You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.06 | বড় সন্যাসী প্রতিরোধযুদ্ধ (রামপাল, বাগেরহাট) - সংগ্রামের নোটবুক

বড় সন্যাসী প্রতিরোধযুদ্ধ (রামপাল, বাগেরহাট)

বড় সন্যাসী প্রতিরোধযুদ্ধ (রামপাল, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় ৬ই মে। বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে স্থানীয় জনসাধারণের এ-যুদ্ধে প্রতিপক্ষের ১৪-১৫ জন নিহত হয়।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যাঁর যাঁর এলাকায় চলে গিয়ে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। দেশের অন্যান্য এলাকার মতো রামপাল থানার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্ররাও নিজ-নিজ এলাকায় চলে আসে। থানার বিভিন্ন এলাকায় কুবের চন্দ্র বিশ্বাস এমপিএ এবং আওয়ামী লীগ-এর বিশিষ্ট নেতা আ. জলীল গাজীর পৃষ্ঠপোষকতায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। তাঁদের নেতৃত্বে রামপাল থানার মল্লিকের বেড় ইউনিয়নেও এ ধরনের একটি কমিটি গঠিত হয়। পশ্চিম মল্লিকের বেড় গ্রামের হাওলাদার সিদ্দিকুর রহমান, শেখ আফছার উদ্দিন, আ. রাশেদ গাজী, বিনয় কৃষ্ণ মজুমদার, দয়াময় মণ্ডল, অরুণ মৃধা, হাওলাদার সুলতান আহমেদ, ইউনুছ আলী হাওলাদার, বড় সন্ন্যাসীর কাদের তালুকদার, আ. রব তালুকদার, চিরানন্দ ডাকুয়া, মহানন্দ মণ্ডল, আনন্দ মণ্ডল, আক্কাস আকন, আয়ুব আলী হাওলাদার, লেহাজউদ্দিন হাওলাদার, আমীর আলী মল্লিক, ছোটসন্ন্যাসী গ্রামের সুরেন্দ্র নাথ মণ্ডল, জহর লাল ঢালী, মরুভূষণ মণ্ডল, শচীন মণ্ডল, হিরণ্ময় মণ্ডল, প্রীতীশ মণ্ডল, ধীরেন মণ্ডল, আয়ুব আলী খাঁ প্রমুখ এ কমিটির সদস্য ছিলেন। এঁদের দায়িত্ব ছিল অত্র থানায় গঠিত এ-সকল কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং নিজ এলাকাকে সকল প্রকার বিপদ থেকে মুক্ত রাখা; প্রয়োজনে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়া।
সেনাবাহিনীর সদস্য খালেক হাওলাদারের নেতৃত্বে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এলাকায় যেসব ব্যক্তিগত বন্দুক ছিল, সেগুলো প্রস্তুত রাখাসহ পর্যাপ্ত পরিমাণ কার্তুজ সংগ্রহ করা হয়। কর্মকাররা রাতদিন ধরে সড়কি, রামদা, ছোরা, কাটাবন্দুক, হাতুরগোম ইত্যাদি তৈরি করেন। কেউ-বা বেত দিয়ে ঢাল, সুপারি গাছ দিয়ে সুচালো শলা, তীর-ধনুক ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র তৈরি করিয়ে বিভিন্ন স্থানে জড়ো করতে থাকেন এবং লোকজন শত্রুদের সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলা করার জন্য রাতের বেলা পাহারা দেয়া শুরু করে। মল্লিকের বেড় ও সন্ন্যাসী গ্রামের এই প্রস্তুতির খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
সন্ন্যাসীর বেড় এলাকাটি বাগেরহাট মহকুমার লাগোয়া ও বাগেরহাট থেকে রামপালে যাওয়ার প্রবেশদ্বার। তাই এখানকার লোকজন দোয়ানে খাল বরাবর এবং বেতিবুনিয়া নদীর কিছু অংশ নিয়ে একটি শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। ২৫শে মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে এলাকার সর্ব শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিশেষ তৎপরতা শুরু হয়। অপরদিকে, বিভিন্ন এলাকার মতো বাগেরহাট সদরসহ প্রতিটি থানায়ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকার ও আলবদর বাহিনী এবং শান্তি কমিটি গড়ে ওঠে। রামপাল থানা নিয়ন্ত্রণ করত বিশেষত বাগেরহাট সদর কমিটি। এপ্রিলের শেষদিকে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী শরণখোলা থানার মাওলানা ইউসুফের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ নেতাদের নিয়ে বাগেরহাটে একটি মিটিং হয়। মিটিংএ তাদের বক্তব্য ছিল – ভারতের দালাল খতম করো, হিন্দুদের বিতাড়িত করো, পাকিস্তান টিকিয়ে রাখতে পাকিস্তানবিরোধীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়। খবরটি সঙ্গে-সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার মতো সন্ন্যাসী গ্রামেও পৌঁছে যায়। তাই এখানকার লোকজন তাৎক্ষণিকভাবে পাহারা বসায়, কারণ তাদের আশঙ্কা ছিল, প্রথম আক্রমণ হয়তো এখানেই হবে। একদিকে পাকিস্তানপন্থীদের সন্ন্যাসী গ্রামে আক্রমণের প্রস্তুতি, অন্যদিকে সন্ন্যাসী গ্রামের লোকজনের থানার বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের মোকাবেলা করার প্রস্তুতি চলতে থাকে। সন্ন্যাসী গ্রামের পার্শ্ববর্তী কালিয়া গ্রামের আকবর আলী কবিরাজ বিভিন্ন খবরাখবর সন্ন্যাসী গ্রামের লোকজনদের নিকট সরবরাহ করতেন। পরবর্তীতে রাজাকাররা তাঁকে হত্যা করে।
বাগেরহাটের কুখ্যাত রাজাকার রজ্জব আলী ফকির ও তার অনুসারী এন্তাজ শেখ, নওয়াব আলী শেখ, তৈয়ব আলী মোল্লা প্রমুখ সন্ন্যাসী গ্রাম আক্রমণের পরিকল্পনা করে। পূর্বের মতোই আকবর আলী খবর আনেন যে, ৬ই মে সকালে তারা আক্রমণ চালাবে। সঙ্গে-সঙ্গে বিশ্বস্ত গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এ খবর পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে পৌঁছে দেয়া হয়। এরপর ঘটনার দিন দক্ষিণ সন্ন্যাসী গ্রাম থেকে কাদের তালুকদার ও তার ভাই আ. রব তালুকদার চন্দ্রখালী থেকে খাজা ফকির, জিয়লমারী থেকে রাজ্জাক হাওলাদার, বাঁশবাড়িয়া থেকে ললিত হালদার, মল্লিকের বেড় থেকে ছত্তার হাওলাদার, হেড়মা বাজার থেকে কয়েজন ইপিআর সদস্য এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সম্ভাব্য আক্রমণস্থল থেকে একটু দূরে অবস্থান করে। স্থানীয় শচীন মণ্ডল, মরুভূষণ মণ্ডল, রাজেন্দ্র মণ্ডল, যোগেন্দ্রনাথ ডাকুয়া, অনিল মিস্ত্রী এবং কালিপদ ডাকুয়া তাদের নিজস্ব বন্দুক এবং অন্যরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শত্রুদের অপেক্ষা করতে থাকেন।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। আক্রমণের আর সম্ভাবনা নেই এরূপ ভেবে লোকজন দুপুরের খাবার খেতে যায়। এমন সময় বাগেরহাট ও রামপালের পার্শ্ববর্ত এলাকা থেকে রাজাকাররা বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সন্ন্যাসী গ্রামের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তারা লুটপাট ও ভাংচুরে এগিয়ে আসে। সঙ্গে-সঙ্গে গ্রামের লোকজনও এগিয়ে আসে। শচীন মণ্ডল, অতুল মণ্ডল, মরুভূষণ মণ্ডল, রাজেন্দ্র মণ্ডল, রাজ্জাক হাওলাদার, অনিল মিন্ত্রীসহ যাঁদের কাছে বন্দুক ছিল তাঁরা একসঙ্গে গুলি করা শুরু করেন। পাশাপাশি চলে হাতুরগোমের প্রচণ্ড গর্জনসহ তীর-ধনুক, বাঁশ ও সুপারি গাছের সুচালো শলার আক্রমণ। দেখতে- দেখতে সমস্ত এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে যায়। মুহুর্মুহু বন্দুক, রাইফেল ও হাতুরগোমের শব্দে অনেকদূরব্যাপী আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। স্থানীয় লোকজন শত্রুপক্ষকে ঘিরে ফেলে। তাদের সাহায্য করার জন্য আরো একটি বাহিনী এগিয়ে আসে। লোকজন পেছনদিকে সরে গিয়ে শত্রুদের গ্রামের আরো ভেতরে ঢোকার সুযোগ করে দেয়। রাজাকাররাও নিশ্চিত জয়ের আশায় গ্রামের একেবারে ভেতরে চলে আসে। তাদের এই আক্রমণের খবর পেয়ে চারদিক থেকে আরো মুক্তিকামী মানুষ ছুটে আসে। তারা রাজাকারদের চক্রব্যূহের মতো চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিনদিক থেকে এমনভাবে গোলাগুলি চলতে থাকে যাতে শত্রুপক্ষকে সাহায্য করার জন্য আর কেউ এগিয়ে আসতে না পারে। এভাবে চক্রব্যূহের মধ্যে ফেলে শত্রুদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালানো হয়। রাজাকারদের গুলি শেষ হয়ে গেলে তারা পেছন দিকে পালাতে শুরু করে। এদিকে স্থানীয় জনগণ পেছন থেকে তাড়া করে তাদের উত্তরদিকে দোয়ান খালের পাড়ে নিয়ে যায় এবং পেটাতে পেটাতে খালে ফেলে দেয়। সেদিনের এই প্রতিরোধযুদ্ধে শত্রুপক্ষের ১৪-১৫ জন নিহত হয়। পরবর্তীতে এ ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে তারা ২১শে মে ডাকরা গণহত্যা ঘটায়। [দিলীপ কুমার মণ্ডল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড