You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বড়লেখা উপজেলা (মৌলভীবাজার)

বড়লেখা উপজেলা (মৌলভীবাজার) একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা। এ উপজেলার পূর্বে ভারতের আসাম রাজ্য। ১৯৭১ সালে জুড়ী বড়লেখার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে জুড়ী আলাদা উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বড়লেখা-কুলাউড়া থেকে আওয়ামী লীগ-এর প্রার্থী আব্দুল মুন্তাকিম চৌধুরী এমএনএ এবং তাইমুছ আলী এমপিএ নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করায় সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সারাদেশের মতো বড়লেখায়ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর বড়লেখায় আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে। মার্চ মাসের প্রতিদিনই বড়লেখার কোনো-না-কোনো স্থানে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল হয়৷
তাইমুছ আলী এমপিএ এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলামকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে বড়লেখা উপজেলায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। তাঁদের তত্ত্বাবধানে ইউনিয়ন ও গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। বড়লেখা উপজেলা সংগ্রাম কমিটির তত্ত্বাবধানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। বড়লেখা সদরের আজাদ চৌধুরীর পরিত্যক্ত বাড়িতে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য আব্দুল খালিকের (নিজবাহাদুরপুর) নেতৃত্বে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু হয়। সাবেক আনসার কমান্ডার আকদ্দছ আলী চৌধুরী, মো. মুবাশ্বির আলী, মো. শামসুল আলম চৌধুরী, মো. মন্তজির আলী, আব্দুল মান্নান, আনসার কমান্ডার মস্তকিন আলী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এছাড়া বড়লেখা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত দারোগা সিকিম আলী, সাব-রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক, খালেদ মিয়া, ডা. অমরেন্দ্র দত্ত, ডা. আব্দুল খালিক, ডা. মকরম আলী, ডা. এম এ শুকুর, ইপিআর সুবেদার মতিউর রহমান, ল্যান্স নায়েক আব্দুল ওয়াহাব, ঈমান উদ্দিন আহমদ, মো. সিরাজ উদ্দিন, শফিক উদ্দিন আহমদ, বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত সদস্য আব্দুল আজিজ পিয়ার, নজমুল ইসলাম কেদই মিয়া, গিয়াস উদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ আবদুল গনি, মখলিসুর রহমান, আপ্তাব উদ্দিন, সমরেন্দ্র কুমার দাস, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর আব্দুল আহাদ চৌধুরী প্রমুখ প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করেন। বড়লেখার উত্তর প্রান্তে শাহবাজপুরে গঠিত সংগ্রাম কমিটি খুবই সক্রিয় ও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে। এ কমিটি মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য এখানকার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। তাইমুছ আলী এমপিএ শাহবাজপুরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, শাহবাজপুরে পাকবাহিনী পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করায় সাধারণ মানুষ অবর্ণনীয় দুর্দশা ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় আশ্রয় শাহবাজপুর গ্রহণ করে। ছাত্র-যুবকরা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
বড়লেখা উপজেলা সদরে আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ, নতুনদের রিক্রুট এবং সার্বিক পরিস্থিতির সমন্বয় করেন। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন মো. সিরাজুল ইসলাম ও মন্তজির আলী। ডা. অমরেন্দ্র দত্ত ও আকদ্দছ আলী ছাত্র- যুবকদের যুদ্ধে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেন।
ছাত্রলীগ-এর কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে ৯ই মার্চ কয়েকটি একনলা ও দুনলা বন্দুক নিয়ে আজাদ চৌধুরীর বাড়িতে প্রশিক্ষণ শুরু করে। সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডারদের নেতৃত্বে এ প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তখন প্রশিক্ষণার্থীদের হাতে তেমন কোনো অস্ত্র না থাকায় অস্ত্র সংগ্রহের মূল দায়িত্ব মো. সিরাজুল ইসলামকে দেয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস- এর বিদ্রোহী সদস্যদের মাধ্যমে তিনি ভারতের বিএসএফ- এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিএসএফ অধিনায়ক কর্নেল লিমাইয়া, ব্রিগেডিয়ার বাওয়া এবং অন্যদের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক পাল্লাতল চা-বাগান ও মদনপুর চা-বাগানের মধ্যবর্তী স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। বিএসএফ-এর সঙ্গে এরপর আরো কয়েকটি বৈঠক হয়। শেষ বৈঠকে মুক্তিবাহিনীর চিফ অব স্টাফ কর্নেল আব্দুর রব (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল), আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী- এমএনএ (স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মন্ত্রী), আব্দুর রহিম এমএনএ, ইসমত আহমদ চৌধুরী (পরবর্তীকালে সংসদ সদস্য), কাজী আবু তাহের, ফালাহ উদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম চৌধুরী আমান, আব্দুল মান্নান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, ভারতীয়দের পক্ষ থেকে। হাতবোমা, পেট্রল, জ্বালানি, হালকা অস্ত্র ইত্যাদি মো. সিরাজুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হবে। ভারত থেকে সহজে অস্ত্র ও মালামাল আনার জন্য পাল্লাতল চা-বাগানের ভেতর দিয়ে একটি রাস্তা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। বাগানের কর্মকর্তা সুধন্য শর্মা, ডা. ইন্দ্রভূষণ দত্ত, বারী মিয়া ও কাজী আবু তাহেরকে এ রাস্তা তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। তাঁদের অবিশ্বাস্য কর্মতৎপরতায় মাত্র তিনদিনে রাস্তা তৈরি হয়। চা-শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিনরাত খেটে কাজ সমাপ্ত করে। পাল্লাতল ও মদনপুর চা-বাগানের মধ্যবর্তী স্থানে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর বিএসএফ-এর তত্ত্বাবধান ও সহযোগিতায় ভারতের বিলবাড়িতে ছাত্র-তরুণদের ২২ সদস্যের একটি দলের রাইফেল ও হালকা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ শুরু করে। ১লা এপ্রিল এ প্রশিক্ষণ শুরু হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ভারতের মাটিতে এ দল সর্বপ্রথম প্রশিক্ষণ গ্রহণের গৌরব অর্জন করে। ২২ সদস্যের দলে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন কাঁঠালতলীর মো. সিরাজ উদ্দিন, আবুল হোসেন, জমির উদ্দিন, নুরুজ আলী, আব্দুল লতিফ প্রমুখ। আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম বড়লেখা, মৌলভীবাজার ও কুলাউড়ার অনেক যুবককে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য ভারতের বিলবাড়ির প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রেরণ করেন।
বড়লেখার হাকালুকিতে ২৮শে মার্চ থেকে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু হয়। হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শুরু হওয়া এ ক্যাম্প দুদিন স্থায়ী ছিল। ১৫ জন তরুণ এখানে প্রশিক্ষণ নেয়। বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম ও সাহসী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
ছাত্রলীগ নেতা মো. সিরাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে ১০ই মার্চ থেকে কাঁঠালতলীতে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু হয়। এটি ৩০শে মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত হয়। শিমুলিয়া পাঁচ পীর মোকামের পশ্চিমের টিলায় স্থাপিত এ ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন সুবেদার খলিল উদ্দিন ও নায়েক ফাত্তাহ মিয়া।
তাইমুছ আলী এমপিএ ধর্মনগর শিবির প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর এ সরকারের তত্ত্বাবধানে ধর্মনগর শিবির পরিচালিত হতো। বড়লেখায় প্রতিরোধযুদ্ধের কেন্দ্রভূমি ছিল শাহবাজপুর। এখানে থেমে-থেমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র-জনতার সঙ্গে পাকহানাদারদের বহুবার যুদ্ধ হয়। কখনো স্বাধীনতাকামী মানুষ আবার কখনো পাকহানাদারদের নিয়ন্ত্রণে ছিল শাহবাজপুর। ২৬শে মার্চ হাজার-হাজার মানুষ বাঁশের লাঠি হাতে মিছিল নিয়ে শাহবাজপুর স্টেশন বাজারে সমবেত হয়। বিক্ষুব্ধ জনতার এ মিছিলে নেতৃত্ব দেন এডভোকেট তবারক হোসাইন, মুহাম্মদ আবদুল গণি, আরকান আলী, খলিলুর রহমান, ডা. আব্দুল খালিক, কাজী আবু তাহের, মঈন উদ্দিন আহমদ (পরবর্তীকালে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান), আব্দুল কুদ্দুস, আব্দুল মতিন, মকদ্দছ আলী, নাজমুল ইসলাম লাকী প্রমুখ।
ঢাকায় গণহত্যার সংবাদ শাহবাজপুরে ছড়িয়ে পড়লে ২৭শে মার্চ বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিল নিয়ে শাহবাজপুর স্টেশন বাজারে সমবেত হয়। বিকেল ৪টায় বহু মানুষ শাহবাজপুরে শত্রুবাহিনীর সম্ভাব্য প্রবেশপথে অবরোধ তৈরি করে। শত্রুদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে বিক্ষুব্ধ জনতা সিএন্ডবি-র নান্দুয়া মুখে মাটি কেটে গোটা রাস্তা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এর ফলে শাহবাজপুর প্রবেশের দক্ষিণ প্রান্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রেলস্টেশনের পাশে সিএন্ডবি-র রাস্তাও মাটি কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
পাকিস্তানিদের বর্বরতা ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে শাহবাজপুরের মানুষ ঘৃণায় ও তীব্র আক্রোশে ফুঁসছিল। ঢাকায় গণহত্যার সংবাদ এখানে পৌঁছলে ইপিআর-এর ৪ জন অবাঙালি সদস্য বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রমণে প্রাণ হারায়। বোবারতল ইপিআর ক্যাম্পের অবাঙালি সদস্যরা গণরোষ থেকে আত্মরক্ষার জন্য পাহাড়ি পথে পালাতে শুরু করলে বাঙালি জওয়ান ও জনতার বাধার মুখে পড়ে। কেউ-কেউ গ্রেফতার হয়। জনতার হাতে গ্রেফতারকৃত ২ জন অবাঙালি জওয়ানকে পাল্লাতল চা- বাগানের খাসিয়াপুঞ্জিতে নেয়া হয়। এখানে তারা বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে নিহত হয়।
২৭শে মার্চ দক্ষিণভাগের ছাত্র-জনতা পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে প্রবেশমুখে ব্যারিকেড স্থাপন করে। গাছ, পাথর, ইট স্তূপীকৃত করে বিশাল প্রতিবন্ধক বসানো হয়। তারপর শতশত মানুষের উপস্থিতিতে সমাবেশ চলতে থাকে। শেরপুরে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে বড়লেখা উপজেলার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। কাঁঠালতলীতে শতাধিক মানুষ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিক্ষুব্ধ জনতা ইপিআর ক্যাম্পের অবাঙালি জওয়ানদের আক্রমণ করে। কিন্তু তারা পূর্বেই গা ঢাকা দিয়ে আত্মরক্ষা করে। এলাকায় যাতে পাকিস্তানি হানাদাররা প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য জনতা প্রতিরাতে রাস্তায় পাহারা ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করে।
পাকবাহিনী ৭ই মে বড়লেখায় অনুপ্রবেশ করে। তারা বড়লেখা সদর, কাঠালতলী, সুজাউল আলিয়া মাদ্রাসা, শাহবাজপুর ইপিআর, ছোটলেখা ও দৌলতপুর মাদ্রাসায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ-এর নেতৃত্বে বড়লেখায় রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। বড়লেখা উপজেলা সদরে শান্তি কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করে সৈয়দ শামসুদ্দিন হোসেনী। যুগ্ম-আহ্বায়ক হয় আক্কাস উদ্দিন সরকার। গ্রামে-গ্রামে এদের তৎপরতা বিস্তৃত ছিল। সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিরা স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে যুক্ত হয়। দালালদের অনেকে পাকিস্তানি হানাদারদের চেয়েও ভয়ংকর ছিল। বড়লেখায় সংঘটিত সকল অপকর্মের সঙ্গে এরা জড়িত ছিল। বড়লেখায় দালালের সংখ্যা ছিল দুই শতাধিক। এসব দালালের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করেন। জনতার প্রতিরোধে অন্তত ১০ জন দালাল প্রাণ হারায়।
বড়লেখার বিভিন্ন ইউনিয়নে যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তারা হলেন- বর্ণি ইউনিয়ন: মো. আব্দুল মালিক (পিতা জহির আলী, সৎপুর, বয়স ১২ বছর; মালাম বিল অপারেশন চলাকালে ক্রসফায়ারে বাড়ির আঙ্গিনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত) এবং নলজোয়ার গ্রামের সিকন্দর আলীর ৮ বছরের ছেলে (মাইন বিস্ফোরণে নিহত)।
দাশেরবাজার ইউনিয়ন: কুনু মিয়া (লঘাটি; দাশেরবাজার বধ্যভূমিতে পাকহানাদাররা গুলি করে হত্যা করে), গোপেন্দ্র নাথ (তালুকদারপাড়া; দাশেরবাজার বধ্যভূমিতে পাকহানাদারদের হাতে নিহত), প্রজেশ নাথ (তালুকদারপাড়া; দাশেরবাজার বধ্যভূমিতে পাকহানাদারদের হাতে নিহত), জহর লাল (দক্ষিণ লঘাটি; দাশেরবাজার বধ্যভূমিতে পাকহানাদারদের হাতে নিহত), ডা. নৃপেন্দ্ৰ দাশ (গুলুয়া; সুনাই নদীর তীরে হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে) এবং গোবিন্দপুর গ্রামের একজন কলেজ ছাত্র।
নিজবাহাদুরপুর ইউনিয়ন: ডা. আব্দুন নূর (দৌলতপুর; রাজাকার কর্তৃক ধৃত হয়ে শাহবাজপুর পাকিস্তানি ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়; শাহবাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের টিলার উত্তর-পশ্চিম পার্শ্বে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে হানাদাররা) ও ইয়াকুব আলী (কান্দিগ্রাম; রাজাকারের গুলিতে মুন্সিবাজারে নিহত)।
উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন: জমির মিয়া (পিতা জড়াই মিয়া; পাবিজুরিপার, শাহবাজপুর উচ্চবিদ্যালয় ক্যাম্পে হানাদারদের গুলিতে নিহত), ইসাদ আলী (পাবিজুরিপার; শাহবাজপুর উচ্চবিদ্যালয় ক্যাম্পে হানাদারদের গুলিতে নিহত), হারি মিয়া (পিতা ইসাদ আলী, পাবিজুরিপার; শাহবাজপুর উচ্চবিদ্যালয় ক্যাম্পে হানাদারদের গুলিতে নিহত), তোতা মিয়া (পিতা ইরছাক আলী, পাবিজুরিপার; শাহবাজপুর উচ্চবিদ্যালয় ক্যাম্পে হানাদারদের গুলিতে নিহত), মো. লালচান মিয়া (পিতা জমির মিয়া, পাবিজুরিপার; শাহবাজপুর উচ্চবিদ্যালয় ক্যাম্পে হানাদারদের হাতে নিহত), মতিউর রহমান (পিতা আব্দুল লতিফ, নয়াগ্রাম; শাহবাজপুর উচ্চবিদ্যালয় ক্যাম্পে হানাদারদের গুলিতে নিহত), মাখন মিয়া, (পিতা তৈমুছ মিয়া, আলাপুর; শাহবাজপুর উচ্চবিদ্যালয় ক্যাম্পে হানাদারদের হাতে নিহত), ইনছান আলী (কুমারশাইল), খুরসেদ আলী (কুমারশাইল), শশাঙ্ক কুমার চন্দ্র (কুমারশাইল), আব্দুল মিয়া (কুমারশাইল; হানাদারদের পোঁতা মাইন বিস্ফোরণে নিজ বাড়িতে নিহত) এবং আব্দুল মতিন (শাহবাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক; রাজাকারদের হাতে নিহত)।
দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়ন: বলাই দাস (গ্রাম ঘোলসা; বড়লেখা উপজেলা চত্বর বধ্যভূমিতে তাকে হত্যা করে পাকবাহিনী), হরি দাস (ঘোলসা; জুড়ী বধ্যভূমিতে পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত), হীরেন্দ্র নাথ দাস (পিতা সুরেন্দ্র নাথ দাস, ঘোলসা; খাগালা বধ্যভূমিতে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত), কুটিন্দ্র মোহন দাস (পিতা ধনরাম দাস, ঘোলসা; ঘোলসা বধ্যভূমিতে নিহত), বারীন্দ্র মোহন দাস (পিতা আনাইরাম দাস, ঘোলসা; খাগালা বধ্যভূমিতে নিহত), মনিন্দ্র কুমার দাস (পিতা মহেন্দ্র কুমার দাস, ঘোলসা; খাগালা বধ্যভূমিতে নিহত)।
বড়লেখা সদর ইউনিয়ন: জহির আলী (পানিধার; বড়লেখা হাজিগঞ্জবাজার জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে হানাদারদের গুলিতে নিহত) ও ইব্রাহিম আলী ওঁঝা (বোবারতল; বড়লেখা হাজিগঞ্জবাজার জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে হানাদারদের গুলিতে নিহত)।
দক্ষিভাগ উত্তর ইউনিয়ন: লক্ষ্মীছড়া চা-শ্রমিকদের পঞ্চায়েত সর্দার নিকুঞ্জ বিহারী, ভগীরথ, তাঁর ছেলে ব্রজেন্দ্র এবং নাগা- সহ মোট ৭ জন চা-শ্রমিক রশিদাবাদ বাগানে হানাদারদের হাতে নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ড রশিদাবাদ গণহত্যা নামে পরিচিত। এছাড়া মাহমুদ আলী (গৌরনগর; পাকহানাদারদের গুলিতে নিজ বাড়িতে নিহত), মাহমুদ আলীর এক পুত্র ও এক কন্যা (গৌরনগর; পাকহানাদারদের গুলিতে নিজ বাড়িতে নিহত)। কাঁঠালতলি বাজারের কুটই মিয়া চট্টগ্রামে পাকহানাদারদের গুলিতে প্রাণ হারান।
দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়ন: শফিকুর রব (দক্ষিণভাগ; জুড়ী বধ্যভূমিতে নিহত), বেনু চন্দ্র (হরিপুর; হানাদার কর্তৃক নিজ বাড়িতে নিহত), সুবল দাশ (চা-শ্রমিক, রশিদাবাদ চা- বাগান; হানাদারদের গুলিতে নিহত) ও আপনা ড্রাইভার (সমনবাগ চা-বাগানের শ্রমিক; মাইন বিস্ফোরণে নিহত)। সুজানগর ইউনিয়ন: রাজেন্দ্র দাস (সালদিগা; রাজাকার কর্তৃক ধৃত হয়ে পাকহানাদারদের হাতে খাগটেকা আখড়ার পূর্বপার্শ্বে নিহত), সাদউদ্দিন (পিতা হাফিজউদ্দিন, সালদিগা; মুক্তিযুদ্ধকালে নিরুদ্দেশ হন), আছবর আলী গিলা (পিতা বিলাল মিয়া, সালদিগা; হানাদারদের হাতে নির্যাতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন)।
তালিমপুর ইউনিয়ন: নগেন্দ্র কুমার দাস (পিতা বৃন্দাবন দাস, দ্বিতীয়ারদেহী) দাশেরবাজার বধ্যভূমিতে পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে নিহত হন।
বড়লেখা উপজেলার অনেক নারী পাকবাহিনী ও রাজাকারদের দ্বারা নির্যাতিত ও পাশবিক অত্যাচারের শিকার হন। বর্ণি ইউনিয়নের পাকশাইল গ্রামের একজন শিক্ষকের স্ত্রী চান্দগ্রামের নিকটবর্তী স্থানে পাকসেনাদের হাতে লাঞ্ছিত হন। দাশেরবাজার ইউনিয়নের গোবিন্দপুরের এক যুবতীকে পাকিস্তানি সেনারা ধর্ষণ করে। দক্ষিণ লঘাটি গ্রামেও নারী ধর্ষণের কয়েকটি ঘটনা ঘটে। তাতে এক দালাল তাদের সহযোগিতা করে। উত্তর লঘাটি গ্রামের একজন নারী পাকবাহিনীর হাতে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। নিজবাহাদুর ইউনিয়নের বাগাডহর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু যারা বাড়িঘর ছেড়ে যায়নি, তাদের নানাভাবে চরম মূল্য দিতে হয়। এ গ্রামের অর্চনা রাণী দাস ও অপর দুই নারী রাজাকারদের হাতে সম্ভ্রম হারান। পকুয়ার শুক্লা দেবী পাকবাহিনীর বীভৎস যৌন পীড়নের শিকার হন। দৌলতপুরবাজার পাকিস্তানি ক্যাম্পের ক্যাপ্টেনের নারীভোগের জন্য শুক্লা দেবীকে হাজির করা হতো। টানা পাঁচ মাস তিনি এ ক্যাম্পে ধর্ষিত হন। এ গ্রামের এক নবপরিণীতা স্ত্রী অসহায় স্বামীর চোখের সামনে সম্ভ্রমহানির শিকার হন।
মে মাসে বাহাদুরপুরের জয়নব বিবি ও ছালই বিবি রাজাকারদের দ্বারা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। শাহবাজপুরে ইপিআর ক্যাম্পে নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনে নেতৃত্ব দেয় পাকিস্তানি মেজর আজম খান। তাকে সহযোগিতা করে এক স্থানীয় দালাল। ফাতিমা বেগম (ভুগা) নামে এক নারী জুলাই মাসে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধর্ষিত হন। এ মাসে নান্দুয়া গ্রামে ৩ পাকিস্তানি সেনা আসে। তারা আমিরুন নেছা নামে এক নারীকে ধর্ষণ করে। বারইগ্রামে এক অভিজাত হিন্দু পরিবার ও একটি মুসলিম পরিবারের দুই নারী সম্ভ্রম হারান। ইনাইনগর গ্রাম উপজেলা সদরের অনতিদূরে। এ গ্রামের একজন শিক্ষিত মুসলিম গৃহবধূ পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা ধর্ষিত হন। আহমদপুর গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। পরিবারটির তরুণী গৃহবধূর ওপর পাকিস্তানি হায়েনারা হামলে পড়ে।
পাকিস্তানি হানাদারদের নিপীড়নের শিকার একটি গ্রাম পাখিয়ালা। এ গ্রামের এক শিক্ষিত ব্যক্তির স্ত্রী সম্ভ্রম হারান। দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়নের শিমুলিয়া গ্রামে অনেক হিন্দু পরিবারের বাস ছিল। স্থানীয় দালালরা পাকসেনাদের এ গ্রামে নিয়ে আসে। অনেক পরিবারের সঙ্গে একটি অভিজাত পরিবারের কয়েকজন মহিলাকে বাড়িতেই হানাদাররা ধর্ষণ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটককৃত এক দালাল ৫৫টি ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। দালালরা নিজেদের প্রতিবেশী ও পরিচিত নারীদেরও পাকসেনাদের ক্যাম্পে যেতে বাধ্য করত। মুক্তিযুদ্ধে নিহত জনৈক ব্যক্তির স্ত্রীকে এক রাজাকার পাকক্যাম্পে হাজির করত। মুক্তিযোদ্ধারা গৌরনগর এলাকায় শত্রুদের একটি ট্রাক্টর গুঁড়িয়ে দিলে পাক-হানাদাররা আশপাশের এলাকায় চড়াও হয় এবং বিভিন্ন বাড়িতে নারীদের ধর্ষণ করে। দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়নে প্রতিটি পাড়ায় ধর্ষণের লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে। রশিদাবাদ ও সমনভাগ চা-বাগানে নারীরা গণহারে ধর্ষিত হন। সুজানগর ইউনিয়নের চিন্তাপুর গ্রামের এক যুবতী গৃহবধূকে রাজাকারদের সহায়তার পাক-হানাদাররা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তালিমপুর ইউনিয়নের টেকাহালির জনৈক ব্যক্তির নবপরিণীতা স্ত্রীকে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক- হানাদাররা বড়লেখা ক্যাম্পে নিয়ে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বড়লেখার গ্রামে-গ্রামে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা অকথ্য নির্যাতন চালায়। অনেকে বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ এদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির-এ আশ্রয় নেয়। এখানে লুটপাটের অসংখ্য ঘটনা ঘটে। পাড়ায়-পাড়ায় অর্থ, স্বর্ণালংকার, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি এবং বিভিন্ন রকমের ফসল অবাধে পাকসেনা ও রাজাকাররা লুণ্ঠন করে। অনেক বাড়িতে তারা অগ্নিসংযোগ করে।
পানিসাওয়া গ্রামের শতভাগ লোকই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। এ গ্রামে পাকিস্তানি হানাদাররা ভয়াবহ নির্যাতন ও লুণ্ঠন চালায়। গ্রামের দ্বিজেন্দ্র ও গোপেন্দ্র নামে দুজনের ওপর ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। পরবর্তীকালে এরা আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেননি। পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার শিকার পানিসাওয়া গ্রামের আরেক হতভাগ্য ব্যক্তি দারিকা দাশ। বর্বর পাকসেনারা তার ওপর নৃশংস অত্যাচার চালায়। মৃতপ্রায় অবস্থায় তাঁকে পাওয়া যায়। অহিরকুঞ্জি গ্রামের কেউ একাত্তরে দেশে ছিল না। গ্রামের মানুষের অবর্তমানে দালালরা তাদের বাড়িঘরে অবাধ লুটপাট চালায়।
লঘাটি ও গোবিন্দপুর গ্রামেও পাকসেনারা তাণ্ডব চালায়। পানিশাইল গ্রামের কোনো মানুষ যুদ্ধের সময় বাড়িতে ছিল না। তারা ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। অনাহারে অসুস্থতায় এ গ্রামের অনেকে সেখানে মারা যায়। রাজাকারদের হাতে উত্তর লঘাটি গ্রামের জহর আলী চরম নির্যাতনের শিকার হন। তাকে রাজাকাররা রাস্তা থেকে তুলে বড়লেখা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরদিন অর্ধমৃত অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়।
দালালদের তৎপরতায় বাগাডহর গ্রামে অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতন চলে। মিহির কান্তি পালের পিতামাতার ওপর পাক হানাদাররা অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালায়।
কবিরা গ্রামের মকই মিয়া রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লে তাকে বেদম মারপিট করা হয়। তার বাড়ির ধানের গোলায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। পকুয়া গ্রামের ছকই মিয়াকে পাকিস্তানি হানাদাররা বাড়ির একটি গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করে। এ গ্রামের আওয়ামী লীগ সমর্থক আয়াজ আলীকেও তারা গাছে ঝুলিয়ে নৃশংস অত্যাচার করে। গল্লাসাংগন গ্রামের আব্দুল জব্বার বড়লেখা উপজেলা সদর ক্যাম্পে নির্যাতিত হন। তাকে মাটিতে ফেলে বুটের নিচে পিষ্ট করা হয়। চান্দগ্রামের সুলেমান মিয়া পাক-হানাদারদের হাতে নির্যাতিত ও আহত হন। নিজবাহাদুরপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সমছুল হক সম্মুখ যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন। অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত শমসেরনগর বিমানঘাঁটির দক্ষিণ পাশের যুদ্ধে সমছুল হক বাম হাত ও বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের নির্যাতনে শাহবাজপুর ইউনিয়নের অনেকে স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। শাহবাজপুরের অনেক স্থানে মাইন পোঁতা ছিল। এসবের শিকার হয়েছে অনেক মানুষ। কুমারশাইল গ্রামের ছনখলা নামক স্থানে পোঁতা একটি মাইন বিস্ফোরণে আব্দুর রাজ্জাকের একটি পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
কুমারশাইল গ্রামের আপ্তাব আলী, শ্রীধরপুর গ্রামের নুর উদ্দিন পার্শ্ববর্তী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে খাবার সরবরাহ করার সময় পাকবাহিনী বৈরাগী টিলা থেকে মর্টার শেলিং করে। এতে তারা মারাত্মকভাবে আহত হন।
শাহবাজপুরে গণহারে হত্যা ও নির্যাতন চলে। এখানে বেশ কয়েকটি হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রাম ছিল। সেসব গ্রাম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের প্রধান টার্গেট ছিল। হিন্দুরা গ্রাম ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিলে হানাদাররা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। সায়পুর, ভুগা, চানপুর, করমপুর ইত্যাদি গ্রামের অনেক বাড়ি-ঘরের টিন ও দরজা-জানালা রাজাকাররা খুলে নেয়। এগুলো দিয়ে তারা বাংকারের চালা, দরজা, জানালা তৈরি করে। পাল্লাতল, অহিদাবাদ, কুমারশাইল প্রভৃতি চা-বাগান হানাদার বাহিনীর শেলিংয়ে ধ্বংস হয়। কুমারশাইল বাগানের ম্যানাজারের বাংলো শেলিং-এ বিধ্বস্ত হয়। চা-শ্রমিকদের অনেকে জীবন বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
শাহবাজপুরের বিভিন্ন স্থানে পাকহানাদার ও তাদের সহযোগীদের অগ্নিসংযোগে কোটি টাকার সম্পদহানি ঘটে। এ এলাকায় অবাধে লুটপাট চলে। প্রতিদিন বিভিন্ন অভিযোগে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা অনেককে ধরে আনত। তাদের দিনের পর দিন আটকে রেখে নির্যাতন চালাত। শাহবাজপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও শাহবাজপুর জনমিলন কেন্দ্র হানাদারদের মর্টার শেলিং-এ ধ্বংস হয়। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য নিরীহ মানুষদের বন-জঙ্গল ও ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে বাধ্য করত। গেরিলারা যাতে ক্রলিং করে এসে আক্রমণ চালাতে না পারেন সেজন্য তারা মাটিতে ধারালো বাঁশ পুঁততেও অনেক নিরীহ মানুষকে বাধ্য করত।
দালালদের প্ররোচনায় পাকসেনারা ওজানীপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রৌফের পিতার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। এজন্য যুদ্ধের পুরো সময় তিনি গা-ঢাকা দিয়ে জীবন রক্ষা করেন। রাজাকাররা তার বাড়িতে একাধিকবার হামলা করে। যুদ্ধের শুরুতে পাক-হানাদাররা দক্ষিণ শাহবাজপুরে তাণ্ডব চালায়। রামচন্দ্রপুর গ্রামের জমির আলী হানাদারদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে একটি পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। দেউল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালিক মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে গোপনে বাড়িতে আসেন। স্থানীয় রাজাকাররা এ সংবাদ পাকসেনাদের জানায় এবং তিনি ধরা পড়েন। বড়লেখা ক্যাম্পে নিয়ে পাকসেনারা আব্দুল খালিকের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। মৃতপ্রায় অবস্থায় ছাড়া পেলেও অত্যাচারে মারাত্মক আহত হয়ে তিনি আর যুদ্ধে যোগ দিতে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগে বিছরাবন্দ গ্রামের আব্দুল লতিফ মেম্বার ও তার ভাইকে রাজাকাররা আটক করে শাহবাজপুর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এক সপ্তাহ ধরে তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। আরজ আলী মেম্বারের এক ভাইয়ের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এ কারণে তাকে আটক করে রাজাকাররা শাহবাজপুর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এক সপ্তাহ ধরে তার ওপর তারা নির্যাতন চালায়।
দেউল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল সোহাগের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের পাকসেনারা সুজাউল মাদ্রাসা ক্যাম্পে নিয়ে একাধিকবার নির্যাতন করে। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম বা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা যাদের ছিল, তারা সবাই পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়। মোহাম্মদনগর গ্রামের আছদ্দর আলী এবং মছদ্দর আলী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন বলে তাদের আটক করা হয়। ছোটলেখা পাকক্যাম্পে তাদের ওপর চরম বর্বরতা চালানো হয়। কেছরিগুল গ্রামের সাবেক আনসার কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা হবিব আলী (মোকাম টিলাযুদ্ধে আহত)-র পিতা ও ছোটভাই মুহিব আলীকে রাজাকারদের সহায়তায় পাকসেনারা আটক করে তাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। এ অত্যাচারে মুহিব আলীর মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটে। হানাদাররা এতেও ক্ষান্ত হয়নি, তারা তাদের বাড়ি পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দেয়।
বারইপাড়া (কায়স্থ শাসন), চণ্ডিনগর, সুয়ারতল, ঘোলসা প্রভৃতি গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের যেসব মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের বাড়িতে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা অবাধে লুণ্ঠন চালায়। গ্রামতলা গ্রামের ছয়াব আলীর ওপর রাজাকারদের প্ররোচনায় পাকিস্তানি হানাদাররা পৈশাচিক তাণ্ডব চালায়। ষাটমা ব্রিজ অপারেশন শেষে মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়িতে কিছু সময় অবস্থান করেন। ছয়াব আলী মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থাও করেন। দালালরা এ খবর পাকিস্তানি ক্যাম্পে পৌঁছালে ছয়াব আলীকে আটক করে তার ওপর পাকসেনারা অকথ্য নির্যাতন করে।
ইনাইনগর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মস্তকিন আলীর পরিবার পাকবাহিনী ও রাজাকারদের নির্যাতনের শিকার হয়। হানাদাররা তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। এ পরিবারের অন্য এক সদস্য মতছিম আলী হানাদারদের হাতে কয়েক মাস বন্দি ছিলেন। চরম শারীরিক নির্যাতন শেষে তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় বড়লেখা রেলস্টেশন রোডে ফেলে দেয়া হয়। কেছরীগুল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হবিব আলীর পিতা ইছুফ আলী নিজ বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হন। তার ভাইয়ের গায়ে আগুন দেয়া হয়। এ এলাকার শরণার্থী বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘরে দালালরা অবাধে লুটপাট চালায়। দালালদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী এলাকার সাধারণ মানুষকে তাদের নানা কাজ করতে বাধ্য করত। রাঙাউটি গ্রামের হাবিবুর রহমান যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পূর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। উত্তাল মার্চে তিনি প্রথমবারের মতো বাড়িতে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজুল ইসলাম তাঁকে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের অস্ত্র চালনার কৌশল শিখিয়ে দেয়ার কার্যে নিয়োজিত করেন। পাকবাহিনীর হাতে হাবিবুর, কাঁঠালতলীর ময়েজ উদ্দিন ও দক্ষিণভাগের এরশাদ আটক হন। হাবিবুরের মতো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আরও যারা আটক হন, তাদের পাকিস্তানি মেজর আজম খান পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়। পথে তাদের কুলাউড়া এবং সিলেটে কয়েকদিন বন্দি রেখে চরম নির্যাতন চালানো হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে আরও নির্যাতন করে তাদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে শেষ পর্যন্ত তারা বেঁচে যান।
কাঁঠালতলী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জমির উদ্দিনের পিতা সোনাহর আলী এবং মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের পিতা আরব আলীকে পাকিস্তানি হানাদাররা ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বর্বরদের নির্যাতনে এ দুই মুক্তিযোদ্ধার বুকের পাঁজর ভেঙ্গে যায়। চরম অসুস্থ অবস্থায় যুদ্ধের পরপর উভয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বড়খলা গ্রামের আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী খখাই মিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন বলে তাকে পাকক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধা মো. সিরাজ উদ্দিনের বাড়ি মাত্র সাতশ টাকায় নিলামে বিক্রি করে। তাঁর বৃদ্ধা নানিকে হানাদাররা নির্যাতন করে। দালালরা বাড়িতে লুটপাট চালায়। শিমুলিয়ার কবিরাজ বাড়ি পাকবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়। এখানে লুটতরাজ সংঘটিত হয়। এ বাড়ির বৃহৎ পারিবারিক গ্রন্থাগার ও ঔষধের সংগ্রহ ধ্বংস করা হয়। বাড়িতে থাকা বৃদ্ধ গৃহকর্ত্রী দালালদের হাতে নিগৃহীত হন। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার পরিবারে নানা ধরনের নির্যাতন চালাত। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতিদিন শান্তি কমিটির
অফিসে হাজিরা দিতে হতো। পাকবাহিনী ও দালালরা প্রতি রাতে শতশত নিরীহ বাঙালিকে পুল-কালভার্ট পাহারা দিতে বাধ্য করত। সাধারণ মানুষকে পরিখা খনন, পাকসেনাদের মালপত্র বহন করতে হতো। অনেককে নিজেদের হাঁস- মুরগি, ধান-চাল, তরি-তরকারি দিতে বাধ্য করত।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দক্ষিণভাগ স্টেশন-বাজারে অগ্নিসংযোগ করে। দালালরা বাজারের কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালায়। পাকসেনাদের অগ্নিসংযোগে সমস্ত বাজার পোড়ামাটিতে পরিণত হয়। এ সময় রাজাকার লুকু, আব্দুর রহমান প্রমুখ জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকের বাড়িঘরে লুটপাট চালায়। হানাদাররা কৃপাময় পালের বাড়িতে আক্রমণ করে। তার বৃদ্ধ পিতা নির্যাতনের শিকার হন। সংখ্যালঘু ছাড়া চা- শ্রমিকদের সহায়-সম্পত্তিও লুট করে দালালরা। হিন্দুদের অনেক উপাসনালয় ধ্বংস করে তারা। হরিপুর গ্রামের আনসার কমান্ডার ইব্রাহিম আলীকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিন মুক্তিযোদ্ধা গ্রামে আসেন। কিন্তু ভারতে যাওয়ার পূর্বেই পাকসেনারা তাঁর বাড়িতে হানা দেয়। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল খালিক লাল মিয়া ও ইব্রাহীম আলী হানাদারদের হাতে আটক হন। দুজনকে বড়লেখা উপজেলা হাজতে পাঠানো হয়। তিনদিন নির্যাতন শেষে তাদের ছেড়ে দেয়া হলে ইব্রাহীম আলী পুনরায় গ্রেফতার হয়ে পাঁচ মাস নির্যাতিত হন। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে রশিদাবাদ চা-বাগানের বধ্যভূমিতে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত প্রাণে বেঁচে গেলেও তার ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়। আরেঙ্গাবাদ গ্রামের নও মুসলিম আব্দুর রৌফের ওপর (পিতা ভুবনমোহন ভট্টাচার্য) পাকসেনারা নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়। পেনাগুল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সমছুল হকের পিতা বশির উদ্দিনকে ধরে নিয়ে পাকবাহিনী তার দাড়ি গোঁফ কেটে দেয়।
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের নানাভাবে নির্যাতন করে। হরিপুর গ্রামের মাহমুদ আলী এশার নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে আটক ও নির্যাতিত হন। দোয়ালীরা গ্রামের অনেক নিরীহ মানুষ পাক-হানাদারদের হাতে নির্যাতিত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার অভিযোগে এক ভোরে তাদের জুড়ী ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা কী ভয়ঙ্কর হতে পারে সে অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা বাড়ি ফেরেন। মুক্তিযোদ্ধা চেরাগ আলীর বড়ভাই আতাব আলী ভুলতে পারেননি একাত্তরের সেই দুঃসহ স্মৃতি।
ছোট ভাইর যুদ্ধে যাওয়ায় খড়গ নেমে আসে তার ওপর। কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় তাকে পাকবাহিনী আটক করে। ক্যাম্পে তার ওপর দুদিন নির্যাতন চালানো হয়। দু-পায়ের মধ্যে লৌহদণ্ড ঢুকিয়ে কিছুক্ষণ চেপে ধরে দূরে ছুঁড়ে ফেলে নৃশংস কায়দায় নির্যাতন চলে তার ওপর। এ অবর্ণনীয় অত্যাচারের ফলে তিনি পঙ্গু হয়ে যান।
বড়লেখায় দুটি বড় বধ্যভূমি রয়েছে- দাশের বাজার বধ্যভূমি এবং রশিদাবাদ চা-বাগান বধ্যভূমি। এ দুটি বধ্যভূমিতে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়। পাকসেনারা রশীদাবাদ চা- বাগানে একসঙ্গে ৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। বড়লেখায় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। শাহবাজপুরে পাকিস্তানি বাহিনী দুবার মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। প্রথমে জুন মাসে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর শাহবাজপুর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এতে নেতৃত্ব দেন নায়েক সুবেদার দাইয়ান। এ সময় ১০-১২ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ সময় ক্যাম্প দখল করে অনেক অস্ত্র ও গোলা-বারুদ হস্তগত করেন। দুজন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল ও আব্দুর রশিদ এখানে গুরুতর আহত হন। শাহবাজপুর পাকিস্তান ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা ১০ই আগস্ট আবার আক্রমণ করেন। পাকসেনারাও পাল্টা আক্রমণ করে। ফলে দুপক্ষের মধ্যে দুঘণ্টা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। এ-যুদ্ধে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। -শাহবাজপুর যুদ্ধ – মৌলভীবাজার এলাকার মুক্তিযুদ্ধে একটি স্মরণীয় ঘটনা।
হানাদার বাহিনীর যোগাযোগ বিঘ্নিত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা বড়লেখার বাজনীর পুল ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। এ পুল রেকি করতে এসে মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন এবং শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা পুলটি ধংস করেন। বাজনীর পুল অপারেশন-এ ৩৬ জন রাজাকার ধরা পড়ে। তাদের ২৬ জন পরে নিহত হয়।
ছোটলেখা চা-বাগানে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। এখান থেকে তারা সাধারণ মানুষজনের ওপর নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালাত। এর প্রতিশোধ নিতে মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্পে দুবার আক্রমণ করেন। এ আক্রমণে নেতৃত্ব দেন সোলেমান আলী মিয়া। প্রথমবার ছোটলেখা চা-বাগান যুদ্ধ-এ পাকসেনাসহ ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। দ্বিতীয়বার একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
হাকালুকি হাওরের বড়লেখা অংশের পিংলাকান্দিতে সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। পিংলারকান্দি যুদ্ধ বা হাকালুকি যুদ্ধ নামে খ্যাত এ-যুদ্ধে ২৫ জন পাকসেনা নিহত হয়, আহত হয় ততোধিক। অনেকে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১৪ই সেপ্টেম্বর লাতু-সারপার যুদ্ধ হয়। এর আগে আগস্টের শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা সারপার থেকে পাকসেনাদের বিতাড়িত করেন। এর প্রতিশোধ নিতে পাকসেনারা ১৪ই সেপ্টেম্বর দুশ নৌকা নিয়ে সারপার, অষ্টঘরি ও গবিনপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে। এ আক্রমণে পাকসেনাদের দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য অংশ নেয়। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করেন। কিন্তু শত্রুদের ভয়াবহ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এখানে মুক্তিযোদ্ধা আরফান আলী শহীদ হন।
উপজেলার বর্ণি ইউনিয়নের হাকালুকি হাওর সংলগ্ন মালাম বিল এলাকায় অক্টোবর মাসে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। মালাম বিল যুদ্ধ-এ উভয় পক্ষে বেশ হতাহতের ঘটনা ঘটে। যুদ্ধের পর পাকবাহিনী আশপাশের গ্রামগুলোতে তাণ্ডব চালায়। নারীদের নির্যাতন করে। অনেকের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
৫ই ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা ছোটলেখার পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর কাদিরের নেতৃত্বে ১৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা এ আক্রমণে অংশ নেন। বড়লেখার সন্তান হবিব আলী এ সময় দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকসেনারা পালিয়ে বড়লেখা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। ৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের বড়লেখা ক্যাম্পে অপারেশন চালান। মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ আক্রমণে উপায়ন্তর না দেখে শত্রুরা বিয়ানীবাজারের দিকে পালিয়ে যায় এবং এদিনই বড়লেখা উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা উল্লসিত জনতার সামনে বড়লেখা ডাকবাংলো এবং সিও অফিসে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- শফিক উদ্দিন আহমেদ, বীর প্রতীক (পিতা তজমুল আলী, বর্ণি)। তাঁর নামে বর্ণি ইউনিয়নে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। বড়লেখার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মুহিবুর রহমান (পিতা উমেদ আলী, বর্ণি; গোলাপগঞ্জের সুন্দিশাইল রণাঙ্গণে ৫ই আগস্ট শহীদ), মুহিব আলী (পিতা মোবারক আলী, হলদিরপার; বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা রণাঙ্গণে ১১ই সেপ্টেম্বর শহীদ), দীনেশ নাথ (পিতা উপেন্দ্র নাথ, জামকান্দি; জকিগঞ্জ উপজেলার জালালপুর যুদ্ধে ২৫শে অক্টোবর শহীদ), আরফান আলী (পিতা সিকান্দর আলী, নান্দুয়া; লাতু-সারপার যুদ্ধে ১৬ই সেপ্টেম্বর শহীদ), আব্দুর রহমান (পিতা আব্দুল গফুর, পাঁচপাড়া; কমলাপুর চা-বাগান যুদ্ধে ১০ই জুলাই শহীদ), মানিক আলী (পিতা ওয়াছির আলী, বোবারতল; লাতু অপারেশনে ১৪ই সেপ্টেম্বর শহীদ), আজমল আলী (পিতা সিকান্দর আলী, জফরপুর; বড়লেখা ষাটমা ব্রিজ যুদ্ধে ২৫শে জুলাই শহীদ), আকমল আলী (পিতা নুরজ আলী, মহবন্দ; জকিগঞ্জ উপজেলার জালালপুর রণাঙ্গণে ১৬ই অক্টোবর শহীদ), নিমার আলী (পিতা ইয়াকুব আলী, হরিপুর; মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে ১৫ই এপ্রিল শহীদ), মোজাম্মিল আলী (পিতা একরাম আলী, মুর্শিবাদকুড়া; হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে ১৫ই এপ্রিল শহীদ) এবং সিতু ব্যানার্জী (চা-শ্রমিক ও মুক্তিযোদ্ধা; ধামাই রণাঙ্গনে শহীদ)।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বড়লেখায় শহীদ হন। তাঁরা হলেন খতিব আলী (গ্রাম বাক প্রচণ্ড, বিয়ানীবাজার; ১২ই অক্টোবর নিজবাহাদুরপুর গ্রামে শহীদ), কুতুবউদ্দিন (১০ই আগস্ট, শাহবাজপুরে শহীদ), নায়েক আব্দুল মান্নান (১০ই আগস্ট শাহবাজপুরে শহীদ), নায়েক মুজাহিদ আলী (১০ই আগস্ট শাহবাজপুরে শহীদ), মোহাম্মদ ফয়েজ মিয়া (১০ই আগস্ট শাহবাজপুরে শহীদ), সিগন্যালম্যান মোস্তফা কামাল (১০ই আগস্ট শাহবাজপুরে শহীদ), আবুল হোসেন (২৭শে জুলাই ছোটলেখা যুদ্ধে শহীদ), আবুল কাশেম (রেকি করতে এসে ধৃত এবং বড়লেখা পাক ক্যাম্পে শহীদ), আব্দুশ শহিদ (সেপ্টেম্বরে হাকালুকির পিংলারকান্দি যুদ্ধে শহীদ), মদন আলী (সেপ্টেম্বরে পিংলারকান্দি যুদ্ধে শহীদ), আনোয়ার হোসেন (বাড়ি ঢাকা; পিংলারকান্দি যুদ্ধে শহীদ)। ২৭শে জুলাই ছোটলেখা যুদ্ধে এবং সেপ্টেম্বরে হাকালুকির পিংলারকান্দি যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পিংলারকান্দিতে যিনি শহীদ হন তাঁর বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। [মোস্তফা সেলিম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!