You dont have javascript enabled! Please enable it!

বগুড়া প্রতিরোধযুদ্ধ (বগুড়া সদর)

বগুড়া প্রতিরোধযুদ্ধ (বগুড়া সদর) সংঘটিত হয় ২৬শে মার্চ থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত। এতে ৪৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে বেশ কয়েকজন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন। ২৫শে মার্চ রাতে রংপুর থেকে বগুড়ার দিকে পাকসেনাদের আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র-জনতা একতাবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য রাত ১২টার পর যার হাতে যা ছিল তাই নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। তারা শহরের মাটিডালি থেকে বড়গোলা হয়ে ২নং রেলগেট পর্যন্ত প্রধান সড়কে ইটভাটা থেকে ইট, গাছের গুঁড়ি এবং রেলস্টেশন থেকে বগি এনে শহরের রেলগেটে ব্যারিকেড দেয়।
ভাষা সৈনিক গাজীউল হক খবর পেয়ে ডা. জাহিদুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে বগুড়া সদর থানায় আসেন এবং রাতেই তাঁরা আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল হাসান খান, মোস্তাফিজার রহমান পটলসহ অন্যদের নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। তাঁরা বগুড়া পুলিশ লাইনসে গিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক পুলিশ সদস্যদের হত্যার খবর দেন। এ খবর শুনে বগুড়া পুলিশ লাইনসের কর্মকর্তারা পুলিশের সকল সদস্যকে অস্ত্র হাতে নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। এদিকে বগুড়া সদর থানার দারোগা নিজাম উদ্দিন এবং নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে স্থানীয় কিছু পুলিশ এবং ছাত্র-জনতা পাকসেনাদের প্রতিহত করার জন্য শহরের ঝাউতলায় আজাদ গেস্ট হাউজের ছাদের ওপর অবস্থান নেয়। বড়গোলা ও ঝাউতলা সড়কের বিভিন্ন স্থান ও বিল্ডিং-এর ছাদে পাকসেনাদের প্রতিরোধে অংশ নেন এনামুল হক তপন, নুরুল আনোয়ার বাদশা, টিটু, হিটলু, ছুনু, আজাদ, তারেক, খোকন পাইকার, সালাম, বখতিয়ার হোসেন, রাজিউল্লাহ, জাকারিয়া তালুকদার প্রমুখ। বগুড়া সদর থানার উত্তরে রেল লাইনের এক পাশে অবস্থান নেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের রফিকুল ইসলাম লাল, মাছুদার রহমান হেলাল, মকবুল হোসেন, খাদেমুল ইসলাম, মাহবুবুর রহমান রাজা, নুরুল আনোয়ার বাদশা, মাহফুজার রহমান মান্নান প্রমুখ। রাতভর তারা স্লোগান দিয়ে সকলকে উজ্জীবিত রাখেন।
২৬শে মার্চ সকালে রংপুর থেকে পাকবাহিনী বগুড়া শহর অভিমুখে রওনা হয়ে বাঘোপাড়া এলাকায় এসে আটকে যায়। বাঘোপাড়া থেকে শহরে আসার পথে পাকসেনাদের প্রতিহত করতে শতাধিক জায়গায় বন্দুক, বল্লম, লাঠিসোঁটা, দা, কুড়াল ইত্যাদি নিয়ে সহস্রাধিক মানুষ অবস্থান নেয়। সকাল সাতটার দিকে পাকবাহিনী বাঘোপাড়া পেরিয়ে ঠেঙ্গামারা পর্যন্ত পৌঁছায়। সেখানে গাছ কেটে রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার সময় ঠেঙ্গামারা গ্রামের রিকশা চালক তোতা মিয়া (পিতা ভোলা শেখ) পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। তোতা মিয়ার লাশের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে পাকসেনারা নওদাপাড়া পেরিয়ে গুলি ছুড়তে-ছুড়তে মাটিডালি পৌছায়। পাকসেনাদের একটি অগ্রগামী দল পায়ে হেঁটে শহরের মধ্যে এগিয়ে আসে। এ- সময় তারা মাটিডালি, ফুলবাড়ি ও বৃন্দাবনপাড়ার বেশকিছু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। মাটিডালির পর থেকে জয়পুরপাড়া, বিসিক, ফুলবাড়ি, কালিতলা, দত্তবাড়ি, বড়গোলা ও ঝাউতলা হয়ে ২নং রেলগেট পর্যন্ত রাস্তায় তখন হাজার-হাজার ছাত্র-জনতা অবস্থান করছিল। শহরের ফুলবাড়ি সুবিল ব্রিজের কাছে পাকবাহিনী ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে (দ্রষ্টব্য সুবিল ব্রিজ প্রতিরোধ যুদ্ধ)। ভাষা সৈনিক গাজীউল হক ও এনামুল হক তপনের নেতৃত্বে দুটি দল কালিতলা থেকে বড়গোলা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকসেনারা ২নং রেলগেটের কাছে এলে আজাদ রেস্ট হাউজের ছাদের ওপর অবস্থান নেয়া দারোগা নিজামউদ্দিন, দারোগা নুরুল ইসলাম এবং তাঁদের সহযোগীদের ৩০৩ রাইফেল এবং বড়গোলার মোড়ে ইউনাইটেড ব্যাংকের ছাদে অবস্থান নেয়া ৩ জন তাঁদের বন্দুক দিয়ে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের এ-যুদ্ধে ঘটনাস্থলে টিটু নামে অষ্টম শ্রেণির একজন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন এবং দুজন পাকসেনা গুরুতর জখম হয়। পাকসেনারা দ্রুত ব্যাংক ভবনটি ঘিরে ফেলে এবং সেখানে অবস্থানরত মোস্তাফিজুর রহমান চুন্নু ও হিটলুকে হত্যা করে। তাদের গুলিতে বোম্বে সাইকেল স্টোরের ছাদে মাথায় গুলি লেগে আজাদ শহীদ হন। পাকবাহিনী ২নং রেলগেট সংলগ্ন একটি চায়ের দোকান ও ৩নং রেলগেট সংলগ্ন একটি রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে ১২ জন হোটেল শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে, যা বগুড়া রেলগেট গণহত্যা নামে পরিচিত। সকাল সাড়ে আটটার দিকে ডা. জাহিদুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশ লাইনস থেকে ৬০ জনের একটি দল ৩০৩ রাইফেল হাতে নিয়ে পাকসেনাদের প্রতিরোধে নেমে পড়ে। দুপক্ষে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। গোলাগুলির মধ্যেই পাকহানাদার বাহিনী সড়ক ধরে পিছু হটে শহরের উত্তর প্রান্তে কটন মিলস রেস্ট হাউজ এবং মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে তারা ভারী মেশিনগান ব্যবহার করে মর্টারের গোলাবর্ষণ করে। ২৭শে মার্চ তিনটার দিকে তাদের মর্টারের গোলার আঘাতে দশম শ্রেণির ছাত্র তারেক শহীদ হয়। তারা এদিন কালিতলা এলাকায় ফজলুল বারীর বাড়িতে ঢুকে তাকে হত্যা করে। এ-সময় তারা আওয়ামী লীগ কর্মী মাহফুজার রহমান বাবুর বাড়িতে (মাটিডালি) তার ভাইয়ের ছেলে রেজাউল ইসলাম ডাবলু, জুবিলি স্কুলের শিক্ষক আবদুল হামিদ এবং শিববাটিতে রিকশাচালক সোলেমান আলীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ২৮শে মার্চ নওগা থেকে আগত ৩৯ জন ইপিআর সদস্য, স্থানীয় পুলিশ, মুক্তিযোদ্ধা এবং ছাত্র- জনতার মিলিত অপারেশনে ২৩ জন পাকসেনা এবং মুক্তিযোদ্ধা তপনের রাইফেলের গুলিতে কটন মিলস গেস্ট হাউসের ছাদে অবস্থারত একজন পাকসেনা নিহত হয়। এদিন পাকবাহিনী হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে অগ্নিসংযোগ করে। ২৯শে মার্চ পাকবাহিনী বেতার ভবনের পেছেনে বৃন্দাবনপাড়ায় হামলা এবং লুটপাট করে। পুলিশ সদস্য কলিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা পাকসেনাদের বর্বরতার বিরদ্ধে গেরিলা আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে কলিম উদ্দিন শহীদ হন। ৩০শে মার্চ পাকবাহিনীর আক্রমণে বেশকিছু নিরীহ মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিত প্রতিরোধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। ৩১শে মার্চ সুবেদার আকবরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মহিলা কলেজ ঘাঁটিতে গ্রেনেড চার্জ করেন এবং পেট্রোলের ড্রামে আগুন ধরিয়ে পাকসেনাদের ঘাঁটির দিকে গড়িয়ে দেয়া হয়। এদিন পাকবাহিনী ফুলবাড়ি এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। প্রতিরোধযুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী ১লা এপ্রিল রংপুরের দিকে পালিয়ে যায়। বগুড়া প্রতিরোধ যুদ্ধে ৪৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে বেশ কয়েকজন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ হন। [মিলন রহমান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৬ষ্ঠ খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!