকে গুলি আসছে। ইলিয়াসের দেহ থেকে রক্ত ঝরছে। উদ্বিগ্ন জগৎজ্যোতির পাশে কেউ নেই। সুযোগ নেই গুলি করে পিছু হটারও। তাই নির্বাক জগৎজ্যোতি আর ইলিয়াস পালাক্রমে টার্গেট অনুযায়ী অবিরাম গুলি করতে থাকেন। একজনের গুলি শেষ হলে অন্যজন তার লোড করা অস্ত্রে গুলি চালাতে থাকেন। এভাবে দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ চলতে থাকে। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় জগৎজ্যোতির দেহে। সুঠাম দেহের প্রাণবন্ত জগৎজ্যোতি শেষবারের মতো চিৎকার করে ওঠেন। ইলিয়াস পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেন তাঁর দুঃসাহসী কমান্ডার জগৎজ্যোতির দেহ বিলের পানিতে ডুবে যাচ্ছে। তিনি দ্রুত এগিয়ে যান তাঁর কাছে। বেদনাহত চিত্তে তিনি যখন জগৎজ্যোতির দেহটি তুলে ধরেন, তখন তা নিষ্পন্দ- নিথর।
অবস্থার অনিবার্যতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় ইলিয়াস৷ কিন্তু ভাবনার সময়তো তাঁর নেই। চতুর্দিক থেকে ঘিরে আক্রমণরত শত্রুদের থাবা থেকে নিজেকে রক্ষা এবং কমান্ডারের মৃতদেহ সরানো এ দুটি বিষয়ই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কোনোটিকেই তিনি উপেক্ষা করতে পারছেন না। অবশেষে শত্রুর দৃষ্টিকে ফাঁকি দেবার জন্য প্রাণহীন জগৎজ্যোতির দেহটি কোমর পানিতে কাঁদার মধ্যে ডুবিয়ে দেন। তাঁর গুলিবিদ্ধ ক্ষতস্থান থেকে তখনো রক্ত ঝরছিল। এ অবস্থায়ই হাতে নিজের এসএমজি ও কাঁধে জ্যোতির এলএমজি নিয়ে বিলের কোনাকুনি রওনা হন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত জগৎজ্যোতির সঙ্গে থাকা মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস। ইলিয়াস নিরাপদ আশ্রয়ের প্রত্যাশায় প্রাণপণে পার্শ্ববর্তী গ্রামের দিকে ছুটতে থাকেন। তাঁর পিছু হটা অনুমান করে শত্রুরা তাঁকে লক্ষ করে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে কোনোমতে তিনি তাদের রেঞ্জের বাইরে চলে যেতে সক্ষম হন। গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছার পর অন্ধকারে কাঁদামাখা অবস্থায় ইলিয়াসকে মুক্তিযোদ্ধা কাইয়ুম ও আতাউর চিনতে পারেননি। তাঁরা ইলিয়াসকে শত্রুপক্ষের লোক মনে করে অস্ত্র তাঁক করে সারেন্ডার করতে বলেন। ইলিয়াসও তাদেরকে চিনতে পারেননি। তিনি মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য মনে করে গর্জে ওঠেন। তাঁর গলার স্বর চিনতে পেরে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের পরিচয় দেন। পরিচয় পেয়ে ইলিয়াস অন্যদের অবস্থান জানতে চাইলে তাঁরা জানান যে, ‘দাদা ও অন্যরা তোমার জন্য পিয়ারী বাবুর বাড়িতে অপেক্ষা করছে।’ তারা সেদিকে এগিয়ে যান। কিন্তু ততক্ষণে তাঁদের অবস্থান লক্ষ করে শত্রুরা গুলি করতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি করতে-করতে পিয়ারী বাবুর বাড়িতে যান। সেখান থেকে দ্রুত নৌকাঘাটে পৌঁছেন দাস পার্টির সদস্যরা। ঘাটে মাঝি নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। নৌকা ছাড়ার পূর্বে মুক্তিযোদ্ধারা কমান্ডার জগৎজ্যোতি ছাড়া স্থান ত্যাগে আপত্তি তোলেন। তাঁরা ইলিয়াসের কাছে জানতে চান কমান্ডারের অবস্থান। ইলিয়াস অত্যন্ত দুঃখ-ভারাক্রান্ত চিত্তে তাঁদের নির্মম সত্যটা জানান। কিন্তু কেউই তা বিশ্বাস করতে চাননি। যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তাঁদের মাথায়। ইলিয়াস তাঁদের মনের সন্দেহ দূর করার জন্য জ্যোতির অস্ত্রটি তাঁদের সামনে তুলে ধরেন।
সময় খুবই কম। এ-সময় তাদের আবেগ প্রকাশের সুযোগ ছিল না। দ্রুত নৌকা ছাড়ার নির্দেশ দেন ইলিয়াস। নৌকা ছেড়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা পেছনের দিকে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে এগিয়ে যান নিরাপদ স্থানের দিকে। নদী-হাওর পাড়ি দিয়ে জগৎজ্যোতি বিহীন দাস পার্টির সদস্যরা রাত ১০টার দিকে আইড়ামুগুরে পৌঁছেন। সেখানে কিছু সময় অবস্থান করে তাঁরা রওনা হন কুড়ির দিকে। ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে কুড়ি পৌঁছে যান দাস পার্টির সদস্যরা। কুড়ি থেকে বেতারযোগে বদলপুর যুদ্ধের রিপোর্ট টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে প্রেরণ করা হয়।
বীর সেনানী ইলিয়াস যথার্থ শ্রদ্ধায় তাঁর কমান্ডারের প্রাণহীন দেহটি কাঁদার মধ্যে লুকিয়ে রাখলেও পরে সে লাশ ভেসে ওঠে। জগৎজ্যোতির মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হানাদাররা হন্যে হয়ে তাঁর লাশ খুঁজছিল। এক সময় তারা পেয়ে যায় জগৎজ্যোতির নিথর দেহ। স্থানীয় রাজাকাররা তাঁর লাশ শনাক্ত করে। পাকসেনারা তাঁর লাশ বিলের পাড়ে তুলে আনার জন্য রাজাকারদের নির্দেশ দিয়ে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জগৎজ্যোতির মৃত্যু সংবাদ প্রেরণ করে। রাতেই স্থানীয় ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় লাশ। জগৎজ্যোতির প্রতি তাদের অসম্ভব ক্রোধ নিবারণ করতে না পেরে তারা প্রতিশোধ নিতে তাঁর প্রাণহীন দেহের ওপর চালায় পৈশাচিক নির্যাতন। তাতেও তাদের ক্রোধ মেটেনি। ভোর না হতেই পিশাচরা জগৎজ্যোতির লাশ নিয়ে আসে তাঁর গ্রামে। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে নৌকা ভিড়িয়ে কৌতূহলী জনতাকে লাশ দেখিয়ে তাদের ঘৃণা প্রকাশ করে।
দুঃসংবাদটা পৌঁছে জলসুখা গ্রামেও। জগৎজ্যোতির বাবা- মাকে কেউ পরিষ্কার করে কিছু বলে না। মা হরিমতি যখন ছেলের চিন্তায় পাগলপ্রায়, ঠিক তখনই রাজাকাররা আসে তাদের বাড়িতে। বলে, ‘তোমার ছেলেকে নিয়ে এসেছি! দেখবে এসো। কেঁপে ওঠে তাঁর বুক। হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসে। স্ত্রীকে নিয়ে নদীর ঘাটের দিকে কাঁপতে-কাঁপতে অগ্রসর হন জগৎজ্যোতির বাবা জীতেন্দ্র চন্দ্র দাস। সন্তানের মুখমণ্ডল দর্শন করে উন্মাদের মতো হয়ে যান অসহায় পিতা- মাতা। তাঁদের চোখের সামনেই নানা ভাষায়, নানা আচরণে পশুরা তাদের ক্ষোভ আর ঘৃণা প্রকাশ করে।
এদিকে জগৎজ্যোতির বাবা-মা পুত্রকে এক নজর দেখতে যাবার সঙ্গে-সঙ্গে রাজাকার দলের সদস্যরা তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। দাউ-দাউ করে জ্বলতে থাকে তাদের ঘরবাড়ি। এরপর রাজাকাররা তাঁর লাশ নিয়ে যায় আজমিরীগঞ্জ বাজারে। সেদিন ছিল ঈদের দিন। প্রচুর লোক সমাগম হয়েছিল বাজারে। হাজার-হাজার লোকের সামনে জগৎজ্যোতির নিশ্চল দেহ রাজাকাররা একটি বিদ্যুতের খুটির সঙ্গে বেঁধে রাখে সর্বসাধারণ্যে প্রদর্শনের জন্য। রাজাকাররা তিনদিন পর্যন্ত ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে নিষ্প্রাণ-নিথর প্রায় বিবস্ত্র দেহটিতে নির্মমভাবে নির্যাতন চালায়। অবশেষে তাঁর এই পরিণতির চিত্র ধরে রাখার লক্ষ্যে তারা জামালগঞ্জের জগৎজ্যোতির একটি ছবি তুলে রাখে। মৃত্যুর প্রায় ৭২ ঘণ্টা পরে তাঁর লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয় ভেড়ামোহনা নদীতে। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড