মুক্তিযুদ্ধে বটিয়াঘাটা উপজেলা (খুলনা)
বটিয়াঘাটা উপজেলা (খুলনা) নদীবেষ্টিত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। ভৌগোলিকভাবে জেলা সদরের কাছাকাছি অবস্থিত হলেও এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন সুগম ছিল না। নদীপথই ছিল মূলত যোগাযোগের মাধ্যম।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ফলে সারা দেশের মতো বটিয়াঘাটার মানুষও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন- শুরু হলে মানুষ তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। এরপর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানালে এ অঞ্চলের ছাত্র-জনতা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়।
২৫শে মার্চের পর বটিয়াঘাটায় মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম শুরু হয়। যুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। শেখ হারুনুর রশীদের (আওয়ামী লীগ নেতা, বর্তমানে খুলনা জেলা পরিষদের প্রশাসক) নেতৃত্বে বটিয়াঘাটা থানা চত্বরে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ছাত্রনেতা পঞ্চানন বিশ্বাসের (বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা এবং বটিয়াঘাটা- দাকোপ সংসদীয় এলাকা থেকে নির্বাচিত এমপি) নেতৃত্বে এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন গ্রাম থেকে চাল, ডালসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ শুরু করে। চক্রাখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয় এবং তাঁদের জন্য সংগৃহীত খাবার-দাবার সেখানে মজুদ রাখা হয়।
বটিয়াঘাটা উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রাণভয়ে বাস্তুভিটা ত্যাগ করে ভারতে চলে গেলে সমগ্র উপজেলা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে এখানে মুক্তিযুদ্ধের কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। তবে এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যুদ্ধের শুরুতে খুলনার তৎকালীন রেডিও সেন্টার আক্রমণের সময় এই এলাকার ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযোদ্ধা ও ইপিআর সদস্যদের নানাভাবে সহযোগিতা করে। পাশাপাশি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র-যুবকরা মিলে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এলাকা থেকে চিড়া, গুড়, মুড়ি, নারকেল ইত্যাদি সংগ্রহ করে চক্রাখালী হাইস্কুলে এবং বটিয়াঘাটা সদরে ২ নং ইউনিয়ন পরিষদে মজুদ করে রাখে। চক্রাখালী হাইস্কুলকে কেন্দ্র করে সংগ্রাম পরিষদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। খুলনা রেডিও সেন্টার আক্রমণের সময় বেশকিছু ইপিআর সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে চক্রাখালী হাইস্কুলে আশ্রয় নেন। চক্রাখালী গ্রামের ডাক্তার সুবোধ চন্দ্র অধিকারী তাঁদের চিকিৎসা দেন।
এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— শেখ হারুনুর রশীদ, পঞ্চানন বিশ্বাস, বিনয় কৃষ্ণ সরকার, মো. আফজাল হোসেন, মো. শওকত হোসেন ইঞ্জিনিয়ার, মনোরঞ্জন মণ্ডল, ইন্দ্রজিৎ জোদ্দার, মোক্তার মোল্লা, হরেন্দ্রনাথ টিকাদার, মুকুল বিশ্বাস, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস প্রমুখ। এঁরা বটিয়াঘাটায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত ও প্রাথমিক প্রতিরোধসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন। পঞ্চানন বিশ্বাস পরবর্তীকালে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন, বিনয়কৃষ্ণ সরকার ও ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস যুদ্ধকালীন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধা মনোরঞ্জন মণ্ডল সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তের কাছে লক্ষ্মীদাড়ি গ্রামে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং পরবর্তীতে বটিয়াঘাটায় যুদ্ধকালীন ডেপুটি কমান্ডারের দ্বায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক ছিলেন কড়িয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের কমান্ডার।
এলাকাবাসী স্থানীয় ব্যক্তিদের লাইসেন্সকৃত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা-বারুদ নিয়ে পাকবাহিনীর দোসরদের লুটপাট ও হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বটিয়াঘাটা উপজেলা নদীবেষ্টিত হওয়ায় এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা বেশ সহজ হয়েছিল। বিশেষ করে নদীর বাঁধের ওপর দিনরাত পালাক্রমে এলাকাবাসী টহলের ব্যবস্থা রেখেছিল। উল্লেখ্য, এ-সময় পর্যন্ত এ এলাকায় নিয়মিত মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠেনি। ১৭ই মে কাজীবাছা নদীর পূর্বপাড়ের গ্রামগুলো থেকে খান এ সবুরের অনুসারী কয়েকশত লোক লুটপাটের উদ্দেশ্যে আন্ধারিয়া গ্রামে হামলা করে। সশস্ত্র লুটপাটকারীরা সেদিন এলাকাবাসীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে সফল হতে পারেনি। সুধন্য ডাকাত, প্রফুল্ল ডাকাত ও অনিল মল্লিকের নেতৃত্বে সে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। সেদিন দুপক্ষের মধ্যে প্রায় ৪ ঘণ্টা ব্যাপক গোলাগুলির পর আন্ধারিয়া গ্রামের কিছু অংশে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পর পাকবাহিনীর দোসররা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
বটিয়াঘাটাবাসীর এ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মে মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কার্যকর ছিল, যদিও এর আগে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনীর নেভাল ফোর্স এখানে একবার আঘাত হেনেছিল। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এখানকার প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আগে থেকেই কিছু মানুষ এলাকা ছেড়ে ভারতে চলে যায় এবং ক্রমশ গ্রামগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ে। ১৯শে মে রাজাকার ও পাকবাহিনী হামলা চালিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালালে এখানকার প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে এবং বটিয়াঘাটা উপজেলাসহ পূর্ব থেকে এ অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণকারী খুলনা জেলা ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকার বিশেষ করে বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরিশাল অঞ্চলের অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে চলে যায়।
বটিয়াঘাটায় পাকবাহিনীর প্রথম অনুপ্রবেশ ঘটে ২৪শে এপ্রিল শনিবার। ১নং জলমা ইউনিয়নের সামনে সাপ্তাহিক হাটের দিন পাকবাহিনীর নেভাল ফোর্সের দুটি গানবোট কাজীবাছা নদী দিয়ে এ উপজেলায় প্রবেশ করে। গানবোট দুটি থেকে পাকবাহিনীর সদস্যরা চক্রাখালী হাইস্কুল ভবনে গুলি চালায় এবং এলাকার বিভিন্ন গ্রামে ব্যাপক হত্যা ও অগ্নিসংযোগ করে। এরপর ১৯শে মে পাকবাহিনী বাদামতলা, দেবীতলা ও ফুলতলা গ্রামে অনুপ্রবেশ করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১নং জলমা ইউনিয়নের গল্লামারী এলাকার খুলনা রেডিও সেন্টার (বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস) ও লায়ন্স স্কুলে পাকবাহিনী তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্প দুটিতে তারা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে ধরে এনে ব্যাপক নির্যাতন করে হত্যার পর গল্লামারী নদীতে মৃতদেহ ভাসিয়ে দিত; কখনো-কখনো মৃতদেহগুলো মাটিতে পুঁতে রাখত।
খুলনার মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুরের আশীর্বাদপুষ্ট বটিয়াঘাটা উপজেলার মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা স্থানীয়ভাবে পাকবাহিনীর সহযোগী শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে। বটিয়াঘাটায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ছিল খান এ সবুর (মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং আইয়ুব সরকারের সাবেক মন্ত্রী)। তার নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। বটিয়াঘাটা থানা শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল লুৎফর রহমান মোক্তার এবং সম্পাদক ছিল আবু জাফর মৌলবী। এছাড়া এ এলাকায় লুটতরাজ, বাড়িঘরে আগুন দেয়া, হামলা-নির্যাতন, হত্যা-ধর্ষণের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল, তাদের মধ্যে শেখ আব্দুল আজিজ, খোরশেদ আলী মোল্লা, গোলাম রহমান, লুৎফর রহমান, হাবিবুর রহমান গোলদার, শহীদুল্লা গোলদার, কাওছার মোল্লা, লিয়াকত শেখ, কামাল গোলদার, আবু জাফর মৌলবী, মাওলানা সাত্তার, আশরাফ আলী শেখ, সরদার এন্তাজ আলী, হাতেম আলী গাজী, মোজাহার আলী শেখ, জাহান আলী খাঁ, ফজু খাঁ, আবু তালেব, মুনসুর আলী, আব্দুস সাত্তার প্রমুখ ছিল উল্লেখযোগ্য।
বটিয়াঘাটা অঞ্চলটি হিন্দু অধ্যুষিত ও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল গৃহস্থের হওয়ায় স্বাধীনতাবিরোধীরা সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিল তাদের ঘরবাড়ি লুটপাট করার জন্য। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে ব্যাপকভাবে অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। এরপর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভারতে চলে যাওয়ার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর ইচ্ছেমত লুটপাট করে। ২৪শে এপ্রিল পাকবাহিনীর নেভাল ফোর্স প্রথম বটিয়াঘাটায় অনুপ্রবেশ করে হত্যা শুরু করে। তারা বেশ কয়েকটি গ্রামের অন্তত ৫০ জন লোককে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে মে মাসের মাঝামঝি সময় পর্যন্ত তারা অব্যাহতভাবে হত্যাকাণ্ড চালায়। এরপর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভারতে চলে গেলে এলাকা প্রায় জনশূন্য হওয়ায় পাকবাহিনীর আনাগোনা অনেকটা কমতে থাকে। তবে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাট অব্যাহত থাকে। ১৯শে মে উপজেলার বাদামতলা গ্রামে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা গণহত্যা চালায়। এলাকাবাসীর কাছে এটি বাদামতলা গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। এদিন পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে রাজাকাররা দেবীতলা গ্রামে প্রবেশ করে পার্বতী মণ্ডল, উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, বলাই মণ্ডল ও নীলকমল রায়কে হত্যা করে। রামপাল উপজেলায় পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে আগত এবং স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বহুলোক ভারতের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় পাকবাহিনী ও রাজাকাররা তাদের বাদামতলা বাজারের অদূরে বসুরাবাদ গ্রামে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ২৮শে মে কাতিয়ানাংলা গণহত্যা সংঘটিত হয়। এতে বহু সংখ্যক সাধারণ মানুষ শহীদ হন। ২৮শে সেপ্টেম্বর – গজালিয়া সুইজ গেইট গণহত্যা – সংঘটিত হয়। এতে একজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ১০ জনের অধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। ২৯শে নভেম্বর বারোআড়িয়া হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এতে ৫ মাসের শিশুসহ ৪ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়।
মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা উপজেলার ফুলতলা, দেবীতলা, বসুরাবাদ, বয়ারভাঙ্গা, জলমা, চক্রাখালী, গোন্ধামারী, মাইটভাঙ্গা ও আন্ধারিয়া গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। ঘরবাড়ির পাশাপাশি অবস্থাপন্ন মানুষের গোলাভর্তি ধানে তারা আগুন দেয়। মে মাসের শেষে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ ফেলে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করলে স্বাধীনতাবিরোধীরা জনশূন্য ঘরবাড়ি থেকে বহু মূল্যবান সম্পদ, পুকুরের মাছ, গবাদি পশু ও গোলার ধানসহ নানাবিধ সামগ্রী লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়।
উপজেলার ১নং জলমা ইউনিয়নের গল্লামারী এলাকায় অবস্থিত খুলনা রেডিও সেন্টার ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এখানে খুলনা শহরসহ আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। তাছাড়া বটিয়াঘাটা থানা ভবন পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনীর বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই উপজেলার গল্লামারী নদীর পাশে নির্জন স্থানে প্রায় প্রতিরাতে খুলনা শহরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সহায়তাকারী ও সাধারণ মানুষকে ধরে এনে হত্যার পর জোয়ারের সময় লাশগুলো নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতো এবং ভাটার সময় লাশগুলো নদীর চরে পুঁতে রাখা হতো। এটি গল্লামারী বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। গল্লামারী বধ্যভূমির বিপরীত পাশে খুলনা রেডিও সেন্টারটি পাকবাহিনীর দখলে ছিল। এখানে বহু মানুষকে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। গল্লামারী বধ্যভূমিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় হাজার-হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে এখানে সামান্য খনন করে বহু মানুষের হাড়গোড়, কঙ্কাল ও মাথার খুলি পাওয়া যায়।
পাকবাহিনী ২৪শে এপ্রিল চক্রাখালী অভিযান পরিচালনা করে। পাকবাহিনীর চক্রাখালী অভিযান-এ কয়েকজন সাধারণ মানুষ শহীদ হন এবং পাকসেনারা বেশ কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই খুলনা রেডিও স্টেশনটি পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে রেডিও স্টেশনটির দখল নেয়ার জন্য ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে চেষ্টা চালান। কিন্তু পাকবাহিনীর এ শক্ত ঘাঁটিটি দখল করতে তাঁরা ব্যর্থ হন। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ১৫ই ডিসেম্বর খুব ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা রেডিও স্টেশনটিতে আক্রমণ চালান। পাকসেনারাও পাল্টা গুলি চালায়। ঘণ্টাখানেক যুদ্ধ চলার পর কৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। ১৬ই ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে।
পুনরায় আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে সারারাত ব্যাপক গোলাগুলি হয়। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং রেডিও স্টেশনটি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এটি খুলনা রেডিও স্টেশন অপারেশন হিসেবে পরিচিত।
২০শে নভেম্বর ঈদুল ফিতরের দিন মুক্তিযোদ্ধারা বারোআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এতে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা বিনয় কৃষ্ণ সরকার। সারারাত উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির পর রাজাকারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ ও জ্যোতিষ চন্দ্র মণ্ডল শহীদ হন। এটি বারোআড়িয়া যুদ্ধ- নামে পরিচিত। আগস্ট মাসে ভারতের টাকিতে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নিয়ে সরাসরি বটিয়াঘাটা এসে থানা ভবন ঘিরে ফেলেন। তিনি পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে তারা অস্বীকার করে। ফলে দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এ-যুদ্ধে ১৭ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ৮ জনের মতো পুলিশ সদস্যকে বন্দি করেন এবং বেশকিছু রাইফেল ও গুলি হস্তগত করেন। এটি বটিয়াঘাটা থানা অপারেশন হিসেবে পরিচিত। ১৬ই ডিসেম্বর বটিয়াঘাটা উপজেলা শত্রুমুক্ত হয় এবং এখানে বসেই মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা শহর শত্রুমুক্ত করার পরিকল্পনা করেন।
বটিয়াঘাটা উপজেলায় দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন- জ্যোতিষচন্দ্র মণ্ডল (পিতা সন্তোষ কুমার মণ্ডল, সুন্দর মহল) এবং আব্দুল আজিজ মোল্যা (পিতা আলহাজ্ব নওয়াব আলী মোল্যা, মৌখালী)।
শহীদ জ্যোতিষ ও শহীদ আজিজের নামে বটিয়াঘাটা সদর থেকে বারোআড়িয়া পর্যন্ত ১৫-১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ জ্যোতিষ-আজিজ সড়ক। ডেওয়াতলা হাইস্কুলের সামনে ৩নং গঙ্গারামপুর ইউনিয়নের সকল মুক্তিযোদ্ধার নামখচিত একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। একইভাবে বয়ারভাঙ্গা হাইস্কুলের সামনে এ ইউনিয়নের সকল মুক্তিযোদ্ধার নামখচিত আরেকটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। ১নং জলমা ইউনিয়নের গল্লামারী বধ্যভূমিতে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ। খুলনাবাসী মহান স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসসহ গুরুত্বপূর্ণ দিবসে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এ স্মৃতিসৌধে আসে। খুলনায় প্রতিষ্ঠিত ‘১৯৭১: গণহত্যানির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’-এর উদ্যোগে বাদামতলা বাজারের পাশে ২০১৪ সালের ১৯শে জুন বাদামতলা গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিদের নামখচিত একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া এ উপজেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কলেজ ও মুক্তিযোদ্ধা কলেজ নামে দুটি কলেজ আছে। [শংকর কুমার মল্লিক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড