বনপাড়া ফৌতি গোরস্থান গণকবর (জামালপুর সদর)
বনপাড়া ফৌতি গোরস্থান গণকবর (জামালপুর সদর) জামালপুর সদরে অবস্থিত। আলবদর বাহিনীর সদস্যরা শহরের বহু প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এবং আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ- ও ছাত্র ইউনিয়ন-এর নেতা-কর্মীদের এখানে কবর দেয়। জামালপুর জেলা সদরের দক্ষিণ-পশ্চিমে বনপাড়ায় ফৌতি গোরস্থানের অবস্থান। জেলা শহরের কেন্দ্রীয় গোরস্থান- সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে এটি অবস্থিত। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকেই ফৌতি গোরস্থানটি ছিল। এ গোরস্থানে সাধারণত শহরের বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হতো।
ফৌতি গোরস্থান থেকে স্বল্প দূরে পূর্বদিকে জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের অবস্থান। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসর আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ছিল আশেক মাহমুদ কলেজের ডিগ্রি হোস্টেলে। আলবদর বাহিনীর এ ক্যাম্পটি নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বিশেষ করে এ বাহিনীর কিলিং স্কোয়াডের সদস্যরা শহরের প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ব্যক্তিবর্গ, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এবং আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের এ হোস্টেলে ধরে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করত। শুধু জামালপুর শহরের লোকজনই নয়, আশপাশের এলাকা থেকেও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ধরে এনে তাদের ওপর দিনের পর দিন অমানুষিক নির্যাতন চালাত। তাদের নির্যাতনে বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করে। অনেককে তারা জবাই করে হত্যা করে।
এই নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছে আশরাফ হোসাইন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী, মোতাহার হোসেন, মো. হারুন, মো. হাশেম, আব্দুল বাকী, লুৎফর, আজাদ, মাহবুব প্রমুখ আলবদর বাহিনীর কুখ্যাত সদস্যরা। যুদ্ধের নয় মাস ধরেই আশেক মাহমুদ কলেজের ডিগ্রি হোস্টেলে আলবদর বাহিনী কর্তৃক বহু নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এ বর্বর বাহিনীর নির্যাতনে যারা মারা যেত তাদেরকে টেনে-হিচঁড়ে নিয়ে আসা হতো ফৌতি গোরস্থানে। এরপর সেখানে গর্ত করে মৃতদেহগুলো মাটিচাপা দেয়া হতো। ফলে ফৌতি গোরস্থানের আশপাশের শেয়াল-কুকুররা মাটি খুঁড়ে এসব মৃতদেহ তুলে খেতো। আলবদররা কখনো লাশ মাটিচাপা না দিয়ে গোরস্থানে ফেলে রেখে যেত। যুদ্ধের নয় মাস ধরেই এখানে এই বীভৎসতা সংঘটিত হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য থেকে জানা যায় যে, বনপাড়া এলাকায় সে- সময় মানুষের বিচ্ছিন্ন হাত, পা বা মাথার খুলি নিয়ে দিনে- দুপুরে কুকুরদের ছুটাছুটি করতে দেখা যেত।
শহরের চামড়াগুদাম রোডের আমজাদ হোসেনকে (ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য) আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায় আশেক মাহমুদ কলেজের ডিগ্রি হোস্টেলে। তার ওপর আলবদররা নির্মম নির্যাতন চালায় এবং বেয়নেট চার্জ করে। এতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে মৃতের মতো পড়ে থাকেন। এরপর আলবদররা আরো অনেকের মৃতদেহের সঙ্গে তাকে ফৌতি গোরস্থানে ফেলে দিয়ে আসে। কিন্তু আমজাদ হোসেন নির্যাতনের স্বাক্ষী হয়ে অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে যান। এক সময় তার জ্ঞান ফিরে আসে এবং তিনি দেখেন লাশের স্তূপের ওপর তিনি পড়ে আছেন। পরে কোনোভাবে সেখান থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন এবং গোপনে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন।
১১ই ডিসেম্বর জামালপুর হানাদারমুক্ত হলে ফৌতি গোরস্থানে ছোট-বড় নানা আকারের কবরের মতো অগভীর গর্তের সন্ধান পাওয়া যায়। জামালপুরবাসী জানতে পারে যুদ্ধের নয় মাস আলবদর বাহিনী বহু মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে এখানে কবরস্থ করে। সেই থেকে ফৌতি গোরস্থান একাত্তরের গণকবর হিসেবে অভিহিত হয়ে আসছে। [আহমদ আজিজ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড