বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন গোপালগঞ্জ দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার। মা সায়েরা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। ২০২০ সালের ১৭ই মার্চ জাতির পিতার শততম জন্ম দিন। ২০২০-২০২১ সালকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ছয় ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। তিনি স্থানীয় গীমাডাঙ্গা স্কুল এবং গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। চোখের সমস্যার কারণে এ-সময় চারবছর তাঁর পড়াশোনা বন্ধ থাকে। পিতার কর্মস্থল-বদলির কারণে কিছুদিন তিনি মাদারীপুর হাইস্কুলে লেখাপড়া করেন। পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৪৪ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমান মওলানা আজাদ কলেজ) থেকে আইএ এবং একই কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করেন। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে তিনি আইন বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের অভিযোগে তাঁকে জরিমানা করা হয়। তিনি তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর জীবনকালকে চারটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্ৰথম পৰ্ব (১৯২০-১৯৪২) তাঁর জন্ম থেকে শুরু করে ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল হতে ম্যাট্রিকুলেশন পাস পর্যন্ত। এটিকে বলা যায় রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি এবং ভবিষ্যতে নেতৃত্বের পর্যায়ে উঠে আসার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনকাল। দ্বিতীয় পর্ব (১৯৪২-১৯৪৭) কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি এবং বেকার হোস্টেলের ছাত্রাবস্থা থেকে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত। তাঁর জীবনের এ অধ্যায়কে বলা যায় প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার প্রস্তুতিকাল। তৃতীয় পর্ব (১৯৪৭-১৯৭১) দেশ বিভাগোত্তর ঢাকাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি হচ্ছে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ, নেতৃত্বের উত্থান, তাঁর নেতৃত্বে বাঙালির জাতিসত্তার স্ফুরণ, পরিশেষে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকাল। চতুর্থ পর্ব (১৯৭২-১৯৭৫) পাকিস্তানে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডে শাহাদত বরণ পর্যন্ত। জীবনের এ অধ্যায়কে বলা যায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং মহানায়কের মর্মান্তিক প্রয়াণকাল।
বঙ্গবন্ধুর জীবনকাল মাত্র ৫৫ বছর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হলেও তিনি এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন। এর প্রায় পুরোটাই ছিল সংগ্রামে পরিপূর্ণ। কৈশোর থেকেই তিনি ছিলেন লোভ-লালসামুক্ত, ভয়-ভীতি-শঙ্কাহীন, অসীম সাহসী, স্বাধীনচেতা, মানবদরদি এবং অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আপসহীন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ৮ম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলনের প্রধান সংগঠক এবং বাঙালির অন্যতম জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩)-র সান্নিধ্যে আসেন। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁরই সান্নিধ্যে থেকে তিনি রাজনীতি করেছেন এবং আমৃত্যু তাঁকে রাজনৈতিক গুরু হিসেবে মান্য করেছেন। বঙ্গবন্ধু যে ভবিষ্যতে দেশনেতা হবেন, তাঁর মধ্যে সে সম্ভাবনা তখন থেকেই দেখা গিয়েছিল। ১৯৩৮ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক এবং তাঁর মন্ত্রিসভার শ্রম ও বাণিজ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জ আগমন উপলক্ষে গঠিত ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর তিনিই ছিলেন প্রধান। স্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি এর ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হন। গরিব মুসলমান ছাত্রদের কল্যাণার্থে গঠিত মুসলিম সেবাসংঘ, স্থানীয় মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটির তিনি সম্পাদক ছিলেন। এমনকি ৮ম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে (১৯৩৮) এক ঘটনায় তাঁর ৭ দিন থানা হাজতে কাটানোর অভিজ্ঞতাও হয়। দেশ বিভাগ-পূর্ব কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ হিসেবে পরিচিত সোহরাওয়ার্দী- আবুল হাশিম গ্রুপের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সে- সময়ে তিনি সাংগঠনিক কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত না থেকেও একজন দক্ষ ও পরিশ্রমী কর্মী-সংগঠক এবং জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে কলকাতা ও কলকাতার বাইরেও সুপরিচিত ছিলেন। ফলে, ১৯৪৩ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের পক্ষে ফরিদপুর অঞ্চলের দলীয় নির্বাচনি প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালের ৭ই জুলাই অনুষ্ঠিত সিলেটের গণভোটেও তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল।
পাকিস্তান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের স্বাধীনতার যে স্বপ্ন ছিল, ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে তার বাস্তবায়ন ঘটেনি। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, তা ছিল ‘ফাঁকির স্বাধীনতা’। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রভাবনায় একক পাকিস্তান ছিল না। বঙ্গীয় রাজনীতিতে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের অনুসারীদের মতো তিনিও লাহোর প্রস্তাবের (১৯৪০) একাধিক রাষ্ট্র-ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের প্রাক্কালে আবুল হাশিম, শরৎ চন্দ্র বসু ও কিরণ শংকর রায়কে সঙ্গে নিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভারত ও (পশ্চিম) পাকিস্তানের বাইরে তৃতীয় ‘স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেন, বঙ্গবন্ধু তার পক্ষে এবং বাংলা ভাগের বিপক্ষে কলকাতায় সভা-সমাবেশ করেন।
দেশ বিভাগের পরপর অন্য সবার মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলায় ফিরে না এসে আরো কিছু সময় কলকাতা অবস্থান করে মহাত্মা গান্ধী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এরপর তিনি সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব বাংলা ফিরে আসেন।
বাঙালির সার্বিক মুক্তির প্রশ্ন দূরে থাক, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা বাঙালির জাতি-প্রশ্নের মীমাংসা পর্যন্ত করতে পারেনি। উপরন্তু, রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের এক ধরনের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বা জাতিগত নিপীড়ন চলতে থাকে। এক কথায়, বাঙালিদের অবস্থা দাঁড়ায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো। অথচ তাদের ভোট ও সমর্থন ব্যতীত পাকিস্তান রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠিত হতো না। সার্বিক অবস্থা বঙ্গবন্ধুকে তীব্রভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তিনি এও উপলব্ধি করেন যে, পাকিস্তানি রাষ্ট্র-কাঠামোয় বাঙালির জাতীয় মুক্তিলাভ সম্ভব নয়। তাই ধাপে-ধাপে তিনি তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য অর্থাৎ স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।
১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা পায় বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনকারী ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। এর প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। পরের বছর ২৩শে জুন প্রতিষ্ঠা লাভ করে বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ (১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ)। কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু এ দলের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালের ১৮-২০শে মার্চ অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিলে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। সাংগঠনিক কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ ও দলকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে ১৯৫৭ সালে তিনি আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা থেকে মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে ইস্তফা দিতেও দ্বিধা করেননি।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের প্রথম বিদ্রোহ দেখা দেয় রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী সম্মত ছিল না। তাই শুরু হয় বাঙালির ভাষা-আন্দোলন। এই ভাষা-বিতর্ক পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পূর্ব থেকেই শুরু হয়েছিল। ভাষা-আন্দোলনের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন এবং কর্মপন্থা স্থিরীকরণ কোনো সময়ের ব্যাপার ছিল না। তিনি ছিলেন ভাষা- আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দিদের অন্যতম (১১ই মার্চ ১৯৪৮ গ্রেপ্তার)। ভাষা-আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে ১৯৫২ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরিত হয়ে বন্দি অবস্থায় সহবন্দি মহিউদ্দিন আহমদকে নিয়ে তাঁর দীর্ঘ অনশন পালন আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলে। যথার্থই তাঁর কাছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার আন্দোলন ছিল না, বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নও এর সঙ্গে জড়িত ছিল। তাই রাজপথ, কারাভ্যন্তর, আইন বা গণপরিষদ সর্বত্রই ভাষার প্রশ্নে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। ১৯৫৫ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষায় বক্তব্য পেশের অধিকার দাবি করে স্পিকারের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর স্মরণীয় ভাষণটি ছিল এরূপ: ‘অন্য কোন ভাষা জানি কি না জানি তা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমরা এখানে বাংলাতেই কথা বলতে চাই। যদি আমরা এটা উপলব্ধি করি যে, আমরা বাংলা ভাষায় ভাব-বিনিময় করতে সক্ষম, তাহলে সকল সময়ই আমরা বাংলায় কথা বলবো; এমনকি ইংরেজিতেও যদি আমাদের সমান দক্ষতা থেকে থাকে। যদি আমাদেরকে অনুমতি না দেয়া হয় তবে আমরা হাউজ পরিত্যাগ করবো। বাংলাকে অবশ্যই হাউজে গ্রহণ করে নিতে হবে – এটাই আমাদের স্ট্যান্ড।’
এর পূর্বে ১৯৫৫ সালের ২৫শে আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে প্রদত্ত অপর এক ভাষণে তিনি ‘পূর্ববঙ্গের’ নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখার প্রতিবাদে যে বক্তব্য রাখেন তাও সমভাবে প্রণিধানযোগ্য। স্পিকারের উদ্দেশে তিনি বলেন: “স্যার, আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন যে, তারা ‘পূর্ববঙ্গের’ স্থলে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম বসাতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়ে এসেছি যে, আপনারা [পূর্ব] পাকিস্তানের পরিবর্তে [পূর্ব] বঙ্গ নাম ব্যবহার করুন। ‘বঙ্গ’ শব্দটির একটি ইতিহাস আছে, আছে নিজস্ব একটি ঐতিহ্য …।”
স্মর্তব্য যে, ‘৪৮-‘৫২-র ভাষা-আন্দোলন বাঙালির চেতনামূলে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়। ভাষা-আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি-জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। পাকিস্তানি শাসন-পর্বে বাঙালির জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামে ভাষার প্রশ্ন ব্যতীত আরো যেসব বিষয় মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, সেগুলোর মধ্যে ছিল গণতন্ত্রের সংগ্রাম, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার বৈষম্য দূরীকরণ, শোষণমুক্তি, সর্বোপরি স্বাধীনতা। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। বাঙালির জনপ্রিয় নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জীবদ্দশায়ও মুজিব ছিলেন সকল আন্দোলন- সংগ্রামের মধ্যমণি।
বঙ্গবন্ধুর কাছে পাকিস্তান আন্দোলনের মূল চেতনা ছিল অর্থনৈতিক। অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে তা যথার্থ সত্য। ধর্ম এক পর্যায়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে- মানুষে বিভাজন তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি যখন দলের সাধারণ সম্পাদক তখন সবার জন্য এর দ্বার উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে তাঁরই উদ্যোগে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ করা হয়। ১৯৬৪ সালে কাশ্মীরের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ-দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিলে তাঁর ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ আহ্বানে সর্বত্র দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে আস্থাশীল বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা ছিল, ধর্মের নামে রাষ্ট্র নাগরিকদের মধ্যে কোনো প্রভেদ বা বৈষম্য সৃষ্টি করবে না; ধর্ম, কর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাষ্ট্র হবে সবার।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি, পাছে কেন্দ্রীয় শাসনক্ষমতা বাঙালিদের হস্তগত হয়। এরূপ আশঙ্কা সবসময় তাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল। ফলে ১৯৫৫ সালে তথাকথিত ‘সংখ্যাসাম্য’ (parity) নীতির আওতায় প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বাঙালিদের আসনসংখ্যা হ্রাস করে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সমতা আনা হয়। বঙ্গবন্ধু এ ‘সংখ্যাসাম্য’ নীতি গ্রহণ করতে পারেননি। তা প্রত্যাখ্যান করে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে ডেপুটি স্পিকারের উদ্দেশে তিনি বলেন: ‘স্যার, আমি আপনাকে বলতে চাই যে, সংখ্যাসাম্য নীতি আর নয়। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, কাজেই আমাদের অবশ্যই জনসংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।’
একই গণপরিষদে একই দিনে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় করাচির সঙ্গে ঢাকাকেও পাকিস্তানের ফেডারেল রাজধানী করার দাবি করলে অধিবেশনের সভাপতি ডেপুটি স্পিকারের মন্তব্য ছিল: ‘এটি অবাস্তব।’ এর উত্তরে বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল: ‘আপনি কি করে বলেন, এটি অবাস্তব? পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ১২০০ মাইলের ব্যবধানে এক রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি অবাস্তব নয়?’
পাকিস্তান রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ক্রমাগত অনুপস্থিতি, ‘৬০-এর দশকে জেনারেল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক সামরিক-বেসামরিক আমলাচক্রের রাষ্ট্রীয় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বিপরীতে রাষ্ট্র পরিচালনায় বাঙালিদের অংশগ্রহণের সকল পথ রুদ্ধ হওয়া এমন এক পরিস্থিতিতে ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।
পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙ্গে বাঙালির জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর সম্মুখে তাঁর বিখ্যাত ‘আমাদের বাঁচার দাবী ৬- দফা’ কর্মসূচি তুলে ধরেন। ৬-দফায় ‘স্বাধীনতা’র কথা সরাসরি বলা হয়নি সত্য, তবে কার্যত এটি ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তির সনদ। আইয়ুব সরকার একে ‘বিচ্ছিন্নতার কর্মসূচি’ আখ্যায়িত করে এর মোকাবেলায় নিবর্তন- নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। দেশব্যাপী ছয়দফা কর্মসূচি- প্রচারকালে বঙ্গবন্ধুকে বারবার গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথম তিন মাসেই তিনি ৮ বার গ্রেপ্তার হন। অবশ্য তাঁর জন্য গ্রেপ্তার- নির্যাতন নতুন কোনো ব্যাপার ছিল না। ১৯৪৮-১৯৬৫ এই ১৮ বছরের মধ্যে ১১ বছরের কোনো-না-কোনো সময় তিনি রাজনৈতিক কারণে জেলের অভ্যন্তরে কাটিয়েছেন এবং এক বছরে তিনবার, এমনকি এক নাগাড়ে প্রায় ৩ বছর পর্যন্ত তাঁকে কারাভ্যন্তরে থাকতে হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ১৯৫৪ সালে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল হওয়ার পর ঐ মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে একমাত্র তাঁকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৯৫৮ সালেও জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের সঙ্গে-সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে সর্বপ্রথম তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাকিস্তানের ২৪ বছরের মধ্যে ১২ বছর জেলে এবং বাকি সময় গোয়েন্দাদের কড়া নজরদারির মধ্যে তাঁর দিন কেটেছে। তাঁর কাছে পাকিস্তান নিজের স্বাধীন বাসভূমির পরিবর্তে ছিল বৃহত্তর কারাগারতুল্য। বস্তুত পাকিস্তানের শুরু থেকেই বাঙালিদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ন্যায্য দাবি দৃঢ়ভাবে ধারণ এবং তাদের ওপর শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের কাছে এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন।
৬-দফাভিত্তিক আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬৮ সালে আইয়ুব সরকার আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন এবং বঙ্গবন্ধুকে চিরতরে নিঃশেষ করার হীন উদ্দেশ্যে জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় তাঁকে এক নম্বর আসামি করে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক আগরতলা মামলা- (আনুষ্ঠানিক নাম ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’) দায়ের করলে এক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ৬-দফা কর্মসূচির সঙ্গে ছাত্রসমাজের এগারোদফা কর্মসূচি-ভিত্তিক (জানুয়ারি ১৯৬৯) যুক্ত আন্দোলনের ফলে বাঙালির জাতীয় মুক্তির চেতনায় আসে গণজোয়ার, সংঘটিত হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। ২২শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আগরতলা মামলার অন্য অভিযুক্তরা নিঃশর্ত মুক্তি লাভ করেন। পরের দিন অর্থাৎ ২৩শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ছাত্র- জনতার বিশাল গণসংবর্ধনা সভার সভাপতি, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও ডাকসু-র ভিপি তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ (বাংলা বা বাঙালির বন্ধু) উপাধিতে ভূষিত করেন। গণসংবর্ধনা সভার সভাপতি তোফায়েল আহমেদ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলেন, ‘আমরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে নানা বিশেষণে বিশেষিত করার প্রয়াস পাই। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে যে সত্যটি সবচাইতে ভাস্বর হইয়া উঠে তা হইতেছে তিনি মানব দরদী- বিশেষ করিয়া বাংলা ও বাঙালীর দরদী, প্রকৃত বন্ধু। তাই আজকের এই ঐতিহাসিক জনসমুদ্রের পক্ষ হইতে আমরা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করিতে চাই।’ রেসকোর্সের জনতার মহাসমুদ্র এক বাক্যে বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে এ প্রস্তাব সমর্থন করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, ‘প্রয়োজন হইলে সংগ্রাম করিয়া আবার কারাগারে যাইব, কিন্তু দেশবাসীর সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিব না। এভাবে ‘শেখ মুজিব’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’র উত্থান।
নতুন সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচন দিলে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত সে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন (মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৭টি আসনসহ) পেয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। বঙ্গবন্ধু এ নির্বাচনকে আওয়ামী লীগের পক্ষে তাঁর ৬-দফা কর্মসূচির ওপর গণভোট হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি পূর্ববাংলার জনগণের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। নির্বাচন শেষে ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারি তিনি পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সকল গণপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে রেসকোর্সের এক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ৬-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অঙ্গীকার করেন।
নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্রে সরকার গঠনের সুযোগ না দিয়ে বরং এ রায়কে নস্যাৎ করে বাঙালিদের পদানত করে রাখার লক্ষ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এর অংশ হিসেবে মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোনোরূপ পূর্বালাপ ছাড়াই ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন, যা ২রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পাকিস্তানের সামরিক আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশব্যাপী পালিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গোটা বেসামরিক প্রশাসন তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং তাঁর নির্দেশমতো চলে। তিনি কার্যত সরকার প্রধানে পরিণত হন। তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটের অনুরূপ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সর্বমহল থেকে তাঁর প্রতি স্বাধীনতা ঘোষণার আহ্বান আসতে থাকে। এদিকে মার্চের ২ তারিখ সংগ্রামী ছাত্রসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। এ অবস্থায় ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর জনসভার ঘোষণা এলে তিনি ঐদিন একতরফা বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন এই মর্মে দেশে ও বিদেশে সংবাদপত্রসহ সর্বমহলে আলোচনা শুরু হয়। বাঙালির জাতীয় মুক্তির ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে ৭ই মার্চ তিনি জাতির উদ্দেশে তাঁর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য নিয়ে রেসকোর্স ময়দানের উত্তাল জনসমুদ্রের সভামঞ্চে হাজির হন।
সেখানে রাখেন তাঁর ইতিহাসখ্যাত ভাষণ, যা সাতই মার্চের ভাষণ নামে বহুল পরিচিত। নাতিদীর্ঘ সেই ভাষণে পাকিস্তানের ২৩ বছরে বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন, শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, পাকিস্তানি শাসন-নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বাঙালির অসহযোগ ও প্রতিরোধ সংগ্রাম অচিরেই মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়ার ইঙ্গিত এবং শত্রুর মোকাবেলায় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বনের ধারণা দিয়ে বক্তব্যের শেষে তিনি ঘোষণা করেন: ‘প্রত্যেক ঘরে-ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ ছিল বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা। তাঁর জন্য এটি ছিল এক অগ্নিপরীক্ষা। কোনোরূপ হঠকারিতাকে অতি সতর্কতা ও দক্ষতার সঙ্গে পরিহার করে ভাষণে তিনি ‘স্বাধীনতা’র কথা এমনভাবে উচ্চারণ করেন, যাতে ঘোষণারও কিছু বাকি থাকেনি, আবার তাঁর বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ উত্থাপন করাও শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। এখানেই তাঁর নেতৃত্বের শ্রেষ্ঠত্ব। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতা হিসেবে যাতে চিহ্নিত হতে না হয় সে ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। তা না হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাই হয়তো অনিশ্চিত হয়ে পড়ত।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নাম করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সৈন্য আনতে থাকে। এরপর ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর -অপারেশন সার্চলাইট নামে সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় নির্বিচার গণহত্যা। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ২৫শে মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যা তৎকালীন ইপিআর ট্র্যান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রামে ওয়ারলেস বার্তা আকারে পাঠানো হয়। তাঁর এ ঘোষণার শুরুটা ছিল এরূপ: ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ হতে বাংলাদেশ স্বাধীন।
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে রাখা হয়। ৩ দিন পর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং কারাগারে বন্দি করে রাখে। বিদ্রোহে প্ররোচনা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সেখানে সামরিক ট্রাইব্যুনালে তাঁর প্রহসনমূলক বিচার অনুষ্ঠান এবং বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু বিশ্ব নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপের ফলে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার পক্ষে সে রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস আক্রমণ এবং গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। এ-যুদ্ধ সংগঠিত করা ও তাতে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা পাকিস্তানে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করেন, যা মুজিবনগর সরকার নামে খ্যাত।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা, ঐক্য ও শক্তির উৎস। তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। অতঃপর নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলে (১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১) ৮ই জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে প্রথমে লন্ডন পৌঁছেন। ৯ই জানুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুকে ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে অভ্যর্থনা জানান।
এরপর দিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তিনি বিজয়ীর বেশে স্বাধীন মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন। সারাদেশে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যায়। সমাজের সর্বস্তরের লাখো জনতা তেজগাঁ বিমানবন্দরে তাঁকে বীরোচিত অভ্যর্থনা জানায়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নতুন প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্ব এবং সেই সূত্রে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বমহলে উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার যে কালো মেঘ দেখা দিয়েছিল, তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে তা তিরোহিত হয়।
ব্যক্তি জীবনে লেখাপড়ার প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। তিনি সব সময় সন্তানদের পড়াশুনায় উৎসাহ দিতেন। তাঁর খুবই সমৃদ্ধ একটি পারিবারিক লাইব্রেরি ছিল। কারাগারে জীবনের দীর্ঘ সময় বন্দি থাকাকালীন তিনি প্রচুর বই পড়ে সময় কাটাতেন। এমন অনেক দুর্লভ বইয়ের কথা তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, যার নাম পর্যন্ত অনেকের কাছে অজানা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবন-স্বপ্ন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরপর ১৮ই জানুয়ারি ১৯৭২ তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি সে-কথাই বলেছিলেন। ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন তাঁর জীবনের সুখের দিন কোনটি। বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন, “আমি যেদিন শুনলাম, আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে … বহুদিন যাবৎ আমি এই [স্বাধীনতার] স্বপ্ন দেখে আসছি।’
স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ও জাতির পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করে ১০ মাসের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়ন, ১ কোটি শরণার্থীর পুনবার্সন, শতাধিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়, জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ, রাষ্ট্র ও সরকারের মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহ তৈরি ও অনেকগুলোর ভিত্তি স্থাপন, স্বাধীনতাবিরোধী ও উগ্রপন্থীদের মোকাবেলা করাসহ মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস অবস্থা থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হন। ১৯৭৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দান করে মাতৃভাষার মর্যাদা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের হাতে পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্যসহ জাতির পিতা ও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাঁর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু ডায়েরি আকারে কিছু লেখা রেখে যান, যা থেকে এ পর্যন্ত তাঁর তিনটি মহামূল্যবান গ্রন্থ, যথা— অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারের রোজনামচা (২০১৭) ও আমার দেখা নয়া চীন (২০২০) প্রকাশিত হয়। এ থেকে তাঁর রাজনীতি, রাজনৈতিক জীবন-আদর্শ, কর্ম, নেতৃত্ব, বাঙালির জাতীয় মুক্তির প্রশ্ন ও তাঁর রাষ্ট্রভাবনা ইত্যাদি সম্বন্ধে সবিস্তার জানা যায়। [হারুন-অর-রশিদ]
সহায়ক গ্রন্থ: শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা, ইউপিএল ২০১২; শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি ২০১৭; হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ, ঢাকা, ইউপিএল ২০১৩; হারুন-অর-রশিদ, মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬, বাংলা একাডেমি ২০১৬; হারুন- অর-রশিদ, ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ ৬ দফার ৫০ বছর, বাংলা একাডেমি ২০১৬; হারুন-অর-রশিদ, ৭ই মার্চের ভাষণ কেন বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ: বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ, ঢাকা, অন্যপ্রকাশ ২০১৮; হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গীয় মুসলিম লীগ: পাকিস্তান আন্দোলন, বাঙালির রাষ্ট্রভাবনা ও বঙ্গবন্ধু, ঢাকা, অন্যপ্রকাশ ২০১৮; হারুন-অর-রশিদ, বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, ঢাকা, আগামী প্রকাশনী ২০০৩; হারুন-অর-রশিদ ও অন্যান্য (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধু: রাজনীতি ও প্রশাসন, ঢাকা, বঙ্গবন্ধু পরিষদ ১৯৯৯; বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ঢাকা ১৯৯৩; Secret Documents of Intelligence Branch (IB) on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, vol. 1, 1948-1950, Hakkani Publishers 2018; Secret Documents, vol. 2, 1951-1952, Hakkani Publishers 2019; Sharyar Iqbal (ed.), Sheikh Mujib in Parliament (1955-1958), Dhaka, Agamee Prakashani 1997; S A Karim, Sheikh Mujib : Triump and Tragedy, Dhaka 2005; Archer K Blood, The Cruel Birth of Bangladesh: Memories of an American Diplomant, Dhaka 2002; Harun-or-Rashid, The Foreshadowing of Bangladesh : Bengal Muslim League and Muslim Politics 1906-1947, Dhaka 2013; Obaidul Huq, Bangabandhu Sheikh Mujib: A Leader with A Difference (Original Voice of Thunder, 1973), Dhaka 1996, ইত্তেফাক, ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড