বটিয়াঘাটা থানা অপারেশন (বটিয়াঘাটা,খুলনা)
বটিয়াঘাটা থানা অপারেশন (বটিয়াঘাটা,খুলনা) পরিচালিত হয় আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে। এতে থানার ১৭ জন পুলিশ নিহত হয় এবং ৩ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন। এপ্রিল ও মে মাস জুড়ে বটিয়াঘাটা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড শুরু করলে এ এলাকার মানুষ, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। উপজেলার জলমা, বটিয়াঘাটা, গঙ্গারামপুর প্রভৃতি ইউনিয়ন প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। খুলনা শহরের কাছাকাছি এ অঞ্চল হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ায় অন্যান্য এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাছাড়া বাগেরহাট ও খুলনার বিভিন্ন উপজেলা এবং বরিশালের কিছু এলাকার মানুষ এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে ভারতে যেতে থাকে।
বটিয়াঘাটার ওপর দিয়ে খুলনা-মংলা নৌ চলাচলের রুট হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী এ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। স্থানীয় রাজাকার বাহিনী পাকসেনাদের সহযোগিতায় পুরো বটিয়াঘাটা অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বটিয়াঘাটা থানা ছিল কাজীবাছা নদীর তীরে। নৌপথ দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের ভিটেমাটি ছেড়ে আসা মানুষ ভারতে যাওয়ার পথে লুটপাট, হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হতো। বিশেষ করে বটিয়াঘাটা থানার পুলিশদের দ্বারা নারীনির্যাতন ও লুটপাটের ঘটনা ঘটত। এর নেতৃত্বে ছিল থানার দারোগা মি. বেগ। ভুক্তভোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাওয়ার পর বটিয়াঘাটা থানার নির্যাতনের ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাদের অবহিত করেন। তখন ইছামতী নদীর অপর পারে টাকী ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা বটিয়াঘাটা থানাসহ বেশকিছু অপারেশনের জন্য আগস্ট মাসের প্রথম দিকে বটিয়াঘাটায় পৌঁছান।
মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরার ভেতর দিয়ে পাইকগাছার সোলাদানা হয়ে বটিয়াঘাটার ৬নং বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের জালিয়াপাড়া গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা দুলাল গোলদারের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সন্ধ্যার পর তাঁরা নদী পার হয়ে ফুলতলা গ্রামের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে অবস্থান নেন। সেখান থেকে অধ্যাপক ফিরোজুর রহমান, আব্দুর রহমান, হাসান হালদার, মালেক শেখ ও রবিন রায় থানা এলাকা রেকি করে আসার পর চূড়ান্তভাবে থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। থানা অপারেশনের আগে থানার পিসিও ও ওয়ারলেস সেট মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করে দেন। এরপর নদীর তীরে অবস্থিত থানার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন। কিন্তু পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে তাঁদের ওপর ব্যাপকভাবে গুলিবর্ষণ করে। তখন মুক্তিযোদ্ধারাও এলএমজি দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকেন। ঘণ্টা দেড়েকের মতো যুদ্ধের পর পুলিশের গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়। তখন আফজাল হোসেন, খিজির আলী, কুতুবউদ্দিন ও আনোয়ার হোসেন গুলি করতে-করতে থানায় প্রবেশ করেন। অন্যরা সে-সময় কভারিং দিতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধারা পুলিশদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে তারা আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে ১৮টি রাইফেল, কয়েকটি বন্দুক, বেশকিছু গুলি এবং ৪০ হাজার টাকা উদ্ধার করেন। এ-যুদ্ধে ১৭ জন পুলিশ এবং ৩ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে এ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন খিজির আলী, কুতুবউদ্দিন, দীনবন্ধু মণ্ডল (রামপাল), নিরঞ্জন, হাশেম, আনোয়ার হোসেন, সিদ্দিক মল্লিক, বিদ্যুৎ রায়, যতীন্দ্রনাথ মণ্ডল, নির্মল কুমার অধিকারী, ধীরেন্দ্রনাথ মণ্ডল, আকরাম হোসেন, ফিরোজুর রহমান, আব্দুর রহমান, হাসান হালদার, আব্দুল মালেক, রবিন রায় প্রমুখ। [শংকর কুমার মল্লিক]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড