You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে বড়াইগ্রাম উপজেলা (নাটোর)

বড়াইগ্রাম উপজেলা (নাটোর) পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণ, নির্যাতন-নিপীড়ন ও বঞ্চনা থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ১৯৬৬ সালে ছয়দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং তার ভিত্তিতে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ- বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিলে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। তাঁর ডাকে সারা বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ পালিত হয়। নাটোরের বড়াইগ্রামের মানুষও এ আন্দোলনে যোগ দেয়। বড়াইগ্রামের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি শঙ্করগোবিন্দ চৌধুরী এমপিএ, আশরাফুল ইসলাম মিয়া এমপিএ প্রমুখের নেতৃত্বে স্থানীয় জনগণ আন্দোলন-সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যায়।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে মূলত তাঁর নির্দেশেই এ দেশ পারিচালিত হতে থাকে। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণায় দেশের অন্যান্য স্থানের মতো বড়াইগ্রামেও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্ততি শুরু হয়। বড়াইগ্রাম এলাকায় ডা. মহফিল উদ্দিন আহমেদ (কইডিমা), আমজাদ হোসেন (পিতা আসমত আলী, থানাইখাড়া), আব্দুল জলিল (পিতা খলিলুর রহমান, মারিয়া) প্রমুখ নেতার সহযোগিতায় ধানাইদহে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। উপর্যুক্ত নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। আর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন আমজাদ হোসেন ও আবদুল জলিল।
বড়াইগ্রামের সংগ্রামী জনতা মুলাডুলি রেলক্রসিং ও ধানাইদহ ব্রিজে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করে। ১১ই এপ্রিল পাকবাহিনী স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পাবনা অতিক্রম করে মুলাডুলি রেলক্রসিংয়ে এসে সাধারণ জনতার প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। প্রতিরোধকারীরা সেখানে কয়েকটি খালি মালগাড়ি দিয়ে রেলক্রসিং বন্ধ করে দেয়। রাস্তায় গর্ত করে এবং গাছের গুঁড়ি, খেজুর ও বাবলার কাঁটাযুক্ত ডাল ফেলে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। পাকবাহিনী মুলাডুলি রেলক্রসিংয়ে এসে এলোপাথারি গুলিবর্ষণ এবং বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করে। এমতাবস্থায় প্রতিরোধকারীরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। মুলাডুলি রেলক্রসিং প্রতিরোধ যুদ্ধে বহু লোক হতাহত হয়।
মুলাডুলি রেলক্রসিংয়ে ব্যর্থ হয়ে ক্ষুব্ধ জনতা ঐদিনই ধানাইদহ ব্রিজে পাকবাহিনীকে পুনরায় প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নেয়। শতশত মানুষ কুড়াল, শাবল ইত্যাদি নিয়ে ব্রিজ ভাঙ্গতে শুরু করে। এদিন সন্ধ্যায় পাকবাহিনী উত্তর ও দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রতিরোধকারীদের আক্রমণ করে। ১১ই এপ্রিল সংঘটিত ধানাইদহ ব্রিজ প্রতিরোধ যুদ্ধ-এ কয়েকজন ইপিআর সদস্য ও স্থানীয় অনেকে শহীদ হন। পথে একই দিন হানাদাররা পারকোল গ্রামে ১৬ জন এবং পাঁচবাড়িয়া গ্রামের ৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে, যা পারকোল- পাঁচবাড়িয়া গণহত্যা নামে পরিচিত।
১৩ই এপ্রিল পাকবাহিনী বড়াইগ্রামে অনুপ্রবেশ করে এবং বড়াইগ্রাম থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তীতে বনপাড়া ইউনিয়ন বোর্ড অফিস, কয়েন বাজার ব্রিজের পাশে এবং জোনাইল বাজারে তাদের দোসর রাজাকারদের ক্যাম্প স্থাপিত হয়। পাকবাহিনী প্রতিদিন বড়াইগ্রাম থেকে এসব ক্যাম্পে টহলে আসত।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বড়াইগ্রামে পাকবাহিনীর দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার ও -আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। এর সদস্যদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী (পাঁচবাড়িয়া পাঁচবাড়িয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, কুখ্যাত দালাল-খুনি ও লুটেরা), আব্দুল মমিন মহুরি (ঢুলিয়া; দলিল লেখক, কুখ্যাত খুনি ও রাজাকার), করম আলী সরকার (দড়িখৈর), আব্দুল জুব্বার (মেরিগাছা; রাজাকার), গোলজার ডাক্তার (জোনাইল বাজার; গ্রাম্য চিকিৎসক), ভজু মিয়া (চৌমুহনী; জোনাইল ইউনিয়নের মেম্বর), ফরহাদ হোসেন (রাজাকার কমান্ডার), ওবায়দুর রহমান (লক্ষীকোল বাজার; শান্তি কমিটির নেতা), ইস্রাফিল হোসেন (তিরোইল; রাজাকার), আমিনুল হক মাস্টার (বনপাড়া) ও নঈম উদ্দিন (আহম্মেদপুর)-এর নাম উল্লেখযোগ্য। এরা পাকবাহিনীর সঙ্গে মিলে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। এপ্রিল মাসে স্থানীয় তিন রাজাকার ডা. গোলজার হোসেন, ভজু মিয়া (জোনাইল ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর) ও তার ছেলে ফরহাদ হোসেন (রাজাকার কমান্ডার) বর্ণি গ্রামের অনন্ত মাঝিকে গুলি করে হত্যা করে। এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও জোয়ারি ইউনিয়ন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডা. মহফিল উদ্দিন আহমেদকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে বনপাড়া রাজাকার ক্যাম্পে নির্যাতন করে এবং ঈশ্বরদীর অধীর চন্দ্র সাহাকে গুলি করে হত্যা করে। ঈশ্বরদী ও গোপালপুর চিনিকলের অবাঙালিরা আন্তন বিশ্বাসকে নির্যাতন সেলে নিয়ে ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করে। মে মাসের ৩ তারিখে মেজর শেরওয়ানির নেতৃত্বে পাকবাহিনী বড়াইগ্রামের বনপাড়ার ক্যাথলিক খ্রিস্টান মিশনে অপারেশন চালায়। সেখানে বড়াইগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে আশ্রয় নেয়া অর্ধশতাধিক জন নিরপরাধ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, যা বনপাড়া মিশন গণহত্যা নামে পরিচিত। লক্ষ্মীকোল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা পরেশ চন্দ্র কর্মকারের প্রতিবেশী অতিশয় বৃদ্ধ শীতল চন্দ্ৰকে রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকেরা বাড়ি থেকে জোরপূর্বক লক্ষীকোল মসজিদে ধরে এনে অস্ত্রের মুখে গরুর মাংস খেতে বাধ্য করে এবং কলেমা পড়িয়ে তাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে। মে মাসের মাঝামাঝি অবাঙালিরা গোপালপুর চিনিকলের অনিল পিউরিফিকেশনকে পাকবাহিনীর হতে তুলে দেয়। পাকবাহিনী আরো কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে তাঁকে হত্যা করে একটি গর্তে পুঁতে রাখে।
দোগাছি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আক্কাস আলী, সহকারী শিক্ষক আব্দুল আজিজ ও আবু রায়হান ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে সহযোদ্ধাদের নিয়ে জুলাই মাসে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। সহযোদ্ধাদের বিলমারিয়া গ্রামে রেখে তাঁরা তিনজন লালপুর থানার মোহরকয়ায় আসেন। সেখানে অবস্থানরত দালাল জসীম উদ্দিনের নেতৃত্বে রাজাকাররা তাঁদের লালপুর থানায় আটকে রেখে পাকবাহিনীকে খবর দেয়। পাকবাহিনী তাদের নাটোর ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করে। নভেম্বর মাসে থানাইখাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন মা-বাবাকে দেখতে বাড়ি এলে রাজাকাররা বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে আটক করে। অতঃপর মা-বাবার সামনেই প্রথমে গুলি করে এবং পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে তাঁকে হত্যা করে।
বড়াইগ্রামে ৩টি গণকবর রয়েছে। সেগুলো হলো- ধানাইদহ ব্রিজপাড় গণকবর-, বনপাড়া-কালিকাপুর গণকবর, ও পারকোল গণকবর।
বড়াইগ্রাম উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি যুদ্ধ হয়। ২৮শে সেপ্টেম্বর বড়াই গ্রামের মাঝপাড়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি সহযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে হানাদারদের একাই রুখে দেন এবং কয়েকজন হানাদারকে হত্যা করেন। হঠাৎ হানাদারদের ছোড়া একটি গ্রেনেডের আঘাতে তিনি শহীদ হন।
১৫ই নভেম্বর শাহাদত হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বড়াইগ্রামের মশিন্দা গ্রামের জব্বার মণ্ডলের বাড়িতে গোপন আশ্রয় নেয়। এ-খবর কুখ্যাত দালাল, খুনি ও পাঁচবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমে নাটোর হানাদার ক্যাম্পে পৌছে দেয়া হয়। অল্প সময়ের মধ্যে রাজাকারআলবদর সদস্যসহ বিপুল সংখ্যক পাকবাহিনী এসে মশিন্দাসহ আশপাশের গ্রামগুলো ঘিরে ফেলে এবং গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি ছোড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে শাহাদত হোসেন সহযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে লড়তে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন, কিন্তু শত্রুর নিকট আত্মসমর্পণ কিংবা পরাজয় স্বীকার করেননি।
৯ই ডিসেম্বর একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। বিজয় সমাগত দেখে এদিন বড়াইগ্রামের সর্বকনিষ্ঠ ও প্রচণ্ড সাহসী মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বিজয়োল্লাসে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ট্রাকযোগে নাটোরের দিকে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আহম্মদপুর ব্রিজ অতিক্রম করার সময় পাকবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে ট্রাকটি উল্টে গেলে তিনি ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। ১৬ই ডিসেম্বর বড়াইগ্রাম উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
বড়াইগ্রামে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন- আক্কাস আলী (পিতা দুলুব আলী, দোগাছি), আবদুল আজিজ (পিতা বেলাল উদ্দিন প্রামাণিক, মহানন্দনগাছা), আবু রায়হান (পিতা হাজি উমেদ আলী, মেরিগাছা), শাহাদত হোসেন (পিতা রাজাউল্লাহ, ঢুলিয়া), ইয়াদ আলী (পিতা আবদুল কাদের প্রামাণিক, দোগাছি) ও আবুল কালাম আজাদ (পিতা মকবুল হোসেন, পিংগুই)।
বড়াইগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বনপাড়া সেইন্ট জোসেফ হাইস্কুলের দক্ষিণ প্রাচীর সংলগ্ন একটি স্মৃতিসৌধ এবং জোনাইল বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক নির্মিত হয়েছে। বনপাড়া-কালিকাপুর গণকবরটি চিহ্নিত করে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া শহীদ শাহজাহানের নামে মেরিগাছা-বড়াইগ্রাম সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ শাহজাহান সড়ক’। [রবিউল করিম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!