বড়গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যুদ্ধ (দিনাজপুর সদর)
বড়গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যুদ্ধ (দিনাজপুর সদর) সংঘটিত হয় ১৮ই নভেম্বর। এ-যুদ্ধে ১১ জন পাকসেনা নিহত হয়।
এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে দিনাজপুর সদরের কমলপুর ইউনিয়নের বড়গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প গড়ে ওঠে। এ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা বেশারউদ্দিন মাস্টার, আনোয়ার চেয়ারম্যান, নাদির চৌধুরী, গিয়াস মিয়া, মহিউদ্দিন মাস্টার, সাদেক মাস্টার, ইরাদ মাস্টার ও মফিজ মাস্টার। এ ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করেন আওয়ামী লীগ নেতা ইরফান মিয়া, সফিউদ্দিন, আছির পণ্ডিত, আব্দুল হামিদ চৌধুরী প্রমুখ। ১৪ই এপ্রিলের মধ্যে এখানে অপারেশন ক্যাম্প গঠন করা হয় এবং যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনা করেন বেশারউদ্দিন মাস্টার। ক্যাম্প থেকে অস্ত্র সংগ্রহের পরিকল্পনা করা হয় এবং এ উপলক্ষে অনেক মুজাহিদ অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পে এসে যোগ দেন। মোহনপুর থেকে সুন্দরা পর্যন্ত তিনটি বিওপি-র ইপিআর সেনাদের পক্ষ থেকে সুবেদার মেজর শহিদুল্লার নেতৃত্বে এক কোম্পানি ইবিআর ও বহু সংগ্রামী বাঙালি অস্ত্রসহ এ ক্যাম্পে এসে অবস্থান নেন। এভাবেই বড়গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অপারেশন ক্যাম্পের যাত্রা শুরু হয়। জুন মাসের মধ্যে ছাত্র-যুবক ও কৃষক-শ্রমিকরা দলে- দলে এসে যোগ দিতে থাকে এ ক্যাম্পে। গঠন করা হয় বড়গ্রাম ইয়ুথ রিসিপশন এন্ড অপারেশন ক্যাম্প। এ ক্যাম্পেরও ইনচার্জ-এর দায়িত্ব নেন বেশারউদ্দিন মাস্টার। মহিউদ্দিন মাস্টার ও সফর আলী দায়িত্ব নেন সেকেন্ড-ইন- কমান্ডের। নাদির চৌধুরী অফিস ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকেন। সাদেক আকতার ও আজিজারকে দায়িত্ব দেয়া হয় রশদ ও ঔষদপত্র যোগানোর।
ক্যাম্পের পক্ষে সুবেদার মেজর শহিদুল্লাহ যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করতেন এবং ক্যাম্প ইনচার্জ ও কমান্ডারের নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হতো। যুবকদের পাঠানো হতো প্রশিক্ষণে। এ ক্যাম্পের যুবকদের প্রথমে ভারতের ডালিমগায় ট্রেনিং দিয়ে পরে সেক্টর ৭এ/৭বি-এর অধীন ভারতের বাকডোগরা ক্যান্টনমেন্টের তত্ত্বাবধানে পানিঘাটায় ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হতো। ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধারা বড়গ্রাম ইয়ুথ রিসিপশন এন্ড অপারেশন ক্যাম্পে এসে যোগ দিতেন।
প্রতিদিন পরিকল্পনামতো যুদ্ধের ম্যাপ, রেকি ও এম্বুশ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হতো। এ ক্যাম্প থেকে আক্রমণের মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৪ই আগস্ট খানপুর-কুতৈড় যুদ্ধ, ২৪শে আগস্ট দানীহারী যুদ্ধ মোহনপুর আক্রমণ প্রভৃতি। এসব কারণে ক্যাম্পটি হানাদার বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয় এবং ১৮ই নভেম্বর তারা এখানে আক্রমণ চালায়। আক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে তাদের প্রতিহত করেন। একটি দল থাকে স্কুলে, অন্যটি কিছু দূরে বাঁশঝাড়ে অবস্থান নেয়। পাকসেনারা স্কুলটি ঘেরাও করে ফেললে সন্ধ্যার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেন এবং উভয় পক্ষে গোলাগুলি শুরু হয়৷ ক্যাম্পটির অবস্থান, এলাকার ভৌগোলিক পরিমণ্ডল, প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে হানাদার বাহিনীর কোনো ধারণাই ছিল না। তাই তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁদে আটকা পড়ে। অন্যদিকে, ক্যাম্পটির দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা স্থানীয় বলে তাঁদের পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করা খুব সহজ ছিল। তাঁরা পূর্ণোদ্যমে হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁদের গুলিতে ১১ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং পাকিস্তানি মেজর নাসিরের উরুতে এলএমজি-র গুলি লাগে। যুদ্ধে পাকসেনারা পরাজিত হয়। শত্রুদের বহু গোলা-বারুদ, ১ ইঞ্চি মর্টার, কয়েকটি এলএমজি, ২ ইঞ্চি মর্টার এবং কিছু চাইনিজ অটো রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ সাফল্য মুক্তিযোদ্ধাদের মনে অসীম সাহস ও অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করে। এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- মো. লুৎফর রহমান, শাহাবুদ্দিন, সাবের আলী, অহিদুল ইসলাম, রতন, মামুন, ইব্রাহিম, মফিজ, ইলিয়াস, সোহরাব প্রমুখ। [মাসুদুল হক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড