বীর উত্তম বদরুল আলম
বদরুল আলম, বীর উত্তম (জন্ম ১৯৪৮) বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৪৮ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কে এম বদরুদ্দোজা এবং মাতার নাম হোসনেয়ারা বেগম। ঢাকার হলিক্রস স্কুল ও লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনার পর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের মারিতে অবস্থিত পাকিস্তান এয়ার ফোর্স পাবলিক স্কুল (লোয়ার টোপা) থেকে ১৯৬৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৬ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ চলাকালে তিনি পাকিস্তান এয়ার ফোর্স ট্রেনিং একাডেমি (রিসালপুর) থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৮ সালের ২৮শে জানুয়ারি তিনি উক্ত ট্রেনিং একাডেমি থেকে কমিশন প্রাপ্ত হয়ে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে পাইলট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত পাকিস্তানের সারগোদা বিমান ঘাঁটিতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন। নিজের ইচ্ছায় তিনি বদলি হয়ে ২৮শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গণহত্যা আর নির্যাতন শুরু করলে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। ৬ই মে তিনি এ কে খন্দকার, বীর উত্তম, খাদেমুল বাশার, বীর উত্তম- ও পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রথম দিকে তিনি মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনীর বিমান উইং (বাংলাদেশ বিমান বাহিনী) গঠন করা হলে তিনি এতে যোগ দেন। এ বাহিনীকে সুসজ্জিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রয়োজনীয় বৈমানিক ও এয়ারম্যান রিক্রুট ও তাঁদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
ভারতের দেয়া একটি ডিসি-৩ ডাকোটা বিমান (যোধপুরের মহারাজার নিকট থেকে উপহার হিসেবে প্রাপ্ত), একটি অটার বিমান ও একটি এলুভেট হেলিকপ্টার নিয়ে ২৮শে সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর বিমান ঘাঁটিতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কার্যক্রম শুরু হয়। বদরুল আলমসহ এ বাহিনীতে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ৫৮ জন বাঙালি পাইলট ও টেকনিশিয়ান ছিলেন। ১লা অক্টোবর থেকে এ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ, মহড়া ও অনুশীলন শুরু হয়। বদরুল আলম ও তাঁর সহযোদ্ধাগণ জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে রাতের বেলা শুধু কম্পাসের ওপর নির্ভর করে বিমান নিয়ে আলোবিহীন রানওয়েতে অবতরণের মতো কঠিন প্রশিক্ষণ ও প্রক্রিয়া আয়ত্ত করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি ও কনভয়ের ওপর বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। সেসবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর জ্বালানি তেলের ডিপো আক্রমণ। ৩রা ডিসেম্বর মধ্যরাতে বদরুল আলম, সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তম ও সাহাবুদ্দিন আহমেদ, বীর উত্তম- ও দুজন টেকনিশিয়ান এলুভেট হেলিকপ্টার নিয়ে ডিমাপুর বিমান ঘাঁটি থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল ১৪টি রকেট ও একটি মেশিনগান। অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে নিচু দিয়ে চালিয়ে শত্রুসৈন্যদের রাডারকে ফাঁকি দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই তাঁরা গোদনাইল তেলের ডিপোতে বোমা নিক্ষেপ শুরু করেন। মুহূর্তের মধ্যে তেলের ডিপোগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার বদরুল আলমকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৬৮, খেতাবের সনদ নং ৬২)। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে তিনি তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন এবং পদোন্নতি পেয়ে স্কোয়াড্রন লিডার পদে উন্নীত হন। ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে তিনি বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণ করেন। তবে তাঁর অবসর গ্রহণ প্রক্রিয়া ১৯৮০ সালের মার্চ মাসে কার্যকর হয়। তিনি এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম নাদেরা আলম। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড